উত্তর-পশ্চিম ইরানের পাহাড়ে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার একদিন পর ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এবং বিদেশমন্ত্রী হোসেন আমিরাবদুল্লাহিয়ানকে ২০ মে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং এই ঘটনা দেশটিকে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দাঁড় করিয়েছে। ২০২১ সালের জুন মাসে প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত রাইসির আকস্মিক মৃত্যু এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ঘটেছে, যা বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের (পশ্চিম এশিয়া) পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী দেশটির উত্তরাধিকারী কে হবেন এবং দেশটি তার বিদেশনীতির ক্ষেত্রে কোন কোন পরিবর্তন নিয়ে আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
রাইসির আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি অব্যাহত রয়েছে। কারণ দু’টি দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্মুখ সমরে নেমেছিল, বিশেষত ইউক্রেন, গাজা এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে বিদ্যমান সংঘাতে। এর পাশাপাশি আবার নভেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
ইরানের সংবিধানের ১৩১ অনুচ্ছেদের অধীনে, প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার সুপ্রিম লিডার আয়াতোল্লা খামেইনির অনুমোদন নিয়ে অস্থায়ী ভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও এ কথা বলা জরুরি যে, প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু ইরানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর কোনও উল্লেখযোগ্য স্বল্পমেয়াদি প্রভাব ফেলবে না। সাংবিধানিক পদ্ধতি এবং শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরবর্তী প্রেসিডেন্টের জন্য একটি মসৃণ উত্তরণের সুযোগ করে দেয়। ইরানের সংবিধানের ১৩১ অনুচ্ছেদের অধীনে, প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার সুপ্রিম লিডার আয়াতোল্লা খামেইনির অনুমোদন নিয়ে অস্থায়ী ভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেশটির গার্ডিয়ান কাউন্সিলের প্রাথমিক ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ২৮ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ইরানের আসন্ন নির্বাচন সম্ভবত আরও ঐতিহ্যবাহী রক্ষণশীল প্রার্থীদের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ তৈরি করতে পারে। রাইসিকে সর্বোচ্চ নেতা আয়া্তোল্লা খামেইনির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত একজন রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখা হত। কিন্তু এ বার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি পরিবর্তন হতে পারে, যা অন্য রক্ষণশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে যেতে এবং প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ করে দেবে। এখন কে রাইসির স্থলাভিষিক্ত হবেন, সেই প্রশ্ন ইরানের জনসাধারণের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু সম্ভাব্য প্রার্থী অবশ্য আছেন। যেমন অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার; জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রাক্তন প্রধান আলি শামখানি; পার্লামেন্টের স্পিকার মোহাম্মদ বাগের কালিবাফ; এবং ইরানের পার্লামেন্টের প্রাক্তন স্পিকার আলি লারিজানি, যিনি ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পোরালস-এর (আইআরজিসি) সঙ্গে যুক্ত। প্রতিষ্ঠান বর্তমানে রক্ষণশীল অক্ষ দ্বারা প্রভাবিত, বিশেষ করে যাঁরা সুপ্রিম লিডার এবং শক্তিশালী আইআরজিসি-র সঙ্গে সংযুক্ত। সংস্কারপন্থীদের চিত্রের ঊর্ধ্বে উঠে সম্ভাব্য ক্ষমতার লড়াই প্রাথমিক ভাবে রক্ষণশীল শিবিরের মধ্যেই হবে বলে আশা করা হচ্ছে। একটি শুধু মাত্র রক্ষণশীল দেশে মোহাম্মদ বাঘের কালিবাফ রাইসিকে প্রতিস্থাপনের জন্য শক্তিশালী প্রতিযোগী হতে পারেন। কারণ তিনি রক্ষণশীল সংস্থার মধ্যে সমর্থনের একটি শক্ত ভিত্তি বজায় রাখতে পেরেছেন।
এ বার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি পরিবর্তন হতে পারে, যা অন্যান্য রক্ষণশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে যেতে এবং প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ করে দেবে।
দীর্ঘস্থায়ী বক্তৃতা সত্ত্বেও, মূলত পশ্চিমী গণমাধ্যমে - যেখানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে – এ কথা আক্ষরিক অর্থেই প্রমাণিত হয়েছে যে, এটি একটি স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা, যার ধর্মতান্ত্রিক কাঠামো চার দশকেরও বেশি সময় ধরে অক্ষত রয়েছে। যদিও পরবর্তী নেতৃত্বে স্থানান্তরের সময় শীর্ষ পদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই হতে পারে, তবে ইরানের মৌলিক শাসক প্রতিষ্ঠানগুলি স্থিতিশীল বলে মনে হচ্ছে। সেগুলি ভেঙে পড়ার কোনও লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। আয়াতোল্লা খামেইনির নেতৃত্ব শাসনের ধারাবাহিকতা দেখা গিয়েছে ও এটি স্থিতিশীলতা প্রদান করেছে এবং সম্ভবত তাঁর নির্দেশনায় ব্যবস্থাটি বজায় থাকবে। বাহ্যিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ইসলামি প্রজাতন্ত্র তার ইতিহাস জুড়ে স্থিতিস্থাপকতা ও বিভিন্ন ঝড় মোকাবিলার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। কয়েক দশক ধরে পশ্চিমী আখ্যানে উঠে এসেছে যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র সহজেই ভেঙে পড়বে এবং একটি জন আন্দোলনের মাধ্যমে তার উৎখাত হবে। কিন্তু সমস্ত জল্পনা-কল্পনা সত্ত্বেও, এ কথা বিশেষ ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ যে, প্রেসিডেন্ট রাইসি সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা খামেইনির উত্তরসূরি হিসেবে প্রধান প্রার্থী ছিলেন না।
অভ্যন্তরীণ প্রভাব বাদ দিলে, ইরানের বিদেশনীতির সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় কিছু কৌশলগত সামঞ্জস্য দেখা গেলেও ইরানের বৈদেশিক নীতির নির্দেশক মৌলিক নীতিগুলিতে অদূর ভবিষ্যতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কৌশলগত সিদ্ধান্ত সুপ্রিম লিডার ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ দ্বারা নির্ধারিত হয়, প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে নয়। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইজরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রত প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলি, বিশেষ করে হামাস এবং হিজবুল্লাকে সম্পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রাখবে। এর অর্থ হল এই যে, দেশটির আঞ্চলিক নীতি, এই অঞ্চলে সহযোগী গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করা এবং পারমাণবিক কর্মসূচির কৌশলগুলি এমনকি নতুন প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না-ও আনতে পারে।
ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইজরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রত প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলি, বিশেষ করে হামাস এবং হিজবুল্লাকে সম্পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রাখবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ইজরায়েল দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান শত্রুতাকে ততই তীব্রতর করতে পারে, সম্ভাব্য ভাবে আরও প্রকাশ্য সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতি বিস্তৃত মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ও অস্থির সমীকরণকেই দর্শায়, যেখানে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং নিরাপত্তার উদ্বেগ প্রায়শই গোপন কাজকর্ম ও প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। নেতানিয়াহু প্রশাসন এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশা করলেও মনে হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেহরানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত চাইছে না। প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে ঐতিহাসিক ভাবে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, মার্কিন সরকার ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে আনুষ্ঠানিক ভাবে শোক প্রকাশ করেছে। প্রেসিডেন্ট এবং বিদেশমন্ত্রী ইরানের বিদেশনীতির প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী না হলেও এই পরিস্থিতিতে একটি শূন্য স্থান গাজাকে ঘিরে তেহরানের আঞ্চলিক কূটনৈতিক কার্যকলাপের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এবং মার্কিন নির্বাচনের প্রেক্ষিতে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ হারাতে পারে। প্রতিকূল ভাবেই এটি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
ভালি গোলমোহাম্মদি ইরানের তেহরানের তারবিয়াত মোদারেস ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং গবেষক।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.