সময় এসেছে ট্রাম্পের
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে ঘটেছে। ‘মেকিং আমেরিকা গ্রেট এগেইন’কে কেন্দ্র করে ট্রাম্পের প্রচার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং ট্রাম্প ‘ব্লু ওয়াল’ ভেদ করে দ্বিতীয় বারের মতো ডেমোক্র্যাটদের পরাজিত করেন। সমসাময়িক ভূ-রাজনীতিতে আমেরিকাকে শক্তির অন্যতম প্রধান মেরু হিসেবে দেখা হয়। তা সত্ত্বেও আমেরিকানদের মধ্যে অসন্তোষ ও হতাশা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। তাঁদের দেশ বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, যেখানে অন্যান্য উন্নয়নশীল অর্থনীতি লাভ করছে। এই আবেগকে কাজে লাগিয়েই ট্রাম্প তাঁর প্রচারাভিযান চালিয়েছেন।
যাই হোক, একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে, ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচন অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। উন্নয়নমূলক পরিসর এমনিতেই একাধিক সমস্যায় জর্জরিত - বাণিজ্যিক যুদ্ধ, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, বাড়তে থাকা ঋণ, তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘন, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, জলবায়ু পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত এবং পরিবেশগত অবক্ষয়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব সম্ভবত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামালও দিতে পারে, আবার গুরুতর করেও তুলতে পারে। ট্রাম্প তাঁর পূর্বসূরি জো বাইডেনের ঠিক বিপরীত চরিত্রের এবং অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও মুহুর্মুহু বদলে ফেলা বিবৃতির জন্য পরিচিত। ট্রাম্প ২.০ প্রশাসনের অধীনে উন্নয়নমূলক সমস্যাগুলি সম্ভাব্য ভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সাক্ষী হবে।
অংশীদারিত্ব, সহযোগিতা এবং স্থিতিশীলতা: ট্রাম্প কি এটি করতে পারেন?
এখন প্রধান প্রশ্ন হল এই যে, ট্রাম্প কি আদৌ অংশীদারিত্বের পাশাপাশি স্থির সহযোগিতা গড়ে তুলতে পারেন এবং আমেরিকা ও বিশ্বের জন্য স্থিতিশীলতা বাড়াতে পারেন?
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমবায় কাঠামো তৈরির উপর জোর দেওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্প ২.০-র অধীনে অর্থনৈতিক বিভাজন আবারও চালিত হতে পারে। ট্রাম্প জোর দিয়েছেন যে, বহুল প্রচারিত ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিকেই তাঁর পরিকল্পনার অগ্রভাগে রাখা হবে। এটি আসলে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের মতোই বাণিজ্য বাধা, বিধিনিষেধ, শুল্ক সংস্কার ও সুরক্ষাবাদের প্রত্যাবর্তনের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে তাঁর নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প উল্লেখ করেছিলেন যে, ‘আমার কাছে অভিধানের সবচেয়ে সুন্দর শব্দটি হল 'শুল্ক'।’ তিনি ‘সকল আমদানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক, চিন থেকে আসা পণ্যের উপর কমপক্ষে ৬০ শতাংশ শুল্ক, ডলারের সঙ্গে বাণিজ্য করা থেকে দূরে সরে যাওয়া দেশগুলির উপর ১০০ শতাংশ শুল্ক এবং মেক্সিকোতে নির্মিত যানবাহনের উপর ২০০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছিলেন।’ বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা তাঁর বৈদেশিক নীতির দৃষ্টিভঙ্গির প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য বলে মনে হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমবায় কাঠামো তৈরির উপর জোর দেওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্প ২.০-র অধীনে অর্থনৈতিক বিভাজন আবারও চালিত হতে পারে।
স্বাভাবিক ভাবেই, উন্নয়ন অংশীদারিত্বও দীর্ঘমেয়াদে প্রভাবিত হয়। ডেভেক্সের পূর্বাভাস অনুসারে, ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) সাম্প্রতিক বাজেটে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে প্রায় ৪.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হ্রাস ঘটে। আমেরিকার স্থিতিশীল নেতৃত্বের কারণে তারাই সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রদানকারী (ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঠিক পরপরই), তাই এবার উন্নয়নমূলক ত্রাণের পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ইউএসএআইডি বাজেট ২০১৮ সালে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা ২০২৩ সালে ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। সর্বোপরি ট্রাম্পের রাজনৈতিক অগ্রাধিকার ও বিতর্কিত প্রজেক্ট ২০২৫-এর মধ্যে সংযোগ টানার চেষ্টা করা হচ্ছে — যা ক্ষমতায় ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফায় আসার নেপথ্যে রক্ষণশীলদের পথনির্দেশিকা বলে মনে করা হয়েছিল। প্রজেক্ট ২০২৫-কে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, সেখানে উন্নয়ন এবং বিদেশি সহায়তায় বাজেট হ্রাসের উল্লেখ রয়েছে।
এর ফলে স্থিতিশীল উন্নয়ন কর্মসূচিও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ২০২০ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে ট্রাম্পের কুখ্যাত প্রত্যাহার এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। বাইডেন প্রশাসন আমেরিকাকে স্থিতিশীলতার সমীকরণে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেও সম্ভবত ট্রাম্প এই প্রচেষ্টা বানচাল করে দিতে পারেন। সর্বোপরি, বিশেষজ্ঞরা ফেডারেল জলবায়ু নীতির অভাব-সহ জীবাশ্ম জ্বালানি উত্পাদনের ক্ষেত্রে এক ‘ব্যাপক’ প্রত্যাবর্তনের পূর্বাভাস দিচ্ছেন। জীবাশ্ম জ্বালানির প্রতি ট্রাম্পের স্পষ্ট সমর্থন আমেরিকার নির্গমন হ্রাসের পথ এবং দূষণহীন শক্তি উদ্যোগে তাঁর বিনিয়োগকে সম্ভাব্য ভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
নতুন প্রশাসনের অধীনে বহুপাক্ষিকতা আরও পঙ্গু হয়ে পড়তে পারে। জানা গিয়েছে, ট্রাম্পের লক্ষ্য হল বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো বহুপাক্ষিক সংস্থা এবং উন্নয়ন অর্থ সংস্থানগুলিতে (ডিএফআই) মার্কিন তহবিলের পরিমাণ কমানো বা প্রত্যাহার করা। পরিবর্তে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী পক্ষ’ বা সংস্থাগুলিকে এড়িয়ে গিয়ে একতরফা ভাবে মানবিক বা অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার সুযোগ খুঁজে নেবে, যা বৃহত্তর মার্কিন স্বার্থের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ না-ও হতে পারে।
ট্রাম্পের লক্ষ্য হল বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো বহুপাক্ষিক সংস্থা এবং উন্নয়ন অর্থ সংস্থানগুলিতে (ডিএফআই) মার্কিন তহবিলের পরিমাণ কমানো বা প্রত্যাহার করা।
এটি সেই সকল বহুপাক্ষিক, ক্ষুদ্রপাক্ষিক এবং সমষ্টিগত অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর উপর বিপর্যয়ের ছায়া ফেলবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজে যেগুলির অংশীদার। যেমন ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ-ইকোনমিক করিডোর (আইএমইসি), ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রসপারিটি (আইপিইএফ), আইটুউটু (ভারত, ইজরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং কোয়াড (অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)। ভারতের জি২০ সভাপতিত্বের সময় অনেক ধুমধাম করে ঘোষণা করা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের কারণে আইএমইসি-র ভবিষ্যৎ স্থবির হয়ে পড়ে। এই করিডোরের অর্থায়নের উপর একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন রয়ে গিয়েছে। ট্রাম্পের কঠোর ত্রাণ আইন এবং বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাগুলি অসুবিধা বাড়িয়ে তুলবে।
গ্লোবাল সাউথের উপর ট্রাম্পের আধিপত্য?
ভারত এবং বৃহত্তর গ্লোবাল সাউথের জন্য ট্রাম্প ২.০ প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলিকে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। ট্রাম্পের ক্যাবিনেট নির্বাচন চিন-বিরোধী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হলেও বিশ্বব্যাপী সংহতি জোরদার করার বিষয়ে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি মূলত বেজিংয়ের সঙ্গে তার প্রতিযোগিতা তীব্র করার উপর নির্ভরশীল। স্বাভাবিক ভাবেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ভাবে চিনকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করতে পারে। ভারতের জন্য অবশ্য একই রকমের কাজ করা কঠিন। ভারত চিনের সঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ স্থলসীমান্ত ভাগ করে নেয় এবং বেজিংয়ের অর্থনৈতিক শক্তির চাপ অনুভব করে। এই প্রেক্ষিতে চিন সংক্রান্ত ট্রাম্পের কড়া অবস্থান ভারতের পক্ষে লাভজনক হতে পারে, যেহেতু দেশটি তার উত্পাদন, ডিজিটাল, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য লড়াই করছে। উপরন্তু, দক্ষিণ চিন সাগরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে — বেজিং সমুদ্রের তলদেশে কেব্ল অবকাঠামো এবং দুর্লভ খনিজগুলির নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে, সাইবার নিরাপত্তা লঙ্ঘন করছে এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর (বিআরআই) অধীনে বড় আকারের অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। যাই হোক, এ কথা বোঝা জরুরি যে, ইন্দো-প্যাসিফিকের সম্মুখীন চ্যালেঞ্জগুলি বহুমুখী, যা উন্নয়নমূলক ও নিরাপত্তা বাধাগুলির সংমিশ্রণকেই দর্শায়। পূর্বোক্ত সমস্যাটি ট্রাম্পের কর্মসূচিতে নিশ্চিত ভাবে অগ্রাধিকার পেলেও ইন্দো-প্যাসিফিকের সমস্যা তেমন গুরুত্ব না-ও পেতে পারে। বিশ্ব যখন ২০৩০ সালের সময়সীমার দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন গ্লোবাল সাউথ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছ থেকে বিশেষ প্রত্যাশা না-ও করতে পারে। বরং গ্লোবাল সাউথ আগামী বছরগুলিতে ট্রাম্পের পদক্ষেপের উপর কড়া নজর রাখবে।
স্বাতী প্রভু অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সেন্টার ফর নিউ ইকোনমিক ডিপ্লোমেসির অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.