প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় সফরের সময় ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লি একটি সর্বাত্মক প্রতিরক্ষা সম্পর্ক তৈরির দিকে এগোতে পারে। এই সফরে অন্তত দুটি বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্যাল লিমিটেড (এইচএএল)–এর হালকা যুদ্ধ বিমান বা তেজস এমকে-২ জঙ্গি বিমানের জন্য জেনারেল ইলেকট্রিক (জিই) নির্মিত এফ৪১৪ জেট ইঞ্জিন প্রযুক্তি হস্তান্তর ছাড়াও ভারতের ডিফেন্স অ্যাকুইজেশন কাউন্সিল (ডিএসি) ভারতীয় সশস্ত্র সেনার তিনটি বাহিনীর জন্য জেনারেল অ্যাটমিক্স (জিএ) নির্মিত ৩১ এমকিউ–৯বি সশস্ত্র ড্রোন কেনার ছাড়পত্র দিয়েছে। এই দুটি বড় মাপের চুক্তি হবে প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শীর্ষ বৈঠক থেকে তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি। যাই হোক, বিশদ বিবরণের মধ্যে আরও কিছু রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে, কারণ প্রতিবেদিত খবরগুলি ইঙ্গিত করে যে জিই তার জেট ইঞ্জিন প্রযুক্তির মূল্যমানের ৮০ শতাংশ হস্তান্তর করতে পারে। এফ৪১৪–র সঙ্গে যুক্ত এগারোটি মূল প্রযুক্তিও হস্তান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি সত্য হয়, তাহলে এই ঘটনা মার্কিন–ভারত প্রতিরক্ষা সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি অবিশ্বাস্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।
অন্য ইতিবাচক ঘটনা হল ভারতের চূড়ান্তভাবে ৩১টি এমকিউ–৯বি মানবহীন বায়ুযান (ইউএভি) কেনা। শুধু ১৮টি ড্রোনের মধ্যে ভারতের চুক্তি সীমাবদ্ধ করা হবে বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের (এমওডি) একটি পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে প্রতিটি ইউনিটের মূল্য অনেক বেশি পড়ত। তার ফলে এখন ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ৩১টি ড্রোন কেনার চেয়ে তা কম কাজের হত। এ ছাড়াও, শীর্ষ সম্মেলনের পরে এই সম্ভাব্য বড় মাপের ঘোষণাগুলি ব্যতিরেকে আরও চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। মোদীর রাষ্ট্রীয় সফরের প্রাক্কালে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন এই মাসের গোড়ার দিকে নয়াদিল্লিতে এসেছিলেন, এবং তিনি ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে সরবরাহ শৃঙ্খল, মার্কিন–ভারত প্রতিরক্ষা শিল্প ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার একটি রোডম্যাপ, একটি ‘সরবরাহ ব্যবস্থার নিরাপত্তা’ এবং একটি ‘পারস্পরিক প্রতিরক্ষা সংগ্রহ ব্যবস্থা’ নিয়ে অন্তত একটি অস্থায়ী চুক্তিতে পৌঁছন।
শুধু ১৮টি ড্রোনের মধ্যে ভারতের চুক্তি সীমাবদ্ধ করা হবে বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের (এমওডি) একটি পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে প্রতিটি ইউনিটের মূল্য অনেক বেশি পড়ত। তার ফলে এখন ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ৩১টি ড্রোন কেনার চেয়ে তা কম কাজের হত।
যাই হোক, কোনও চুক্তির খুঁটিনাটি সতর্কভাবে বিবেচিত না–হওয়া পর্যন্ত কিছুই নিশ্চিত নয়। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ইতিমধ্যেই অতিরঞ্জিত প্রত্যাশা বা অত্যধিক আশাবাদকে ছোট করে দেখিয়ে বলেছেন: ‘‘প্রধানমন্ত্রী আসার সময় আমরা কী কী পেলাম তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’’
সীমাবদ্ধতা
যদিও মার্কিন–ভারত প্রতিরক্ষা সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এখন কেন্দ্রিকতার স্তরে উন্নীত হয়েছে, তবে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর মার্কিন সফরের সময় যে বিপুল প্রাপ্তিযোগের সম্ভাবনা রয়েছে, এই সীমাবদ্ধতা তাকে ছাড়িয়ে বিস্তৃত। ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বাগ্রে আছে সম্পদের বিষয়টি, যা মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম ও হার্ডওয়্যার কেনার জন্য ব্যয় করতে হবে। হার্ড কারেন্সি দুষ্প্রাপ্য ও সীমিত। কাজেই ভারতের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বেসামরিক নেতারা, তা বর্তমান ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) সরকার হোক বা তার উত্তরসূরি হিসাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (আইএনসি) নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ), কেউই মার্কিন নীতিনির্ধারক ও প্রতিরক্ষা কর্পোরেটদের প্রত্যাশা পূরণের জন্য প্রতিরক্ষায় আরও বেশি ব্যয় করবে না। দেশীয় অগ্রাধিকারের একটি পূর্ণ পরিসর আছে, যাকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সরকার সকলেই জনস্বার্থে ব্যয় করা এবং তাদের নির্বাচনী ভাগ্য সুরক্ষিত করার জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করে,এবং সেই কারণেই সম্ভবত তারা মার্কিন অস্ত্র কেনার জন্য ব্যয় করার সংস্থানগুলিকে বেঁধে দেবে বা অন্ততপক্ষে তার উপর লক্ষ্যভিত্তিক সীমাবদ্ধতা আরোপ করবে।
সুযোগ ও সমাধান
ওয়াশিংটনের প্রত্যাশা, নয়াদিল্লি আরও মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম কিনবে, যেমনটা ইতিমধ্যেই মার্কিন–ভারত ট্র্যাক–২ ও ট্র্যাক–১.৫ যোগাযোগের সময় প্রস্তাব করা হয়েছে; এর সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে যে ভারত প্রতিরক্ষা হার্ডওয়্যার কিনবে এমন একটি ব্যবস্থার বাস্তবায়নের মাধ্যমে যা লেন্ড–লিজ অ্যাক্ট (এলএলএ) গোত্রের। এই এলএলএ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো মিত্রদের সামরিকভাবে সাহায্য করার জন্য, কারণ তারা ওয়াশিংটনের সামরিক সরঞ্জামের দাম হার্ড কারেন্সিতে পরিশোধ করতে পারত না। একটি এলএলএ–র মতো ব্যবস্থা তৈরি হলে ভারতকে নগদ ভিত্তিতে অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। পরিবর্তে এমন হতে পারে যে ভারত মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলিকে নির্বাচিত ভারতীয় ঘাঁটিতে প্রবেশাধিকার দেবে, এবং মার্কিন সামরিক বিমানের জন্য জ্বালানি ও লজিস্টিক সহায়তা দেবে। উপরন্তু ভারত মেনটেনেন্স, রিপেয়ার অ্যান্ড ওভারহল (এমআরও) অ্যাক্সেস–ও প্রদান করতে পারে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং তাঁর মার্কিন সমকক্ষ অস্টিনের নয়াদিল্লি সফরের সময় ভারতকে এমন একটি প্রধান সামরিক লজিস্টিক হাব করার জন্য অগ্রাধিকার দিতে অনুরোধ করেছিলেন যা শুধু ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী্র প্রয়োজনীয়তাই পূরণ করেবে না, সমানভাবে মার্কিন সামরিক বাহিনীরও করবে। ভারত মার্কিন নৌবাহিনীর নৌযানগুলিকে বিনামূল্যে পরিষেবা দিতে এবং পুনঃপরিপূরণ করতে পারে, যাতে তার জন্য প্রাপ্য অর্থ দিয়ে মার্কিন অস্ত্রের মূল্য মেটানো যায়। তবে এলএলএ–র মতো চুক্তির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এমন ছাড় দিতে হবে যাতে পুরো অর্থ না–দিতে হয়, পরিবর্তে ভারতে সরবরাহ করা মার্কিন অস্ত্র বা সামরিক হার্ডওয়্যারের ব্যয়ের ৭৫–৮০ শতাংশ শুধু পূরণ করতে হয়। নিশ্চিতভাবে বলা যায় মূল এলএলএ মার্কিন মিত্রদের প্রতি এত বেশি উদার ছিল তা কার্যত একটি ‘উপহার’ হয়ে উঠেছিল; তবে নয়াদিল্লির সচেতন থাকা উচিত যে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে সে এমন উদারতা আশা করতে পারে না।
ভারত মার্কিন নৌবাহিনীর নৌযানগুলিকে বিনামূল্যে পরিষেবা দিতে এবং পুনঃপরিপূরণ করতে পারে, যাতে তার জন্য প্রাপ্য অর্থ দিয়ে মার্কিন অস্ত্রের মূল্য মেটানো যায়।
তবে এলএলএ–র মতো একটি ব্যবস্থা হবে বলে ধরে নেওয়া সন্তোষজনক নয়, কারণ তা শেষ পর্যন্ত ভারতের মতো প্রাপক বা সুবিধাভোগী রাষ্ট্রের বকেয়া মকুব করার ক্ষেত্রে মার্কিন নেতৃত্বকে অনেক বেশি নিজস্ব ইচ্ছাধীন ক্ষমতা দিতে পারে। বরং একটি হাইব্রিড মডেল তৈরি করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে ভারত আংশিক অর্থ প্রদান করতে পারে হার্ড কারেন্সিতে, এবং বাকিটা মার্কিন বাহিনীকে নিখরচায় এমআরও সুবিধা দেওয়া, জ্বালানি দেওয়া, পুনঃপরিপূরণ করা এবং নির্বাচিত ভারতীয় নৌ–ঘাঁটি ও সুযোগ–সুবিধা ব্যবহার করতে দেওয়ার মাধ্যমে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য এই ব্যবস্থা ভারতীয় বিমান বাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী পরিচালিত সুবিধাকেন্দ্রগুলিতেও প্রসারিত করা যেতে পারে।
ওয়াশিংটন ডিসি–তে মোদীর চলতি সফর মার্কিন–ভারত প্রতিরক্ষা সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় রূপান্তরের বার্তা বহন করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এমনকি যদি নয়াদিল্লির প্রত্যাশা শুধুমাত্র আংশিকভাবে এই সফর থেকে পূরণ হয়, তা হলেও এটি বিশ্বের দুটি বৃহত্তম গণতন্ত্রের মধ্যে প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে সুসংহত করতে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
কার্তিক বোমাকান্তি অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.