এই প্রবন্ধটি "What to expect in 2024"–এর অংশ
৭ অক্টোবর ইজরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের সন্ত্রাসবাদী হামলা অঞ্চলটিতে স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়ার উচ্ছ্বাসের মধ্যে তর্কসাপেক্ষ ভাবে পশ্চিম এশিয়ায় (মধ্যপ্রাচ্য) নিরাপত্তার অন্তঃপ্রবাহের একটি অতিরঞ্জিত ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে। পরিকল্পিত না হলেও আক্রমণ এবং সংশ্লিষ্ট বন্দি-সঙ্কট এক ‘নতুন’ মধ্যপ্রাচ্যের সম্ভাব্য ধারণার উপর কালো ছায়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। সংক্ষেপে বললে, দু’টি বার্তা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ভাবে প্রেরিত হয়েছে। প্রথমত, সুউচ্চ, ঝাঁ-চকচকে কাচের ইমারত ও বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও স্থিতিশীল প্রক্রিয়ার বিকল্প হতে পারে না। এবং দ্বিতীয়ত, আন্তঃআঞ্চলিক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়াগুলিকে এখন প্যালেস্তাইন সমস্যার আড়ালে লুকিয়ে রাখা আর সম্ভব নয়।
ইজরায়েলি রাষ্ট্র এবং তার জনগণ অন্য যে কোনও আঞ্চলিক কূটনৈতিক অবকাঠামোর তুলনায় এই সংঘাতকেই অগ্রাধিকার দেবে।
৭ অক্টোবরের সংঘর্ষে ইজরায়েলের উদ্দিষ্ট কৌশলের প্রেক্ষিতে – অর্থাৎ গাজায় হামাসকে নির্মূল করা – সংঘর্ষ ২০২৪ সালেও অব্যাহত থাকবে মনে করা হচ্ছে। ইজরায়েলি রাষ্ট্র এবং তার জনগণ অন্য যে কোনও আঞ্চলিক কূটনৈতিক অবকাঠামোর তুলনায় এই সংঘাতকেই অগ্রাধিকার দেবে। এর জন্য জনপ্রিয়তার অভাব এবং তাঁকে অপসারণের আহ্বান সত্ত্বেও ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আগামী মাসগুলিতে দেশের দায়িত্বে বহাল থাকবেন। এবং এই কয়েক মাস এটিও নির্ধারণ করবে যে, কী ভাবে আরব রাষ্ট্রগুলি ইজরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ও পূর্ব উভয় গোলার্ধের অন্যান্য অংশীদার রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে চালিত করবে।
ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সম্পর্কের সঞ্চারপথ
৭/১০ হামলা ইজরায়েলের ভূ-রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি… উভয়ের প্রেক্ষিতে একাধিক বিষয়ের পরিবর্তন করেছে। ইজরায়েলকে একটি মৌলিক প্রতিষ্ঠান পুনর্নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যা দেশটি কয়েক দশক ধরে গড়ে তুলেছিল। সেই দায়িত্ব এতটাই যে, তা দেশটির সাফল্য ও অপরাজেয়তা, তথ্য, কাহিনি এবং হলিউডের ছবিতেও ফুটে উঠেছিল। ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং আয়রন ডোমের মতো বিখ্যাত প্রযুক্তিগুলি থেকে শুরু করে মোসাদ কিংবা শিন বেত-এর মতো সংস্থাগুলির সাহায্য সত্ত্বেও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাকরণের বিষয়ে ইজরায়েলের আত্মোপলব্ধি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেটির পুনর্নির্মাণ রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে নিরাপত্তার ধারণা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একই সঙ্গে আঞ্চলিক ইসলামি শক্তিগুলি প্যালেস্তাইন প্রসঙ্গে কোন পথে এগোবে, সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে হবে। মিশর ও জর্ডনের মতো দেশ গাজা থেকে পালানোর চেষ্টায় রত প্যালেস্তাইনি শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানে অস্বীকার করেছে এবং তা আরব-ইহুদি আখ্যানের ঊর্ধ্বে উঠে সম্পর্কের বাইরে যাওয়া জটিলতাগুলিকেই তুলে ধরে। জনগণের পাশাপাশি প্যালেস্তাইনের ভূগোলও এ ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনও প্রকারের বাস্তুচ্যুতির অর্থ হল দ্রুতই গাজা এবং পশ্চিম তীরের ভবিষ্যতের উপর প্যালেস্তাইনের অধিকার খর্ব হবে। বর্তমান সামরিক অভিযানের পাশাপাশি রাজনৈতিক গতিপথের প্রেক্ষিতে ইজরায়েলের পরিকল্পনা ২০২৪ সালে সংঘর্ষটি কী ভাবে বিবর্তিত হবে, তার এক গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক প্রদান করে।
হামাসকে ‘ধ্বংস’ করা সংক্রান্ত প্রকাশ্যে জারি করা ইজরায়েলের প্রাথমিক লক্ষ্যের প্রেক্ষিতে এই যুদ্ধ ২০২৪ সালেও অব্যাহত থাকবে, এমনকি যদি হামাসের উচ্চতর পদাধিকারী সংগঠনের গাজা সামরিক (কাসাম ব্রিগেড) প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে নির্মূল করা হয় তাহলেও।
অবশেষে আঞ্চলিক ভাবে প্যালেস্তাইন প্রসঙ্গে কোনও একচেটিয়া ‘আরব’ দৃষ্টিভঙ্গি নেই। অনেক আঞ্চলিক রাষ্ট্র সঙ্কটের প্রেক্ষিতে দীর্ঘমেয়াদি, কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য সমাধানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে… এ কথা মনে করলেও এই ব্লকের মধ্যে বেশির ভাগই প্রথমে নিজেদের ব্যক্তিগত কৌশলগত স্বার্থের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সমস্যাটির বিচার করছে। হামাসকে ‘ধ্বংস’ করা সংক্রান্ত প্রকাশ্যে জারি করা ইজরায়েলের প্রাথমিক লক্ষ্যের প্রেক্ষিতে এই যুদ্ধ ২০২৪ সালেও অব্যাহত থাকবে, এমনকি যদি হামাসের উচ্চতর পদাধিকারী সংগঠনের গাজা সামরিক (কাসাম ব্রিগেড) প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে নির্মূল করা হয় তাহলেও। গাজা পেরিয়ে লেবানন এবং সিরিয়ায় হিজবুল্লার উপস্থিতি অন্য অঞ্চলগুলিতেও সংঘাত সম্প্রসারণের ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে।
আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
গত কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া উদ্যাপন করা হলেও – ২০২১ সালে স্বাক্ষরিত আব্রাহাম চুক্তি থেকে শুরু করে চিনের মধ্যস্থতায় সাম্প্রতিক কালে সৌদি-ইরান সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা পর্যন্ত – ইজরায়েল-ইরান সংঘর্ষের কোনও সমাধান পাওয়া যায়নি। তেহরান ইজরায়েলকে একটি ‘হান্টিংটোনিয়ান’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে(১) – অর্থাৎ তা সভ্যতার সংঘর্ষের নিরিখে এবং শুধুমাত্র ভূগোল, সীমানা বা কৌশলগত ঊর্ধ্বতনের নজরে নয়। এই অবস্থা আরও গুরুতর হয়েছে, যখন বর্তমানে ইজরায়েল এবং ইরান উভয়ই একটি দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের বিরোধিতা করেছে।
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্তরের নিরিখে এমন একাধিক ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে উদ্বেগগুলি মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক স্বার্থের বাইরেও সম্প্রসারিত হয়ে পড়ে। লোহিত সাগরে ভারতে যাতায়াতকারী জাহাজ-সহ বাণিজ্যিক জাহাজের উপর ইয়েমেনের হুতি জঙ্গিদের সাম্প্রতিক আক্রমণ - যারা হামাসের পক্ষে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে - এই অত্যাবশ্যক জলপথগুলিকে রক্ষা করার প্রেক্ষিতে একটি আন্তর্জাতিক আঙ্গিক যোগ করেছে। হরমুজ প্রণালী সর্বদাই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থেকেছে এবং বাব আল-মান্দেব প্রণালী – যা লোহিত সাগর ও সুয়েজ খালকে যুক্ত করেছে - বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশের প্রবাহপথ। এই জলপথের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত ও রক্ষা করার জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিদের দায়িত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বও বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগামী দশকে ভারতীয় নৌযাত্রার সংখ্যাও ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায় অর্থাৎ বর্তমানের ৮ শতাংশ থেকে মোট বিশ্ববাণিজ্যের ২০ শতাংশ পর্যন্ত।
লোহিত সাগরে ভারতে যাতায়াতকারী জাহাজ-সহ বাণিজ্যিক জাহাজের উপর ইয়েমেনের হুতি জঙ্গিদের সাম্প্রতিক আক্রমণ - যারা হামাসের পক্ষে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে - এই অত্যাবশ্যক জলপথগুলিকে রক্ষা করার প্রেক্ষিতে একটি আন্তর্জাতিক আঙ্গিক যোগ করেছে।
ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চিনের মতো বৃহৎ এশীয় অর্থনীতির জন্য উপরোক্ত পরিস্থিতি বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সব ক’টি দেশই তেল ও গ্যাসের নেট আমদানিকারক এবং তাদের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা সরবরাহের উপর ব্যাপক ভাবে নির্ভরশীল। হুতিদের মতো সামরিক বাহিনী দ্বারা পরিচালিত অত্যাধুনিক আক্রমণের হাত থেকে এই জাহাজ চলাচলের পথগুলিকে রক্ষা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে একটি বহুজাতিক টাস্ক ফোর্স তৈরি করার উদ্দেশ্যে অংশীদার দেশগুলিকে আহ্বান জানিয়েছে।
বহুপাক্ষিকতাবাদ এবং গ্লোবাল সাউথ
রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য মার্কিন ভেটো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বহুপাক্ষিকতার ভবিষ্যৎ, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এর বাস্তবতা এবং পশ্চিমকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি কোন নজরে ক্রমবর্ধমান গ্লোবাল সাউথকে দেখছে সেই সংক্রান্ত বিতর্কের নতুন ভিত্তি প্রদান করেছে। একই সঙ্গে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী দানা বাঁধতে থাকা বৃহত্তর মার্কিন-চিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেও এটি ত্বরান্বিত করছে।
প্যালেস্তাইনের সমস্যা গ্লোবাল সাউথে উল্লেখযোগ্য সমর্থন পেয়েছে, বিশেষ করে যখন সমস্যাটিকে ‘অ-উপনিবেশকরণ’ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে। যাই হোক, এ ক্ষেত্রে আরব বিশ্বের মতো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এও কোনও একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। ভারতের মতো দেশগুলি (অন্যদের মধ্যে) ইউএনএসসি-র সংস্কার চায় এবং বিদ্যমান বাস্তবতা ও রিয়েলপলিটিক-এর মধ্যে ভারসাম্য আনতে নিজেদের গ্লোবাল সাউথের প্রতিনিধিত্বকারী শীর্ষ ভূমিকায় দেখতে আগ্রহী। ২০২৩ সালে মোট ১৮৩টি আঞ্চলিক ও স্থানীয় সংঘাতের ঘটনা - যা গত তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ – দর্শিয়েছে যে এই চ্যালেঞ্জগুলি ২০২৪ সালে বৃদ্ধি পাবে।
প্যালেস্তাইনের সমস্যা গ্লোবাল সাউথে উল্লেখযোগ্য সমর্থন পেয়েছে, বিশেষ করে যখন সমস্যাটিকে ‘অ-উপনিবেশকরণ’ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে।
দ্বিপাক্ষিক এবং আঞ্চলিক কূটনীতির ঊর্ধ্বে উঠে গাজার যুদ্ধ এক পরিবর্তনশীল বিশ্ব ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে, যেখানে ভারত এবং চিনের মতো রাষ্ট্র নিজেদের ও তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য আরও বেশি করে জায়গা করে নিতে চাইছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত মোকাবিলার জন্য প্রথাগত বহুপাক্ষিক প্রক্রিয়া এখন অচল হয়ে পড়েছে।
আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক জটিলতার মধ্যে গাজা যুদ্ধের প্রভাব হ্রাস পেতে পারে, যেহেতু ইজরায়েল দীর্ঘমেয়াদি সামরিক অভিযান চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। তবে মৌলিক ভাবে এটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষবিন্দু হিসাবে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য এক চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে। এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিবর্তন কী ভাবে সংঘাত মোকাবিলা এবং স্থিতিশীল নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের দুর্বল ইতিহাসকে মোকাবিলা করার সঙ্গে সম্পর্কিত, তা পুনর্বিবেচনা করতেও বাধ্য করতে পারে।
কবীর তানেজা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ফেলো।
১) ‘হান্টিংটোনিয়ান’ শব্দটি ১৯৯৬ সালে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ বা ‘দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস’ শীর্ষক রচনায় প্রথম ব্যবহৃত হয়, যেখানে বলা হয়েছে যে, জনগণের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়গুলিই হবে ঠান্ডা লড়াই-পরবর্তী যুগে সংঘাতের প্রাথমিক উত্স।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.