যে কোনও যুদ্ধে নারী ও মেয়েরা সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত থাকে। প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক নেটওয়ার্কের ভাঙ্গন নারী ও মেয়েদের যৌন হিংস্রতা ও শোষণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা ভয়ঙ্কর ভাবে বাড়িয়ে দেয়। যৌন হিংসা সব সময়েই মানুষকে অবমাননা, অধীনতা স্বীকার করানো ও আতঙ্কিত করার জন্য সংঘর্ষের সময় একটি অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ২০০,০০০ থেকে ৪০০,০০০ বাঙালি নারীকে পরিকল্পিত ভাবে যৌন নির্যাতন করা হয়েছিল। ১৯৯১–২০০২ সালের মধ্যে সিয়েরা লিওনে গৃহযুদ্ধের সময় যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন ৬০,০০০ এরও বেশি নারী; লাইবেরিয়ায় ১৯৮৯–২০০৩ সালের মধ্যে ১৪ বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধের সময় প্রায় ৪০,০০০ নারী, সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় ১৯৯২–৯৫ সালের মধ্যে প্রায় ৬০,০০০ নারী, রুয়ান্ডার গণহত্যার সময় ১০০,০০০ থেকে ২৫০,০০০ এবং ১৯৯৮ সাল থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে ২০০,০০০–এরও বেশি নারী।
অতি সম্প্রতি আফ্রিকার একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ থেকে ইথিওপিয়ার এক সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হওয়ার সময় টিগরে-র নারী ও মেয়েরা যৌন হিংস্রতা, স্থানচ্যুতি ও শোষণের শিকার হয়েছেন। ইথিওপিয়ান ও ইরিট্রিয়ান বাহিনী টিগরে অঞ্চলে নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, গণধর্ষণ, যৌন অঙ্গচ্ছেদ এবং নির্যাতন সহ বিভিন্ন ধরনের যৌন হিংসা সংঘটিত করেছে। শিকারদের মধ্যে শিশু ও গর্ভবতী মহিলারাও ছিলেন, যাঁদের অনেককে অনেক সপ্তাহ ধরে যৌনদাসী হিসেবে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কিছু টিগরেয়ান পুরুষ ও ছেলেও তাঁদের বিরুদ্ধে যৌন হিংসার ঘটনা রিপোর্ট করেছেন। গত বছর তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকা আমহারা অঞ্চলে টিগরে-র সৈন্যরা নারী ও মেয়েদের উপর যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে বলে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
অতি সম্প্রতি আফ্রিকার একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ থেকে ইথিওপিয়ার এক সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হওয়ার সময় টিগরে-র নারী ও মেয়েরা যৌন হিংস্রতা, স্থানচ্যুতি ও শোষণের শিকার হয়েছেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি রিপোর্ট অনুসারে, যৌন হিংস্রতার শিকার বেশিরভাগ মানুষই মানসিক স্বাস্থ্যসহ গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হন, এবং তাঁদের চিকিৎসা বা মনোসামাজিক পরিষেবা পাওয়ার প্রায় কোনও সুযোগ থাকে না। আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের বিধানের উল্টো পথে গিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিকে ইচ্ছাকৃত ভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি সেগুলি দখল করে রেখেছে। অ্যাম্বুলেন্স বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, এবং চিকিৎসা কর্মীরা বেশিরভাগই ভয়ে পালিয়ে গেছেন। মেডিসিনস স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এম এস এফ)–এর দলগুলি টিগরে অঞ্চলে ১০৬টি চিকিৎসা সুবিধাকেন্দ্র পরিদর্শন করেছে, এবং দেখেছে যে এই অঞ্চলের ৮৭ শতাংশ চিকিৎসাকেন্দ্র পুরোপুরি কার্যকর ছিল না, ৭৩ শতাংশে লুটপাট চালানো হয়েছে, এবং ৩০ শতাংশ মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলস্বরূপ বেশিরভাগ যৌন নিপীড়নের শিকার মানুষেরা সামান্যই যত্ন পেয়েছেন বা কোনও যত্ন পাননি।
গণহত্যা সংক্রান্ত বিষয়ের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলির দাবি, ইথিওপিয়ান ও ইরিট্রিয়ান উভয় বাহিনীই টিগরেতে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে যৌন হিংসাকে ব্যবহার করছে। বেশির ভাগ ভুক্তভোগী রিপোর্ট করেছেন যে তাঁদের পরিচয়ের কারণে এবং তাঁদের ‘শুদ্ধ’ করার জন্য তাঁদের উপর নিষ্ঠুরতা চালানো হয়েছে। ডায়ান মাজুরানার মতো স্কলাররা যুক্তি দেন যে ইথিওপিয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সেস (ই এন ডি এফ) একটি পেশাদার সেনাবাহিনী যার শৃঙ্খলার জন্য খ্যাতি রয়েছে, এবং তা রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সবচেয়ে বড় অংশগ্রহণকারী। যদিও ইরিট্রিয়ান ডিফেন্স ফোর্সেস (ই ডি এফ) সেই তুলনায় অনেক কম খ্যাতিমান, তবে তাদেরও নিয়ন্ত্রণের অতীত একটি সামরিক বাহিনী বলে গণ্য করা যাবে না। কাজেই তারা কমান্ডিং অফিসার ও রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন ও উৎসাহ ছাড়া বড় আকারের যৌন হিংসা ঘটাতে পারে না। অন্য ভাবে বললে, টিগরেতে যৌন হিংসার ধরণটি বুঝিয়ে দেয় টিগরের জনগণকে শেষ করে দেওয়ার অভিপ্রায়ে যুদ্ধের একটি অস্ত্র হিসেবে যৌন হিংসা ব্যবহৃত হয়েছিল।
মানবাধিকার গোষ্ঠী, সহায়তা কর্মী ও চিকিৎসা পেশাজীবীরা গোড়ার দিকেই যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণের ঘটনা্য় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, এবং তাঁদের কাছ থেকে এই ধরনের ঘটনার উদ্বেগজনক বৃদ্ধির রিপোর্টের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপুঞ্জ ২০২১ সালের মে মাসে তদন্ত শুরু করে। ইথিওপিয়ার মানবাধিকার কমিশন ও রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার অফিসের যৌথ তদন্তে প্রকাশিত হয়েছে যে সংঘাতের সমস্ত পক্ষই যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক হিংসার দায়ে দোষী। পরিহাসের কথা, একজন নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী আবি আহমেদের নেতৃত্বে ইথিওপিয়ার সরকার মানবাধিকারের প্রতি সামান্যতম সম্মান না–দেখিয়ে টিগরেয়ানদের বিরুদ্ধে একটি নৃশংস যুদ্ধ চালিয়েছে। তবে ইথিওপীয় বাহিনী শুধু যৌন হিংসার সমস্ত অভিযোগই খারিজ করেনি, তারা প্রকাশ্যে এই সব রিপোর্টের নিন্দাও করেনি। ইথিওপীয় বাহিনী টিগরেতে মানবিক সহায়তার সুযোগ কার্যকর ভাবে অবরুদ্ধ করেছে, এবং তার ফলে টিগরে অঞ্চলে ইতিমধ্যেই একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ–পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। সংঘর্ষে ২৫ জন সহায়তা–কর্মীও নিহত হয়েছেন।
ডায়ান মাজুরানার মতো স্কলাররা যুক্তি দেন যে ইথিওপিয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সেস (ই এন ডি এফ) একটি পেশাদার সেনাবাহিনী যার শৃঙ্খলার জন্য খ্যাতি রয়েছে, এবং তা রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সবচেয়ে বড় অংশগ্রহণকারী।
এইচআইভি, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, ও কলঙ্ক সহ সংঘাতকালীন যৌন হিংসার প্রভাবগুলি প্রায়শই সংঘাত শেষ হওয়ার পরেও থেকে যায়। উদাহরণস্বরূপ, লাইবেরিয়ায় গৃহযুদ্ধের বছরগুলিতে শাস্তি না–হওয়ার সংস্কৃতি এবং ‘অতি–পুরুষত্ব’ বিকশিত হওয়ার কারণে সংঘাত আনুষ্ঠানিক ভাবে শেষ হওয়ার বহু বছর পরেও যৌন হিংসার হার এখনও খুব বেশি । ন্যায়বিচারের কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া হল, দ্বন্দ্ব-পরবর্তী বেশিরভাগ সমাজ হিংসার শিকার মানুষের চিকিৎসা বা মনস্তাত্ত্বিক যত্ন প্রদানেরও ক্ষমতা রাখে না।
বিশ্বজনীন নীরবতা
দুর্ভাগ্যবশত, দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে লিঙ্গ-ভিত্তিক হিংসার বিষয়টি লিঙ্গ সমতা এবং স্থিতিশীল উন্নয়নের আলোচনায় পর্যাপ্ত মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে যৌন হিংস্রতাকে প্রায়শই যুদ্ধের একটি অনিবার্য বাই–প্রোডাক্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, এবং অপরাধীদের খুব কমই শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ইথিওপিয়ার ক্ষেত্রে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি ও রাষ্ট্রপুঞ্জের দুর্বল প্রয়াস বেশিরভাগই ব্যর্থ হয়েছে। চিন, রাশিয়া, ইউক্রেন, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে সহজেই অস্ত্র আসতে থাকায় ইথিওপিয়ার সরকার টিগরেতে সংঘাতের একটি সামরিক সমাধানের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই।
লিঙ্গ সমতার বৈশ্বিক লক্ষ্য এসডিজি ৫ ‘পাচার ও যৌন এবং অন্যান্য ধরনের শোষণসহ প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংস্রতা বন্ধ করার’ আহ্বান জানায়। ইথিওপিয়ার সংকট কিন্তু এ সম্পর্কে কিছু কঠিন প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে৷ দেশগুলি যদি সংঘাতপূর্ণ এলাকায় যৌন হিংস্রতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে অস্বীকার করে, তা হলে কি নারীর বিরুদ্ধে হিংসা দূর করা সম্ভব? যদি একটি দেশের ভূখণ্ডগত আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না–করাটা যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে যৌন হিংস্রতার ব্যবহারের নিন্দা করার প্রয়োজনের থেকে বেশি প্রাধান্য পায়, তা হলে লিঙ্গ সমতা অর্জন এখনও বহু দূরের পথ। যে বিশ্ব এসডিজি অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সে নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে এত বড় ধরনের অপরাধ এবং সংঘাতের অস্ত্র হিসেবে যৌন হিংসার ব্যবহারের ক্ষেত্রে চুপ থাকতে পারে না। মানবাধিকারের প্রতি তার দায়বদ্ধতা পূরণের জন্য এবং টিগরেতে যৌন হিংস্রতার তীব্র নিন্দা করার জন্য ইথিওপিয়ার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা জরুরি।
*ওআরএফ–এর রিসার্চ ইন্টার্ন প্রণব কুমারের কাছ থেকে ইনপুট সহ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.