Published on Jan 08, 2024 Updated 22 Hours ago

২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করবে একটি ক্রমবর্ধমান অস্থির বিশ্ব

বিশ্ব অর্থনীতি: ২০২৪ সালে কী আশা করা যায়

এই প্রবন্ধটি "What to expect in 2024"‌–এর অংশ




২০২৪ সালে ক্রমবর্ধমান ভিইউসিএ (অস্থির, অনিশ্চিত, জটিল ও অস্পষ্ট) পৃথিবী চারটি বড় সমস্যার মুখোমুখি হবে, এবং ছয় ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপি র‌্যাঙ্কিং বিশ্ব  অর্থনীতির অবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করবে। অবস্থাটি সুখকর হবে না, মসৃণ হবে না, শান্তিপূর্ণও হবে না। অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য বৃহত্তর অধ্যবসায়ের প্রয়োজন হবে, অর্থনৈতিক শাসনের জন্য সৃজনশীল নীতির প্রয়োজন হবে, এবং রাজনৈতিক অর্থনীতিকে এই নতুন অস্বাভাবিকতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে এবং কাজ করতে হবে।

প্রথমত, ২০২৩ সালের মতো, ২০২৪ সালেও নিরাপত্তা হবে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। ২০২২ সালে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে যে অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছিল, এবং প্রবাহিত হয়েছিল ২০২৩ সালে ইজরায়েল–হামাস সংঘর্ষের দিকে, তা ২০২৪ সালেও অব্যাহত থাকবে। ইউক্রেনে আলোচনা সফল হলে হিংস্রতার ভূগোল পশ্চিম এশিয়ায় স্থানান্তরিত হবে, এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার আগুন জ্বালাবে; আলোচনা ব্যর্থ হলে, অস্থিরতা প্রসারিত হবে। ফলস্বরূপ, পণ্যমূল্য, বিশেষ করে তেলের দাম অস্থির থাকবে। অর্থাৎ, যদি শান্তি অধরা থাকে, তাহলে জ্বালানির দাম একটা জায়গা পর্যন্ত বাড়বে; আর যখন এর ফলে মূল্যস্ফীতি ও মন্দা আসবে, তখন সেগুলির দাম পড়ে যাবে। তেল–উৎপাদনকারী ও তেল–ভোক্তা, উভয় অর্থনীতিই সূক্ষ্ম দড়ির উপর থাকবে। খাদ্য ও সারের মূল্যের অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকবে। ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন, গৃহস্থালি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এবং সরকারগুলি বৃদ্ধি ও দামের ভারসাম্য বজায় রাখতে কঠোর চাপের মধ্যে পড়বে। এর প্রভাব পড়বে দেশীয় রাজনীতিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাগুলি কীভাবে শিথিল করবে এবং এর ফলে বিশ্বব্যাপী তেল ও গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির উপর কী প্রভাব পড়বে, তা দেখা বাকি রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, তেল, খাদ্য ও সারের অনিশ্চয়তা অন্যান্য পণ্যের উপর প্রভাব ফেলবে এবং বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করবে। কিছু দেশে, যেমন তুর্কিয়ে (
৮৬ শতাংশ), ইরান (৪০ শতাংশ) ও পাকিস্তান (২৯ শতাংশ) ২০২৪ সালে দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে, কারণ অর্থনৈতিক ভিত্তি ক্ষমতার আধিপত্য ও মতাদর্শগত বিবেচনার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেনেজুয়েলা (৩১৮ শতাংশ) তার মুদ্রাস্ফীতি চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। ২০২২ সালে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর যে সমস্ত দেশ গ্যাসের ধাক্কার মুখোমুখি হয়েছিল, যারা সকলেই ইউরোপের, তারা একটি নতুন স্বাভাবিক অবস্থায় পৌঁছেছে এবং উচ্চ মূল্যভিত্তির প্রেক্ষিতে সেখানে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে, ২০২৪ সাল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি সংক্রান্ত  অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকবে, যদিও তেল রপ্তানিকারক দেশগুলির জন্য ইজরায়েল–হামাস দ্বন্দ্ব কীভাবে কার্যকর হয় তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।

তৃতীয়ত, বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতির এবং বিশেষ করে তেলের দামের অস্থিরতার পাশাপাশি সুদের হার বাড়বে এবং কমবে। আরও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নীতিগত হারকে উচ্চ (এখন ৫.৫ শতাংশ, যা মার্চ ২০২২–এ ১ শতাংশের কম ছিল) রাখার ফলে অন্য দেশগুলির উপর তালমিল রাখার চাপ থাকবে, যেমন ভারত, যেখানে নীতিগত হার দাঁড়িয়েছে
৬.৫ শতাংশ ৷ কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতিগুলির জন্য আরও খারাপ খবর আছে। সুদের হার তুর্কিয়েতে ৩০ শতাংশ, পাকিস্তানে ২২ শতাংশ এবং ইরানে ১৮ শতাংশে উঠে গিয়েছে। যুদ্ধচালিত বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার স্থিরভাবে না কমলে, যা নিরাপত্তার অনিশ্চয়তার কারণে মনে হয় অসম্ভব, ২০২৪ সালে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি সুদের হার বজায় রেখে বা বাড়িয়ে দৃঢ় ব্যবস্থা নেবে। মূল্যস্ফীতির অনিশ্চয়তা সুদের হারের অস্থিরতাকে প্রভাবিত করবে।

এটি ব্যবসার ক্ষমতার উপর চাপ সৃষ্টি করবে, বিশেষ করে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ছোট ও মাঝারি আকারের উদ্যোগগুলির উপর। বড় ঋণ প্রবাহিত হবে বড় কর্পোরেশনের দিকে, কারণ ব্যাঙ্কগুলি ঝুঁকিবিমুখ হয়ে উঠবে এবং চাইবে শোধ করার মতো আয়তন,  ক্ষমতা এবং ঋণকে সমর্থন করার জন্য জামানত। ছোট ব্যবসাগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বেকারত্বের মতো সম্পর্কিত রাজনৈতিক সমস্যাগুলি উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চমূল্যের অর্থনীতিতে মাথা চারা দিতে পারে। গণতন্ত্র খারাপ রাজনীতি পরিহার করতে শুরু করবে, এবং ভাল অর্থনীতিকে আলিঙ্গন করবে; কর্তৃত্ববাদী শাসন নতুন শত্রু তৈরি করবে এবং তাদের নাগরিকদের বাড়তি অর্থনৈতিক কষ্ট সহ্য করতে চাপ দেবে। অনেক দেশ তাদের মুদ্রার বাজার–নেতৃত্বাধীন অবমূল্যায়ন, বা এমনকি নীতিচালিত অবমূল্যায়ন, দেখতে পাবে। এইভাবে, ২০২৪ কিছু অর্থনীতিতে শ্লথতা বা এমনকি মন্দা দেখতে পারে।

অবশেষে, চিনের থেকে ঝুঁকিমুক্ত করার বিষয়ে কথোপকথন, যা গত দুই বছরে পিছনে চলে গিয়েছে, তা ২০২৪ সালে ফিরে আসবে। এইবার উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, পাকিস্তান ও ইরানকে ঘিরে রাখা চিনের চাপকে অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনাটি বিস্তৃত হবে।  যেহেতু তারা শ্লথতা এবং এমনকি মন্দার মুখোমুখি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলি চিনের সঙ্গে ‘‌হ্যাঁ, তবে’‌ খেলতে থাকবে। এবং ভারতীয় ও চিনা সৈন্যরা সীমান্তে চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নীতি দিয়ে যবনিকা না–ফেলা পর্যন্ত অস্থিতিশীল ভারত–চিন বাণিজ্য চিনের পক্ষে ঝুঁকে থাকবে। একটি রিয়েল এস্টেট সংকটের নেতৃত্বে চিনে শ্লথতা দৃশ্যমান এবং ঘটমান; এর ২০২৪ সালের প্রকৃত বৃদ্ধি
৪.২ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ০.২ শতাংশে অনুমান করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে এবং নমিনাল টার্মে, ১৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে ৪.৪ শতাংশ বৃদ্ধি প্রায় ৮০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগ করবে, যা কিনা ৩.৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতিসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৭ ট্রিলিয়ন অর্থনীতি র ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনার  প্রায় ৫৬ শতাংশ। 

এই চারটি উপাদান ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করবে। বিশেষ করে, এটি ৬ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি র‌্যাঙ্কিং পরিবর্তন করবে। ইয়েনের মূল্য ব্যাপকভাবে পড়ে গিয়েছে — ২০২৩ সালে ১৮ শতাংশ এবং ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ৪৫ শতাংশ কমেছে। জার্মানি ২০২৪ সালে জাপানকে অতিক্রম করে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে৷ আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডারের মতে, জাপানের জিডিপি যা ২০১২ সালে ৬.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল, তা ২০২৩ সালে আনুমানিক
৪.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে, এবং জার্মানির ৪.৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। ভারত ২০২৫ সালের মধ্যে উভয়কেই অতিক্রম করবে৷ ২০২৪ সালের র‌্যাঙ্কিংয়ে অন্য বড় পরিবর্তনগুলি হবে দক্ষিণ কোরিয়া (১.৭১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার) অস্ট্রেলিয়াকে (১.৬৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার) ছাড়িয়ে দ্বাদশ স্থানে, এবং নেদারল্যান্ডস (১.০৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার) সৌদি আরবকে (১.০৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার) ছাড়িয়ে ১৭তম স্থানে উঠে আসবে। ইন্দোনেশিয়াকে, যে দেশটি ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ৫ শতাংশ করে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে, স্পেনকে ছাড়িয়ে ১৫তম স্থানে পৌঁছতে ২০২৫ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

নিরাপত্তা, নিষেধাজ্ঞা ও সরবরাহ শৃঙ্খলের আন্তঃপ্রক্রিয়ার সঙ্গে পণ্য, কোম্পানি এবং দেশগুলির পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ২০২৩ সালে একটি জটিল খেলায় পরিণত হয়েছিল। উপায় বা লক্ষ্য হিসাবে একটি নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের বিপদ, সহযোগিতার নতুন অক্ষের সৃষ্টি, এবং শান্তির বিলুপ্তি গত দুই বছরে বিশ্বের প্রতিটি নাগরিককে বিরূপভাবে প্রভাবিত করেছে। আমরা হয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন নিরাপত্তার অস্থিরতার দিকে ফিরে যাব, অথবা এমন নেতা খুঁজে পাব যাঁরা নতুন ধারণা গ্রহণ করতে পারেন এবং পৃথিবীকে একটি উদীয়মান বহুমেরু বিশ্বে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হবেন, এবং নতুন শান্তি আনতে পারবেন, তা ‌সে যতই ভঙ্গুর হোক না কেন। এটি একটি নির্ণায়ক হবে যা ২০২৪ এবং তার পরে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। ততক্ষণ পর্যন্ত, ভিইউসিএ আলিঙ্গন করাই হবে একমাত্র ধ্রুবক এবং একমাত্র দৃষ্টান্ত, যার মধ্যে পরবর্তী ১২ মাস কাজ করতে হবে।



গৌতম চিকারমানে অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.