ইতিহাস দর্শায় যে, আর্মেনিয়া বরাবরই বিদেশি আক্রমণের শিকার হয়েছে। এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থলে থাকার কারণে দেশটি সর্বদাই পরস্পরবিরোধী স্বার্থের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। ফলে দেশটি কয়েকবার তার স্বায়ত্তশাসন হারিয়েছে। অবশেষে আর্মেনীয়দের হয় তাঁদের জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল অথবা একটি উন্নত ভবিষ্যতের জন্য তাঁরা দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন আর্মেনীয় প্রবাসী সম্প্রদায় রাষ্ট্রহীন সামাজিক গঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে; বসবাসের দেশে তাঁদের ভাষা, ধর্ম এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য স্বদেশের সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে তাঁরা তাঁদের পরিচয়ের অনন্য উপাদানগুলি গড়ে তুলেছেন। এই প্রেক্ষিতে ভারতে আর্মেনীয় বণিকরা আঠেরো শতকের গোড়ার দিকে প্রথম আর্মেনিয় রাজনৈতিক ট্র্যাক্ট মুদ্রণ করে জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
যদিও ১৯৯১ সালে আর্মেনিয়ার স্বাধীনতার পর স্বদেশের সঙ্গে আর্মেনীয় প্রবাসীদের সম্পর্ক নতুন আকার পেতে শুরু করে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রাক্কালে এই সময়কালটি আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে নতুন করে সংঘাত এবং প্রথম আর্তসাখ (নাগর্নো কারাবাখ) যুদ্ধের সময়কেও চিহ্নিত করে। সেখানে বসবাসকারী জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আর্তসাখকে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসাবে সোভিয়েত আজারবাইজানের ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিভিন্ন প্রবাসী সম্প্রদায়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এই প্রেক্ষিতে ভারতে আর্মেনীয় বণিকরা আঠেরো শতকের গোড়ার দিকে প্রথম আর্মেনীয় রাজনৈতিক ট্র্যাক্ট মুদ্রণ করে জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
অবশেষে জাতি-রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং বসবাসের দেশে তার স্বার্থের প্রচারের জন্য প্রবাসী-গৃহভূমি সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলিও প্রচলিত হতে শুরু করে। কিছু সরকার প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে তাদের নিজ নিজ বসবাসের দেশের মধ্যে নিজস্ব স্বার্থ প্রচারের জন্য এই সম্প্রদায়গুলিকে অনুমতি দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমী দেশগুলিতে প্রতিষ্ঠিত আর্মেনীয় প্রবাসী সম্প্রদায়গুলির তাত্পর্য দুর্বল শান্তি চুক্তি এবং এই অঞ্চলের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে পরীক্ষিত হবে।
আর্মেনীয় প্রবাসীদের উত্থানের নেপথ্যে ছিল বিভিন্ন টানাপড়েনের কারণ। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে হওয়া গণহত্যার ঘটনা ছিল আর্মেনীয় প্রবাসীদের ‘ক্লাসিক’, ‘অত্যাচারিত’ এবং ‘মৌলিক’ বিবেচনা করার অন্যতম প্রধান কারণ। অ-তুর্কি জাতিসত্তা (যেমন আর্মেনীয় এবং গ্রিকদের) নির্বাসন এবং গণহত্যার ফলে তুর্কি, কুর্দি এবং অন্যান্য-সহ মুসলমানদের তুলনামূলক ভাবে সমজাতীয় জনসংখ্যার সৃষ্টি হয়। এ ভাবে উনিশ শতকের শেষের দিকে আর্মেনীয়দের গণহত্যার ফলে ১৯১৫-১৬ সালে অটোমান তুর্কিরা সিরিয়া ও প্যালেস্তাইনে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ঘটায় (১.৭৫ মিলিয়ন মানুষ)। অনেক আর্মেনীয় পরবর্তী কালে ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমী দেশগুলিতে আশ্রয় নেন। গণহত্যা বিশ্বব্যাপী আর্মেনীয়দের গির্জা, বিদ্যালয় এবং অন্যান্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁদের জাতীয় পরিচয় রক্ষার জন্য একটি ‘সংগ্রাম’ চালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল।
প্রকৃতপক্ষে, আর্মেনীয় প্রবাসীদের পরিচয় নির্মাণে স্বদেশ ও সত্তার চেতনা প্রচলিত হয়ে ওঠে। যদিও ‘স্বদেশ’ ধারণাটি অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে যখনই দেশটি কোনও সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন অনেকেই এটিকে অটোমান সাম্রাজ্যের হারিয়ে যাওয়া স্বদেশের সঙ্গে একই নজরে দেখেন। অন্যরা দেখেন তাঁদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির নজরে এবং বাকিরা আর্মেনীয় প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে সংযোগসূত্র অনুভব করে স্বদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে সংহতি প্রদর্শন করেন।
অনেক আর্মেনীয় পরবর্তী কালে ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমী দেশগুলিতে আশ্রয় নেন।
২০২০ সালে সংঘটিত সাম্প্রতিক ৪৪ দিনের যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী আর্মেনীয় প্রবাসী সম্প্রদায়ের দ্বারা যুদ্ধ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মানবিক ত্রাণ পাঠানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনেরই প্রমাণ দেয়। এই যুদ্ধটি কোভিড অতিমারির সময়ে সমাপতিত হওয়ার দরুন মানুষদের স্থানান্তরণের কাজটি দ্বিগুণ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বব্যাপী আর্মেনীয় প্রবাসী সম্প্রদায়গুলি একটি অভিন্ন কারণের জন্য আলোচনার মঞ্চ হিসাবে ডিজিটাল পরিসরকে ব্যবহার করেছে।
আর্মেনিয়ান ন্যাশনাল কমিটি অফ আমেরিকার (এএনসিএ) মতো সংগঠনের তত্ত্বাবধানে বিক্ষোভ সংগঠিত করার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আর্মেনীয় সম্প্রদায়গুলি স্বদেশে আর্মেনিয়দের অস্তিত্বের সংকট সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে চলেছে৷
আন্তর্জাতিক আর্মেনীয় সম্মেলনেও বিশ্বব্যাপী আর্মেনীয় প্রবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। সেখানে এ কথাই উঠে এসেছে যে, প্রবাসী এবং আর্মেনীয় জনগোষ্ঠী… উভয়ের অস্তিত্বই একে অপরের থেকে উদ্ভূত। ভারসাম্যের ভিত্তিতে যখন আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে অস্তিত্বের হুমকি প্রকট হয়ে ওঠে, তখন প্রবাসীরা প্রধান সমস্যাগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্বদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন দেশে আর্মেনীয় প্রবাসী সংগঠন এবং সম্প্রদায়ের বিক্ষোভের ফলে তাদের বসবাসের দেশের শীর্ষনেতারা আজারবাইজানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা জানাতে বাধ্য হয়েছেন।
বসবাসের দেশগুলিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা ছাড়াও হায়াস্তান অল-আর্মেনিয়া ফান্ড এবং আর্মেনিয়ান জেনারেল বেনেভোলেন্ট ইউনিয়ন (এজিবিইউ) বাস্তুচ্যুত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছে। হায়াস্তান অল-আর্মেনিয়া তহবিলের দৃষ্টিভঙ্গি হল একটি বিশ্বব্যাপী আর্মেনীয় নেটওয়ার্ক গঠন করা, যা স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক কল্যাণ, পরিকাঠামোগত উন্নতির লক্ষ্যে প্রকল্পগুলির মাধ্যমে আর্মেনিয়া এবং আর্টসাখে আর্মেনীয়দের সমর্থন জোগাবে। তাদের উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে একটি অভিন্ন পরিচয়ের ভিত্তিতে আর্মেনিয়া এবং বিশ্বব্যাপী আর্মেনীয় প্রবাসী সম্প্রদায়ের স্থিতিশীল উন্নয়নও অন্তর্ভুক্ত।
আর্মেনীয়দের প্রশ্নে বিশ্বব্যাপী আর্মেনীয়দের প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে এবং তা তুর্কি ও আজারবাইজান সরকারের কঠোর প্রতিক্রিয়ায় সবচেয়ে ভালভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষ করে ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসীদের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার প্রচেষ্টা তুরকিয়ের বিদেশনীতির অংশ হয়ে উঠেছে এবং এরদোগানের শাসনামলে অনেক ক্ষেত্রে হিংসাত্মক রূপ ধারণ করেছে।
ভারসাম্যের ভিত্তিতে যখন আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে অস্তিত্বের হুমকি প্রকট হয়ে ওঠে, তখন প্রবাসীরা প্রধান সমস্যাগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্বদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
হিংসার বার্তা অন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মাধ্যমেও উত্থাপিত হয়েছে। তুরস্কের বিদেশমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে উরুগুয়েতে আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের – যাঁরা আর্মেনিয়ান গণহত্যার ১০৭তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে মিছিল করছিলেন – তাঁদের গ্রে উলভস বা এমএইচপি-র (তুরস্কের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পার্টি) সশস্ত্র শাখার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন। আজারবাইজানের সামরিক কর্মীদের লাচিন করিডোর অবরোধের সময়ও গ্রে উলভস চিহ্নটি দেখা গিয়েছিল। তুরস্ক এবং আজারবাইজান দ্বারা আর্মেনীয়-বিরোধী প্রচার এবং আর্মেনীয়-বিরোধী বিদ্বেষমূলক পোস্টার সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি তুর্কি এবং আজারবাইজানি প্রবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে।
উপসংহারে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নাগর্নো-কারাবাখের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে এবং পরিবর্তিত বিশ্বক্রমের প্রেক্ষিতে আর্মেনীয় প্রবাসীরা আর্মেনিয়া রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কৌশলগত অংশীদার হিসাবে বিবেচিত হতে পারেন। আর্মেনীয় প্রবাসীরা স্বদেশ এবং স্বদেশের বিভিন্ন ধারণার সঙ্গে ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করা সত্ত্বেও, আর্মেনীয়রা তাঁদের স্বদেশে অস্তিত্বের সঙ্কট প্রসঙ্গে সচেতনতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক পরিসরে একটি উল্লেখযোগ্য রূপান্তরমূলক শক্তি হয়ে উঠতে পারেন।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.