Author : Harsh V. Pant

Published on May 02, 2022 Updated 0 Hours ago

প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর দুই দেশের মধ্যে সামরিক অচলাবস্থার প্রায় দু’বছরের মাথায় চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি অল্প সময়ের জন্য ভারত সফরে আসেন।

ওয়াং-এর সফর : বেজিং তার ভারত নীতির পুনর্মূল্যায়ন করছে না

প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এল এ সি) বরাবর দুই দেশের মধ্যে সামরিক অচলাবস্থার প্রায় দু’বছরের মাথায় চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি অল্প সময়ের জন্য ভারত সফরে আসেন। তাঁর ভারত সফর নিয়ে তীব্র গোপনীয়তা বজায় রাখা হলেও তাঁর ভ্রমণসূচির অন্যান্য অংশ, যেমন পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং নেপাল পরিদর্শনের ব্যাপারে যথেষ্ট প্রচার চালানো হয়। কূটনীতির ক্ষেত্রে কখনও কখনও গোপন সফরের নেপথ্যে প্রধান লক্ষ্য হল দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থা দূর করা এবং বিদ্যমান সঙ্কট সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার প্রদর্শন। কিন্তু আলোচ্য সফরটির এ রকম কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। সংশ্লিষ্ট সফরের প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারতের সংকল্পের দৃঢ়তা পরীক্ষা করে দেখা এবং এই বিশ্লেষণ চালানো যে, পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি কি অতীতের মতোই ভারতকে চিনের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করবে?

ঠান্ডা লড়াই শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরেই আমেরিকান ইউনিপোলার মোমেন্ট বা আমেরিকার বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার এক মাত্র কেন্দ্র হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে রাশিয়া-ভারত-চিন (আর আই সি) ত্রিপাক্ষিক জোটের সূচনা হয়।

এমন এক সময় ছিল, যখন চিন এবং রাশিয়ার মতো ‘সমমনস্ক’ শক্তিগুলির সঙ্গে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ভারতের আন্তর্জাতিক সক্রিয়তার সর্বোচ্চ সীমা রূপে গণ্য করা হত। ঠান্ডা লড়াই শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরেই আমেরিকান ইউনিপোলার মোমেন্ট বা আমেরিকার বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার এক মাত্র কেন্দ্র হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে রাশিয়া-ভারত-চিন (আর আই সি) ত্রিপাক্ষিক জোটের সূচনা হয়। এই আর আই সি পরবর্তী কালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ক্রমের রূপান্তর এবং ভারত এবং চিনের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন (বি আর আই সি) এবং তার পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার (বি আর আই সি এস বা ব্রিকস) সংযোজনের ফলে নতুন আকার ধারণ করে। এই মঞ্চগুলির অংশ হিসেবে ভারত অভিন্ন আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে চিনের সঙ্গে জোট গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। এমনটা মনে করা হয়েছিল যে, এই আন্তর্জাতিক কেন্দ্রাভিমুখিতা অবশেষে এক দ্বিপাক্ষিক জোটের জন্ম দেবে এবং এর ফলে ভিন্ন স্বার্থযুক্ত দু’টি দেশ আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতার প্রেক্ষিতে একজোট হয়ে কাজ করতে সমর্থ হবে। যদিও এ কথা আলাদা যে, চিনের আন্তর্জাতিক আগ্রহ ভারতের তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত এবং আন্তর্জাতিক স্তরে দুই দেশের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক কৌশলগত সমন্বয় ব্যতীত আর কোনও যৌথ পদক্ষেপের আশা করা সমীচীন নয়। এই প্রক্রিয়ার ফলে শুধু মাত্র চিন-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, একই সঙ্গে চিন-ভারত আন্তর্জাতিক সক্রিয়তার যৌথ উদ্যোগে মতবিরোধের ফলে ভারতের বৈশ্বিক উদ্যোগগুলিও প্রভাবিত হয়েছে।

কিন্তু যে কোনও প্রয়াস এক বার জোর করে শুরু করলে, তা দীর্ঘ দিন বহাল থাকে এবং ভারতীয় বিদেশনীতিতেও চিনের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তোলার অবাস্তব প্রচেষ্টাকে দীর্ঘ দিন বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালানো হয়। অবশেষে এবং সম্ভবত শেষ বারের মতো এ বিষয়ে ভারতের মোহভঙ্গ হয় যখন ২০২০ সালের জুন মাসে গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের সেনার মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাধে। এর ফলে ২০ জন ভারতীয় সৈনিক প্রাণ হারান। এর পর থেকেই নয়াদিল্লি তার এই সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছে যে, এল এ সি বরাবর শান্তি এবং সুস্থিতি বহাল না থাকলে চিনের সঙ্গে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ সম্ভব নয়। যেমনটা ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘১৯৯৩-৯৬ সালের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলি লঙ্ঘন করে চিনের তরফে সীমান্ত বরাবর বিশাল সংখ্যক সেনা মজুত করার ফলে চিনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।’ ভারতের জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা অজিত ডোভালও এই বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করেন, যখন ওয়াং ই সীমান্ত সমস্যা নিয়ে স্পেশ্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভস আলোচনার জন্য তাঁকে চিন সফরে আমন্ত্রণ জানান। এবং তাঁকে এ কথাও জানানো হয় যে, এক মাত্র এল এ সি বরাবর সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার ও আগ্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করলেই দুই দেশের মধ্যে আলোচনা স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে।

সমস্যাটিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় সংবেদনশীলতা সম্পর্কেও বেজিং সচেতন। কিন্তু ভারতীয় উদ্বেগের প্রতি সংবেদনশীল হওয়াকে চিনারা অগ্রাধিকার দিতে আগ্রহী নয়।

ওয়াং ই ভারতের দাবি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। গত দু’বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। সমস্যাটিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় সংবেদনশীলতা সম্পর্কেও বেজিং সচেতন। কিন্তু ভারতীয় উদ্বেগের প্রতি সংবেদনশীল হওয়াকে চিনারা অগ্রাধিকার দিতে আগ্রহী নয়। ভারতে পা রাখার ঠিক আগেই পাকিস্তানে অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশনের (ও আই সি) সমাবেশে তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের বিষয়টির উপরে গুরুত্ব দেন। তিনি ভাল ভাবেই জানতেন, ভারতে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। ওয়াং ই জানান যে, বেজিং কাশ্মীর প্রসঙ্গে ‘একাধিক ইসলামিক বন্ধু দেশের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে’ এবং তিনি আরও বলেন যে, ‘বেজিংও তাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সহমত।’ তাঁর এ হেন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ভারতের উত্তর ছিল দ্রুত এবং স্পষ্ট। ভারতের তরফে চিনের বিদেশমন্ত্রীর এই প্রসঙ্গে করা মন্তব্যকে সম্পূর্ণ খারিজ করে দেওয়ার সঙ্গে এ কথাও মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, বিষয়টি সম্পর্কে চিনের পক্ষাবলম্বনের কোনও অধিকার নেই এবং দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য দেশের নাক গলানো ভারতের পছন্দ নয়।

তবুও ওয়াং ই ভারত সফরে আসেন এবং নয়াদিল্লিতে যান। এই সাক্ষাতের সময়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং দৃষ্টিভঙ্গি কোনওটিই আদর্শ ছিল না এবং একটি সফল কূটনৈতিক সফরের নেপথ্যে থাকা কারণগুলিও অনুপস্থিত ছিল। তিনি একটি বিশেষ কারণে নয়াদিল্লি এসেছিলেন। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণে বেজিংয়ের কোনও আগ্রহ নেই। এল এ সি বরাবর অভূতপূর্ব ভাবে সামরিক শক্তি বহাল করা এ কথার দিকেই ইঙ্গিত করে যে, চিন তার ইচ্ছানুসারে ভারতকে নত করার দীর্ঘ দিনের লক্ষ্যপূরণে অনড় থাকবে। কিন্তু ব্রিকস-এর আসন্ন শীর্ষ সম্মেলন চিনের জন্য সামান্য হলেও মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত চিনের জন্য এমন এক সুযোগ, যাকে কাজে লাগিয়ে সে ভারতকে পশ্চিমী দেশগুলির বিরুদ্ধে রাশিয়া, চিন এবং ভারতের এক জোট হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে বাধ্য করতে চায়।

চিন রাশিয়ার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত এবং চিনের দুর্বলতাগুলি স্পষ্টতই দৃশ্যমান।

চিন ইউক্রেনীয় সঙ্কটের গতিপথ নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত শীতকালীন অলিম্পিকস-এর সময়ে পুতিনের সঙ্গে একটি ‘সীমাহীন’ বা ‘নো লিমিট’ অংশীদারিত্বে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার পরে এখন চিনের পক্ষে তাঁকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। এমন এক সময়ে যখন শি জিনপিংয়ের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল অতিমারি-উত্তর চিনের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন, ঠিক তখনই কোভিডের পুনরুত্থান এবং একটি আন্তর্জাতিক সঙ্কটের অবতারণা ঘটেছে। চিন রাশিয়ার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত এবং চিনের দুর্বলতাগুলি স্পষ্টতই দৃশ্যমান। পশ্চিমী শক্তিগুলি অদূর ভবিষ্যতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে তাদের নজর সরিয়ে নেবে এমন কোনও ইঙ্গিত এখনও পাওয়া যায়নি এবং তারা ইউক্রেন সঙ্কটের প্রেক্ষিতে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে ক্রমশ নমনীয় হচ্ছে। চিনের পরিস্থিতি যত বেশি করে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, ততই তারা ভারতকে প্রলুব্ধ করে একটি সাধারণ মঞ্চভুক্ত করতে চাইছে, যার বাস্তবায়ন বেজিংয়ের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

কিন্তু নয়াদিল্লি এ ব্যাপারে সচেতন যে, এই সফরের নেপথ্যে ভারত-নীতি নির্ধারণে বেজিংয়ের তরফে কোনও মৌলিক পুনর্মূল্যায়ন করা হবে না। চিনের লক্ষ্য শুধু মাত্র ভারতের দুর্বল জায়গায় আঘাত করা… তা সে কাশ্মীর বিষয়ে পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়াই হোক বা আফগানিস্তানে তালিবানকে সমর্থন করাই হোক। ওয়াং ই-র সফর নিয়ে এক মাত্র তাঁরাই আগ্রহী হতে পারেন, যাঁরা চিনের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে অবগত নন। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেও একটি সুচিন্তিত পদ্ধতি বিদ্যমান। ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা অন্তত এ বার এই বিশৃঙ্খলার মাঝেও তাঁদের লক্ষ্য ধরে রাখতে পেরেছেন। তাঁরা তাঁদের অবস্থানে অনড় থাকবেন, এমনটা আশা করা যায়।


এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান টাইমস-এ।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.