Published on Dec 30, 2024 Updated 0 Hours ago

চার সত্তরোর্ধ্ব নেতা অর্থাৎ ট্রাম্প, পুতিন, শি এবং মোদী আগামী বারো মাসে ভূ-রাজনীতি পুনর্বিবেচনা করবেন

২০২৫ সাল থেকে কী আশা করা যায়: সম্ভাব্য শান্তির জন্য উন্মুক্ত আলোচনা

গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি বা মহান কৌশলের ভাষায় ২০২৫ সালটি এমন এক বছর হতে চলেছে, যেখানে বৃহৎ এবং উদীয়মান শক্তিগুলি তাদের তরফে লক্ষ্যে অবিচল থাকবে (মূল জাতীয় লক্ষ্যগুলি), তাদের ‘সম্পদ ভাণ্ডারে’ গতিশীলতা বজায় রাখবে (যে সব সম্পদ এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন) এবং তাদের ‘পথ’কে (জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ) কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততায় এক নিশ্চিত পরিবর্তন আনবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রণা যখন গড়পড়তা নাগরিকেজীবনে প্রবেশ করেছে এবং এই সব কিছুই যখন মানবিক সঙ্কটের দিকে চালিত করেছে ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দিয়েছে, তখন যুদ্ধরত নেতাদের প্রবৃত্তি সমন্বয়মূলক না হলেও অন্ততপক্ষে কম সংঘাতমূলক হবেযাই হোক, আগ্রাসনের চাপানউতোরকে সামাল দিতে এবং সামরিক বিপর্যয়ের সম্মুখে নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষা করতে এই নেতাদের কৌশলগত সৃজনশীলতার প্রয়োজন হবে। বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে আলোচনার পরিবর্তে আগ্নেয়াস্ত্রের অধিক ব্যবহার প্রত্যক্ষ করা গেলেও দ্বিতীয় তৃতীয় ত্রৈমাসিকে শান্তির সবুজ চারা অঙ্কুরিত হবে। বছরের শেষ ত্রৈমাসিকে শান্তি, অর্থনীতি এবং বাণিজ্যের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একটি নতুন স্বাভাবিকের ভিত্তি স্থাপন করবে।

বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে আলোচনার পরিবর্তে আগ্নেয়াস্ত্রের অধিক ব্যবহার প্রত্যক্ষ করা গেলেও দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ ত্রৈমাসিকে শান্তির সবুজ চারা অঙ্কুরিত হবে

বৃহত্তর প্রেক্ষিতে সামনের বছরটি চার সত্তরোর্ধ্ব নেতার মধ্যে আলোচনার বছর হতে চলেছে। তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গণতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৭৮ বছর বয়সি ডোনাল্ড জে ট্রাম্প কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির উপর জোর দিয়ে অভ্যন্তরীণ ভাবে নতুন ভিত্তি স্থাপন করবেন। এমনটা করার জন্য তিনি কাজে লাগাবেন একটি কম নিয়ন্ত্রিত, অথচ দক্ষতর অর্থনীতিকে, যখন তিনি দেশের সীমানার বাইরে এক কম হিংস্র বিশ্বের জন্য লড়াইয়ে নামবেন। সম্পদ অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশের প্রধান হিসাবে ৭২ বছর বয়সি ভ্লাদিমির পুতিন – নিজের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০তম বর্ষ পালন করছেন - আধিপত্য বিস্তার এবং কৌশলগত প্রত্যাহারের মিশ্রণের মাধ্যমে সাফল্যকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করে আঞ্চলিক সম্প্রসারণ হিসেবি ছাড়ের একটি জটিল কৌশল প্রয়োগ করবেন। সর্ববৃহৎ কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৭১ বছর বয়সি শি জিনপিং বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক আগ্রাসন হ্রাস করবেন এবং অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের দিকে মনোযোগ দেবেন। বিশ্বের বৃহত্তম দ্রুত ক্রমবর্ধমান গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ৭৪ বছর বয়সি নরেন্দ্র মোদী ভারতের বৃদ্ধির গতি বজায় রেখে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ব্যবহার করে বৃহত্তর সভ্যতার অভিমুখে তিনটি বৃহৎ শক্তির মাঝে আলোচনার সেতু নির্মাণ করতে সাহায্য করবেন।

আগামী ১২ মাসের মধ্যে বেশিরভাগ বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারে এ হেন ধারণা হোয়াইট হাউস থেকে প্রবাহিত হবে, যেখানে ট্রাম্পের মার্কিন প্রেসিডেন্সি দেশটির অতি বামপন্থী অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নীতিগুলিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। ট্রাম্প বহির্বিশ্বের যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে সমর্থ হতে পারেন। এই দুই-ই বিশ্বকে প্রভাবিত করবে। যুদ্ধের সমাপ্তি আমেরিকাকে আবার মহান করে তোলা সম্পর্কে তাঁর ঘোষণাগুলি বাগাড়ম্বরপূর্ণ, চমকপ্রদ এবং উচ্চকিত শোনালেও এটি তাঁর দর কষাকষির কৌশল; যা ট্রাম্পকে নিজের জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। ট্রাম্প বিধ্বস্ত ও সমাপ্তির জন্য মুখিয়ে থাকা যুদ্ধরত শক্তিগুলির সমীকরণে প্রবেশ করবেন এবং ক্লান্ত যোদ্ধাদের শান্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষার শূন্য স্থান পূরণ করবেন। ট্রাম্পের দক্ষতা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশেষ ভাবে পরীক্ষিত হবে, যেখানে তাঁকে নর্থ আটল্যান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (ন্যাটো) সম্প্রসারণের সমাপ্তি ঘটাতে হবে। এর পাশাপাশি ইরানি প্রক্সিদের সঙ্গে রায়েলের যুদ্ধে তাঁকে অনুরোধ-উপরোধ হুমকির মিশ্র পন্থা ব্যবহার করতে হবে। এ সব কিছুই স্বল্প মেয়াদে এক অস্থায়ী ঝলমলে শান্তির জন্ম দেবে, যা আগামিদিনে বৃহত্তর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারে।

বিশ্বের বৃহত্তম দ্রুত ক্রমবর্ধমান গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ৭৪ বছর বয়সি নরেন্দ্র মোদী ভারতের বৃদ্ধির গতি বজায় রেখে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ব্যবহার করে বৃহত্তর সভ্যতার অভিমুখে তিনটি বৃহৎ শক্তির মাঝে আলোচনার সেতু নির্মাণ করতে সাহায্য করবেন।

আমেরিকাকে আবার মহান করে তোলার লক্ষ্যে ট্রাম্প লন মাস্ক বিবেক রামস্বামীর তরফে দু’টি বড়সড় পদক্ষেপের উপরে নির্ভর করে রয়েছেন এবং সেগুলি হল সরকারি ব্যয় এবং বেসরকারি খাতের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণমুক্তকরণ। দুই পদক্ষেপই দেশের কাজে লাগবে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পুঁজিকে প্রভাবিত করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু এক দিকে ব্যবসা করার জন্য আরও সহজ ক্ষেত্র হয়ে উঠছে, তাই সেটি বিশ্বের বৃহত্তম বাজার হিসেবে উন্নত মেধা, পুঁজি সম্পদ সৃষ্টিকারীদের আকর্ষণ করবে। এটি ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতির উপর তার প্রাচীন নিয়ন্ত্রণমূলক অবকাঠামোর দ্রুত গতিতে সংস্কার করার জন্য চাপ সৃষ্টি করবেতবে সম্ভবত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) উপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করবে, যারা বাহুল্য খর্ব করার ক্ষেত্রে আরও বেশি অনিচ্ছুক। ট্রাম্প চি, কানাডা এবং মেক্সিকোর উপর শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছেন। ভারত আলাপ-আলোচনার জন্য প্রস্তুত। বাকি সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে এর ফলে মার্কিন অর্থনীতিতে মূল্য বৃদ্ধি পাবে, যার দরুন আগামী বারো মাসে উচ্চ মূল্যের দিকে চালিত করবে এবং সুদের হার হ্রাস রোধ করবে। ট্রাম্প মার্কিনদের পকেটে অর্থ সরবরাহে ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি এক হতাশাজনক নির্বাচনের দিকে চালিত করবে। কারণ মার্কিনরা ইতিমধ্যে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ভারে কাবু।

বেজিংকে - যেটি সাম্প্রতিক মাসগুলিতে একটি আত্মরক্ষামূলক ভঙ্গি গ্রহণ করেছে – আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সাপ-সিঁড়ির খেলা শুরু করতে হবে। আগ্রাসনকে স্বাভাবিক রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাপ্রবৃদ্ধি, বাণিজ্য এবং জিডিপি আঞ্চলিক লালসাকে হাতিয়ার করে বিশ্ব শাসনের চিনা স্বপ্ন - যেমন দক্ষিণ চিন সাগরে দেখা গিয়েছে - গত পাঁচ বছরকে সংজ্ঞায়িত করেছে। একটি শ্লথ অর্থনীতি, রিয়েল এস্টেট সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণার ভেঙে পড়া এবং আন্তর্জাতিক ভাবে সস্তা উৎপাদনের বিকল্প খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে ভিয়েতনাম বা ভারতের মতো দেশগুলির প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ চিনকে প্রভাবিত করবে। এমনকি তাইওয়ান দখলের সম্ভাব্য চেষ্টা সর্বোত্তম ভাবে বাগাড়ম্বরই থেকেছে এবং সবচেয়ে খারাপ অর্থে সকলের শ্যেন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ট্রাম্পের সম্ভাব্য শুল্ক যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সরাসরি ভূ-অর্থনীতির লড়াইয়ে বেজিং ইতিমধ্যে ৩৩টি আফ্রিকান দেশকে শূন্য-শুল্ক নীতির লোভ দেখিয়েছে, যা দেশগুলিকে নিজেদের পণ্যের ১০০ শতাংশ শুল্ক মুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়ার সুযোগ করে দেবে। কেউ বিশ্বাস করে না যে, এই ব্যবস্থা স্থিতিশীল হবে। বরং ২০২৫ সালের প্রথম দুই ত্রৈমাসিকে এই পদক্ষেপের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিগ্লোবালাইজেশন বা অ-বিশ্বায়নের সঙ্গে চিনা প্রকৃতির বিশ্বায়নের দ্বন্দ্ব শুরু হবে।

দক্ষিণ চিন সাগরে বিশেষ করে ফিলিপিন্সে শি-র সামরিক আগ্রাসন আপাতত হ্রাস পাবে। নিজের বিশ্বের উপর আধিপত্য চালানোর মহৎ কৌশল অপ্রত্যাশিত হামলা থেকে শান্ত আলাপ-আলোচনায় পর্যবসিত হলেও নিয়ন্ত্রণের নতুন ক্ষেত্রগুলিতে, বিশেষ করে মহাসাগরগুলিতে, চিনের নিরলস সাধনা অব্যাহত থাকবে কারণ চিন সমুদ্রতলের খনির গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থগুলিকে ব্যবহার করে এবং এ ক্ষেত্রে একটি নিয়ম প্রণেতার ভূমিকায় রয়েছে। ভারতীয় সীমান্তে অসম্পৃক্ততার শি-র সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলি শান্তি এবং ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ও উড়ান চলাচলের লক্ষ্যে তাঁর গৃহীত প্রথম পদক্ষেপ এই কৌশলের দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, বিক্রির বিকল্প বাজার হিসেবে ভারতে অর্থনৈতিক স্থানান্তর এবং সেখান থেকে রফতানি করার জন্য একটি উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা। এবং দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক-কৌশলগত পরিবর্তনের সূচনা করা, যে পরিবর্তনে পৃথিবীর দুই বৃহত্তর গণতন্ত্র আরও কাছাকাছি আসবে, যখন ঠুঁটো জগন্নাথ বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পকে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। ২০২৪ সালের শেষ ত্রৈমাসিক ইতিমধ্যেই অসম্পৃক্ততার সাক্ষী থেকেছে২০২৫ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকেও অসম্পৃক্ততার ধারা বজায় থাকবে। যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে এবং শি-র দ্বিমুখী মেজাজের পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে থাকে, তা হলে ২০২৬ সালের মধ্যে সরাসরি ভারত-চিন উড়ান চালু হওয়ার পাশাপাশি বৃহত্তর বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পথ খুলে যেতে পারে।

ট্রাম্পের সম্ভাব্য শুল্ক যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সরাসরি ভূ- অর্থনীতির লড়াইয়ে বেজিং ইতিমধ্যে ৩৩টি আফ্রিকান দেশকে শূন্য-শুল্ক নীতির লোভ দেখিয়েছে, যা দেশগুলিকে নিজেদের পণ্যের ১০০ শতাংশ শুল্ক মুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়ার সুযোগ করে দেবে।

রুশ ফেডারেশনের কৌশলগত প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব হিসাবে নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখতে পুতিন তিনটি অ্যাকশন পয়েন্ট বা কার্যকরী বিন্দু স্থির করেছেন। প্রথমত, তিনি আক্রমণ করেছেন এবং ইউক্রেনের ১২০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল নিজের নিয়ন্ত্রণে এনেছেন, যার অধিকার তিনি ছাড়বেন না। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন যদি রাশিয়ার অভ্যন্তরে গভীর ভাবে আঘাত হানতে মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করে, তবে তিনি পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে খুব বেশি খতিয়ে না দেখে নিম্ন থ্রেশহোল্ডের ঘোষণা করেছেন। এবং তৃতীয়ত, তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে, উক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান এমন একটি বিপদরেখা, যা অতিক্রম করা উচিত নয়। ট্রাম্প এ সব কিছুই শুনেছেন। মস্কোর তরফে ভূখণ্ড অর্জনের মাধ্যমে কিয়েভের সঙ্গে স্থিতাবস্থা ও যুদ্ধের সমাপ্তি সম্ভাব্য বলে মনে হচ্ছে। এ জন্য পুতিন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির চেয়ে বেশি প্রস্তুত বলে মনে করছেন। যদি ইউক্রেন মার্কিন অস্ত্র সমর্থন না পায় বা একটি ধীর ও ক্রমশ মন্দার অর্থনীতির প্রেক্ষিতে যদি ইইউ-র সদস্য দেশগুলিকে অর্থ প্রদান করতে হয়, তা হলে যুদ্ধ শেষ করার চাপ বৃদ্ধি পাবে। কিয়েভ একটি অস্বস্তিকর শান্তি মেনে নিতে বাধ্য হবে। এটি অসন্তোষের জন্ম দেবে। এই অবস্থান কিয়েভের জন্য অন্যায্য বলে মনে হলেও সামগ্রিক ভাবে ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ইউক্রেন পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি-সহ শান্তি সেতু নির্মাণের কাজটি ২০২৫ সালের মাঝামাঝি থেকে শেষের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে।

শান্তি আলোচনার অংশ হিসাবে, পুতিন ইইউ, সংযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র (ইউকে), কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে লা হুলপে-সদর দফতর সুইফট দ্বারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ২০২২ সালের মার্চ মাসে জারি করা নিষেধাজ্ঞার অবসানের দাবি জানাবেন। এটি নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থার একটি ব্যাপক লঙ্ঘন, যা রুশ ব্যাঙ্কগুলিকে সুইফট অবকাঠামো থেকে বের করে দিয়েছে এবং এই পদক্ষেপ বিশ্বের অর্থপ্রদানকারী শৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান পশ্চিমী সরকারগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে এই আলাপ-আলোচনা স্বাভাবিকতার দিকে চালিত করবে, এমনকি অন্য দেশগুলিকে বেজিং দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় এমন একটি বিকল্প অর্থপ্রদানের ব্যবস্থা সম্পর্কে ভাবতে আলোচনা করতে বাধ্য করবে। পুতিন পশ্চিমী শক্তি দ্বারা বর্তমানে স্থগিত রাখা ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের রাশিয়ান সম্পদগুলিকে মুক্ত করার দাবি জানাবেন, যদিও তিনি সেই অর্থের উপর অর্জিত বিলিয়ন মার্কিন ডলার বার্ষিক সুদের অংশ ছেড়ে দিতে পারেন।

মোদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া উভয়ের সাথে গত পাঁচ থেকে সাত বছরে নির্মিত কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে আস্থার অংশীদারিত্ব তৈরি করেছেন।

অবশেষে, নয়াদিল্লি ২০২৫ সালে আন্তর্জাতিক কার্যক্রমে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে থাকবে ভারত শুধুমাত্র বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল বৃহৎ অর্থনীতি হয়েই উঠবে না – যেখানে আগামী ১২ মাসে নামমাত্র জিডিপিতে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগ হতে পারে – বরং ভারত ভূ-রাজনীতি ও নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মোদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া উভয়ের সাথে গত পাঁচ থেকে সাত বছরে নির্মিত কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে আস্থার অংশীদারিত্ব তৈরি করেছেন। তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইরায়েল-হামাস-হিজবুল্লাহ উভয় যুদ্ধেই শান্তির আখ্যানের পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন। 

এই কথাকে কাজে রূপান্তর করা সরলরৈখিক না-ও হতে পারে। পুতিন এবং বাইডেন উভয়েই তাঁদের দৃঢ় অবস্থানের জন্য নিন্দিত হলেও মোদী উভয়ের সঙ্গে কথোপকথন এবং কূটনীতির সেতু তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। এটি ২০২৫ সালেও অব্যাহত থাকবে। অবশ্যই, ট্রাম্পের নিজস্ব মন শৈলী থাকলেও পুতিন কৌশলগত ব্যক্তিত্বই থাকবেন। খুব বেশি হলে, মোদী পশ্চিমের সঙ্গে পুতিনের স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তিতে আলাপ-আলোচনার পথ প্রশস্ত করতে পারেন। রায়েলের প্রসঙ্গে মোদী আবার পশ্চিম এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তুলেছেন। তবে এই অবস্থান নিছক রাজনৈতিক বা কৌশলগতই নয় এবং এগুলি ধর্মীয় উচ্ছ্বাস অস্তিত্বের হুমকি দ্বারা জর্জরিত। মোদীর পক্ষে সক্রিয় আলাপ-আলোচনার পথ থেকে সরে না এসে যুদ্ধবিহীন নৈতিক সমর্থন প্রদান করা সর্বোত্তম পন্থা হতে পারে। তাঁর উচিত ট্রাম্প, রায়েলের প্রাইম মিনিস্টার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেইনিকে তাঁদের শান্তি চুক্তিকে বাধ্য করা, যা শুরু হবে রায়েলি বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে।

এই চুক্তির বাইরে নয়াদিল্লি ২০২৫ সালে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে বাণিজ্যের, বিশেষ করে জ্বালানির ক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করবে। এ ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি কৌশলগত সহযোগিতা জোরদার হবে। পূর্ব প্রান্তে কোয়াডে ভারতের অংশগ্রহণ নিরাপত্তার গতি বৃদ্ধি করবেসর্বোপরি, ট্রাম্প উন্নত নিরাপত্তার জন্য অর্থনৈতিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত। উদাহরণস্বরূপ, মেক্সিকো কানাডার প্রতি তাঁর সাম্প্রতিক বার্তা হল অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করা এবং সেই দেশগুলির সীমান্ত থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাদক, বিশেষ করে ফেন্টানাইলের প্রবেশ বন্ধ করা। এর বিনিময়ে ট্রাম্প তাদের সমস্ত পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ শুল্কের অবসান ঘটাবেন।

মোদীর উচিত শ্রম, সম্মতি, জমি এবং কৃষির মতো অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলির সমাধান করা, যার মধ্যে প্রথম দুটি সম্ভব হলেও শেষ দুটি সৃজনশীল সংযোগ প্রয়োজন

সুতরাং, নয়াদিল্লি ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকতে প্রস্তুত হলেও, মোদী শুল্কের ভূ-অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে একটি চুক্তিতে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভারতের ভূ-রাজনৈতিক সুবিধাকে ব্যবহার করতে পারেন এবং অবশ্যই পারেন। একই সঙ্গে তাঁকে ভবিষ্যতের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য ভারতের বৃদ্ধিকে কাজে লাগাতে হবে। যে সমস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা ভারতকে আগামী দুই বা তিন বছরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ২০৩২ সালের মধ্যে ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের মহাশক্তি রূপে বিবেচনা করে, তারা এই অর্থনীতিতে অংশ নিতে চাইবেট্রাম্প-মোদী আলাপ-আলোচনা এই সব কিছুকেই সক্ষম করবে। সর্বোপরি, মোদীর উচিত শ্রম, সম্মতি, জমি এবং কৃষির মতো অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলির সমাধান করা, যার মধ্যে প্রথম দুটি সম্ভব হলেও শেষ দুটি সৃজনশীল সংযোগ প্রয়োজন

বেজিংয়ের আগ্রাসন ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ইউক্রেনে মস্কোর আগ্রাসন ২০২২ সালে শুরু হয়েছিল এবং তা অব্যাহত রয়েছে হামাস হিজবুল্লাহ দ্বারা ইজরায়েলের উপর সন্ত্রাসবাদী হামলা এবং তেল আভিভের তরফে তার প্রত্যুত্তর ২০২৩ সালে আলোচনার শীর্ষে থেকেছে এবং এখনও তা কমেনি। অস্থির ওয়াশিংটন পশ্চাদপসরণকারী বেজিং ২০২৪ সালকে আকার দেবে। এবং একটি সম্পূর্ণ নতুন হোয়াইট হাউস ২০২৫ সালকে পথ দেখাবে। তাই আগামী বারো মাসে কৌশলগত অর্থনৈতিক সম্প্রদায়কে ট্রাম্প, পুতিন, শি ও মোদীর মধ্যে সমীকরণ কী থাকছে, তার উপর কড়া নজর রাখতে হবে।

 


গৌতম চিকারমানে অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.