৭ মে সৌদি আরবের বিদেশমন্ত্রক একটি নিন্দা-বিবৃতি প্রকাশ করে যখন ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী ফিলিস্তিনি শহর রাফার উপর আক্রমণ চালায় – যেটি এখন গাজার মানুষদের জন্য তুলনামূলক ভাবে শেষ ‘নিরাপদ’ আশ্রয় বলে পরিচিত। সৌদি আরবের বিবৃতিতে ‘ইজরায়েলের যুদ্ধ মেশিন’ দ্বারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে এবং আরও এক ধাপ এগিয়ে ইজরায়েলি পদক্ষেপকে প্রথম বারের মতো ‘গণহত্যা’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গাজা যুদ্ধের বিষয়ে রিয়াধের ক্রমবর্ধমান স্পষ্টতা সত্ত্বেও রাষ্ট্রটির জন্য গত সাত মাস সময়কাল ভারসাম্যমূলক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সৌদি আরব এবং তার সর্বশক্তিমান ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বা ‘এমবিএস’-এর উপর গাজায় ইজরায়েলি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট চাপ রয়েছে এবং ইজরায়েলি পদক্ষেপের ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মারা গিয়েছেন। যাই হোক, রাখঢাক করে হলেও সৌদি নেতৃত্বের একাংশ স্বীকার করে নিয়েছে যে, ইজরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের সন্ত্রাসবাদী হামলা উল্লেখযোগ্য বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। প্রকৃতপক্ষে, বেশিরভাগ না হলেও এই অঞ্চলের বেশ কিছু আরব রাষ্ট্র হামাসের বিলুপ্তি দেখতে চায়। ৭ অক্টোবরের হামলার আগে - হামাস সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত ইজরায়েলিদের আটক করে রেখেছে - সৌদিরা ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আলোচনা চালিয়ে এসেছে। আরও বিস্তৃত রিয়াধ-ওয়াশিংটন নিরাপত্তা চুক্তির বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিটির ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে। আঁতাতের মাধ্যমে অর্জিত এই আঞ্চলিক চুক্তিগুলি মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিকে নতুন আকার দিতে পারে।
সৌদি নীরবতার মর্মোদ্ধার
ইরান এবং ইজরায়েলের পাশাপাশি এই অঞ্চলে শক্তির একটি প্রধান মেরু হিসাবে সৌদি আরবের অবস্থান সুস্পষ্ট হলেও বিদ্যমান গাজা সংঘাতের বিষয়ে দেশটি শুধুমাত্র সীমিত কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা দর্শিয়েছে। ইরানের ইস্ফাহানে পরমাণু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক প্রথম সম্মেলনে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক উপস্থিতি দর্শায় যে রিয়াধ আঞ্চলিক বিবাদ প্রতিরোধে ভূমিকা নিতে প্রস্তুত। কিন্তু সৌদি আরব একতরফা ভাবে বৃহত্তর ইজরায়েল-ইরান সংঘর্ষে অংশ নেবে না, যতক্ষণ না তার নিজস্ব সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়। প্রসঙ্গত, ইস্ফাহান সেই শহর, যেখানে সৌদি রাষ্ট্রদূতের সফরের মাত্র কয়েক দিন আগে ইজরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা আক্রমণ চালানো হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, পরমাণু বিষয়ক ইরানের আয়াতোল্লা মোহাম্মদ ইসলামি ইস্ফাহানে বলেছিলেন যে, দেশটি পারমাণবিক বিষয়ে সৌদিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।
সহজ ভাষায় বললে, পরিকল্পনাটি হল পেট্রোডলারের প্রতি তাদের অর্থনীতির আসক্তি থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং বিশ্ব হাইড্রোকার্বন থেকে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির দিকে অগ্রসর হওয়ার সময়ে জ্বালানির ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন থেকে দেশটির ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত রাখা।
সৌদি আরবের অবস্থান অনেকের কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হলেও তা খুব একটা জটিল নয়। এমবিএস-এর অধীনে, সৌদিরা রাজ্যপাটের অর্থনীতির পরিবর্তনের জন্য একটি বিস্তৃত, উচ্চাভিলাষী এবং চ্যালেঞ্জিং পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সহজ ভাষায় বললে, পরিকল্পনাটি হল পেট্রোডলারের প্রতি তাদের অর্থনীতির আসক্তি থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং বিশ্ব হাইড্রোকার্বন থেকে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির দিকে অগ্রসর হওয়ার সময়ে জ্বালানির ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন থেকে দেশটির ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত রাখা। দীর্ঘ সময় ধরে, সৌদি অর্থনীতি এবং রাজতন্ত্রের স্থিতিশীলতা তেল উৎপাদন থেকে প্রাপ্ত বিপুল অর্থ দ্বারা অর্থায়িত – যা কিনা বিশ্বে সর্বোচ্চ - এবং বিশ্বব্যাপী তেলের দামের উপর দেশটির লাগামহীন প্রভাব বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে, মে মাসের শুরুতে সৌদি আরব বিশ্বব্যাপী মূল্য ধরে রাখার প্রয়াসে এশীয় বাজারের জন্য তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ০.৯০ মার্কিন ডলার বৃদ্ধি করেছে। এই সিদ্ধান্ত এমন সময়ে সৌদি কোষাগারকে অর্থের ব্যাপক প্রবাহ আনবে, যখন একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ ঘনিয়ে আসছে এবং ওপেক-বহির্ভূত রাষ্ট্রগুলির তেল উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এমবিএস-এর একাধিক পরিকল্পনা রয়েছে
এমবিএস শত শত বিলিয়ন ডলারের পরিকাঠামো নির্মাণের নির্দেশ দিচ্ছেন, যা বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার পাশাপাশি উৎপাদন, পরিষেবা, পর্যটন, বিনোদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিকল্প শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে অর্থনীতির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনবে। সংক্ষেপে বললে, এমবিএস যা চান তা হল দুবাই বা আবুধাবির সৌদি সংস্করণ। দুবাই সম্প্রতি বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক কোটিপতিসম্পন্ন শহর হয়ে উঠেছে এবং এ হেন ৭২৫০০ জন মানুষ এমিরাতি মেট্রোপলিসকেই নিজেদের বাড়ি বলে মনে করেন। সৌদিরা এরই বিকল্প প্রস্তাব আশা করছে।
অনেকটা সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতোই সৌদি আরব আবারও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াকে তার অর্থনৈতিক লক্ষ্যের বিরোধী বলে মনে করছে। একটি অনিরাপদ, অস্থির এবং সংঘাতপ্রবণ ভৌগোলিক পরিসরে দ্রুত গতি ও বড় আকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা টিকিয়ে রাখা সহজ হবে না। সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এ ক্ষেত্রে একটি আদর্শ উদাহরণ হতে পারে। রিয়াধের মতো এমিরাতিরাও গাজা সঙ্কটের প্রতি ভারসাম্যমূলক প্রতিক্রিয়া বজায় রেখেছে। তারা ইজরায়েলের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রত্যাহার করেনি, যা আব্রাহাম চুক্তির অংশ হিসাবে ২০২০ সালে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল।
কিন্তু রিপোর্ট অনুসারে, তারা দেশে গচ্ছিত রাখা মার্কিন সামরিক সম্পদ ব্যবহারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, যা ওয়াশিংটনকে এই সামরিক সম্পদ পুনরায় কাতারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। এক দিকে থেকে এর ফলে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এ কথা নিশ্চিত করছে যে, দেশটি ইজরায়েল, ইরান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোনও সামরিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণকারী হতে চায় না।
সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এ ক্ষেত্রে একটি আদর্শ উদাহরণ হতে পারে। রিয়াধের মতো এমিরাতিরাও গাজা সঙ্কটের প্রতি ভারসাম্যমূলক প্রতিক্রিয়া বজায় রেখেছে।
সৌদিদের জন্য অবশ্য একই অবস্থান অর্জন করার বিষয়টি জটিলতর। দু’টি পবিত্র মসজিদের আবাসস্থল হওয়ার দরুন বিশ্ব জুড়ে মুসলিম জনসংখ্যা সৌদি আরবকেই আরব-বিশ্বের কেন্দ্র বলে মনে করে। এই গুরুদায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গেই আসে একগুচ্ছ প্রত্যাশা, যেগুলিকে হাউস অফ সৌদ উপেক্ষা করতে পারে না।
কিন্তু... এ এক দোলাচলের অবস্থা
ইরান যে আসলে এক শিয়া শক্তি… এই বাস্তবতা ফিলিস্তিনি জনগণকে এক স্পষ্টতর স্বর প্রদান করেছে। কারণ এটি এমন একটি বিষয় যা এমবিএস কোনও মতেই উপেক্ষা করতে পারবেন না। শুধু দেশেই নয়, মিশরের মতো অন্যান্য দেশেও মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো মতাদর্শগত আন্দোলনের বিরোধিতা করা আগামী মাসগুলিতে কঠিন কাজ হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, হামাসের নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে। কারণ এটি ফিলিস্তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের অন্যতম শাখা।
সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ আবেগ ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এবং জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা এক জটিল কাজ, যেমনটা কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া আরব বসন্তের সময় প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা এবং প্রসার এ হেন সরকারি অবস্থানের প্রচারকে কঠিন করে তুলবে, যা সম্পূর্ণ ভাবে জনগণের অনুভূতি এবং আবেগের বিপরীত, বিশেষ করে গাজার মতো প্রসঙ্গে। সৌদিরা এখনও ইজরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণের বিষয়ে আলোচনা করতে চাইলেও বিদ্যমান যুদ্ধ অদূর ভবিষ্যতে এমনটা হওয়ার বিষয়কে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। আর তাই সে দেশের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে এ হেন কড়া বিবৃতি জারি করা হয়েছে।
এমবিএস-এর নিজস্ব লক্ষ্য
অবশেষে, সৌদি আরব এবং এমবিএস-এর ভিশন ২০৩০ বিবৃতি অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চালিত হয়। এমবিএস-এর নেতৃত্ব প্রাথমিক ভাবে তাঁর পারিবারিক শ্রেণিবিন্যাস ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বারা প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। তাই তিনি যে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে ব্রতী, সে কথা প্রমাণ করার জন্য এই প্রকল্পের সাফল্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা এবং প্রসার এ হেন সরকারি অবস্থানের প্রচারকে কঠিন করে তুলবে, যা সম্পূর্ণ ভাবে জনগণের অনুভূতি এবং আবেগের বিপরীত, বিশেষ করে গাজার মতো প্রসঙ্গে।
অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাস থেকে শুরু করে ‘অতি-রক্ষণশীল’ ইসলামিক রাজতন্ত্রের ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলা পর্যন্ত… সৌদি আরবের সামনে অনেক কাজ বাকি। এই অন্বেষণগুলি প্রকৃতিগত ভাবে উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন। আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি বাহ্যিক চাপ ও মনোযোগ আকর্ষণকারী ঘটনাপ্রবাহ রিয়াধের জন্য কাজটিকে আরও কঠিন করে তুলবে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় এনডিটিভি-তে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.