ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক উত্তেজনা ও পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক গতিশীলতার প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক মার্কিন-জাপান শীর্ষ সম্মেলনটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গতিপথ গঠন এবং বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রবাহকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার মধ্যকার বৈঠকটি তিনটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পটভূমিতে ঘটেছে – গভীরতর হওয়া রাশিয়া-চিন জোট, দক্ষিণ চিন সাগর ও তাইওয়ান প্রণালীতে চিনের বর্ধিত আগ্রাসন এবং দীর্ঘায়িত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির উপরেও ছায়া ফেলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সফরের সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদা ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ ও জাপানের চারপাশে অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিবেশের মাঝেই জাপান-মার্কিন জোটের গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃতির গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। মার্কিন কংগ্রেসে তাঁর ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এক ভবিষ্যৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গির উপর মনোযোগ দেন এবং তাঁর কূটনৈতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের জন্য জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় ভূমিকার কথা ব্যক্ত করেন। ভবিষ্যতে মার্কিন নেতৃত্বকে ঘিরে অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও কিশিদা মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণ দেওয়ার মতো বিশ্বস্ত প্রতীকবাদের মাধ্যমে মার্কিন-জাপান জোটের জন্য দ্বিদলীয় সমর্থনকে পুনর্নিশ্চিত করতে চান। জাপানের লক্ষ্য হল মুক্ত বাণিজ্য ও একটি নিয়মভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করা এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন নির্বিশেষে নিজেকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসাবে তুলে ধরা।
ভবিষ্যতে মার্কিন নেতৃত্বকে ঘিরে অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও কিশিদা মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণ দেওয়ার মতো বিশ্বস্ত প্রতীকবাদের মাধ্যমে মার্কিন-জাপান জোটের জন্য দ্বিদলীয় সমর্থনকে পুনর্নিশ্চিত করতে চান।
মার্কিন-জাপান অংশীদারিত্ব দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরিখে উভয় দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। শীর্ষ সম্মেলনটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে জাপানের উত্থানকে সুনিশ্চিত করে, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জটিল চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছে এবং জাপানের চারপাশের নিরাপত্তা পরিবেশ ক্রমশ প্রতিবন্ধকতাময় হয়ে উঠছে। এটি প্রতিরক্ষা সংস্কার, প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি, জাপান-আরওকে সম্পর্কের উন্নতি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ ও ইউক্রেনের জন্য সমর্থন-সহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপানের সক্রিয় অবস্থানকেই দর্শায়। যেমনটা কিশিদা উল্লেখ করেছেন, জাপান বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘গ্লোবাল পার্টনার’ বা ‘আন্তর্জাতিক অংশীদার’ হিসেবে কাজ করতে প্রস্তুত। নেতাদের তরফে প্রত্যাশিত ঘোষণার মধ্যে রয়েছে উন্নত বাহিনীর সমন্বিতকরণের জন্য শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা, গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক মহাকাশ সহযোগিতা উদ্যোগ, উদীয়মান প্রযুক্তির ক্ষেত্রে গবেষণায় ব্যাপক অংশীদারিত্ব এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য বাণিজ্যিক চুক্তি।
একটি কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে শীর্ষ সম্মেলনটি জাপানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজের জোটকে দৃঢ় করার সুযোগ করে দিয়েছে, যা জাপানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কৌশলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাপানের ঐতিহাসিক ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং প্রত্যাঘাতমূলক সক্ষমতা অর্জনের জন্য এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এই সমন্বয়সাধন জাপানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জাপান ইন্দো-প্যাসিফিকের প্রতিবন্ধকতাময় নিরাপত্তা গতিশীলতা, বিশেষ করে চিনের উত্থান এবং উত্তর কোরিয়ার ক্রমাগত হুমকির মাঝে পথ খুঁজে নিতে চায়। মার্কিন ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট কার্ট ক্যাম্পবেল আগেই পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, শীর্ষ সম্মেলনটিতে সামরিক ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উন্নয়ন এবং সম্ভাব্য সহ-উৎপাদনের বিষয়ে সহযোগিতার প্রস্তাব দেওয়া হবে। কৌশলগত সহযোগিতার উপর জোর দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কয়েক দশক আগে সূচিত হওয়ার পর থেকে শীর্ষ সম্মেলনটিকে দ্বিপাক্ষিক জোটের ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ সংস্কার বলে উল্লেখ করেন। এ ছাড়াও বাইডেন অউকাস নিরাপত্তা কাঠামোর পিলার ২-এ জাপানের সম্পৃক্ততার সম্ভাবনার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। অর্থনৈতিক ভাবে মহাকাশ, ক্লাউড, এআই অবকাঠামো এবং গুরুত্বপূর্ণ ও উদীয়মান প্রযুক্তিতে গবেষণায় ব্যাপক অংশীদারিত্ব-সহ বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে এই শীর্ষ সম্মেলনটি জাপানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার সুযোগ প্রদান করে। ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক পরিসরে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রেক্ষিতে দুই দেশ পারমাণবিক ফিউশন এবং অবকাঠামো প্রকল্পের উন্নয়ন ও বাণিজ্যিকীকরণকে ত্বরান্বিত করার জন্য একটি যৌথ অংশীদারিত্বের ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে রয়েছে একটি বুলেট ট্রেন প্রকল্প এবং এই প্রকল্পে জাপানি প্রযুক্তি এবং বিনিয়োগ ব্যবহার করা হবে।
কৌশলগত সহযোগিতার উপর জোর দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কয়েক দশক আগে সূচিত হওয়ার পর থেকে শীর্ষ সম্মেলনটিকে দ্বিপাক্ষিক জোটের ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ সংস্কার বলে উল্লেখ করেন।
এর আগে, ৭ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপিন্স, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া আলোচনার শীর্ষে উঠে আসে, যখন তারা দক্ষিণ চিন সাগরে প্রথম বারের মতো যৌথ নৌ মহড়া চালায়। এই মহড়ার লক্ষ্য ছিল এই গুরুত্বপূর্ণ ও অস্থিতিশীল সামুদ্রিক পরিসরে আন্তর্জাতিক আইনকে সমুন্নত রাখার বিষয়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানকে দর্শানো। ফিলিপিন্সের সঙ্গে প্রথম বারের মতো হওয়া ত্রিপাক্ষিক শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর জোর দেওয়া হয় এবং আঞ্চলিক দেশগুলিকে তাদের সার্বভৌম অধিকার রক্ষার্থে ক্ষমতায়ন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান উভয়ের কৌশলগত লক্ষ্যের উপর জোর দেওয়া হয়। এটি জাপানের বৃহত্তর বৈদেশিক নীতির লক্ষ্যগুলির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ এবং আঞ্চলিক গতিশীলতা গঠনে তার সক্রিয় অবস্থান প্রদর্শন করে। ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের সময় তিন দেশের নেতা ইন্দো-প্যাসিফিকের আন্তর্জাতিক অবকাঠামো এবং বিনিয়োগ করিডোরের জন্য প্রথম অংশীদারিত্বের অংশ হিসাবে লুজন ইকোনমিক করিডোরের সূচনা করেন। জাপান, ফিলিপিন্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের পরে ঘোষিত লুজন ইকোনমিক করিডোর হল ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে পার্টনারশিপ ফর গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট (পিজিআইআই) করিডোরের একটি অংশ, যা ফিলিপিন্সের সুবিক বে, ক্লার্ক, ম্যানিলা এবং বাটাঙ্গাসকে সংযুক্ত করে।
বাইডেনের জন্য এই অঞ্চলে চিনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইন্দো-প্যাসিফিকের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য এটি একটি উপযুক্ত মুহূর্ত। ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে দু’টি বিদ্যমান যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে দেশের অভ্যন্তরে ক্লান্তি ক্রমশ বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমান নির্বাচনী চক্রে এই ব্যাপক অসন্তোষ রাজনৈতিক অস্থিরতায় রূপান্তরিত হয়েছে, যা ইউক্রেন ও ইজরায়েলকে সহায়তার অনুমোদন জোগানোর নিরিখে মার্কিন কংগ্রেসের অভ্যন্তরে মতবিরোধে স্পষ্ট। দেশ থেকে দূরে ইন্দো- প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক দেশগুলির মধ্যেও এই অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারে যে, ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ও কৌশলগত প্রতিশ্রুতি ইন্দো-প্যাসিফিক থেকে ওয়াশিংটনের মনোযোগ সরিয়ে দিয়েছে। সে দিক থেকে দেখলে এটি অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত যে, বাইডেন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার প্রধান অংশীদার জাপানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করতে চান। এমনটা করার মাধ্যমে বাইডেন ও কিশিদা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক এবং কৌশলগত প্রতিবন্ধকতাগুলির মোকাবিলা করতে চান। আইজেনহাওয়ার যুগের সামরিক জোটের সংস্কার করার মাধ্যমে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎকে উভয় দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব থেকে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রভাব থেকে সুরক্ষিত করেছে। ত্রিপাক্ষিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য ফিলিপিন্সকে সংযুক্ত করার মাধ্যমে বাইডেন হয়তো এই ইঙ্গিতই দিতে চাইছেন যে, জাপান-ফিলি্পিন্স-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জোট দক্ষিণ চিন সাগরে চিনকে মোকাবিলায় সবচেয়ে শক্তিশালী ত্রয়ী হয়ে উঠতে পারে। জাপান ও ফিলিপিন্স উভয়ের জন্য - যারা ক্রমবর্ধমান চিনা আগ্রা্সন, হুমকি এবং গা-জোয়ারির সম্মুখীন হচ্ছে - এক নতুন কৌশলগত অভিপ্রায় হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের দক্ষতার সমন্বয় ঘটানো জরুরি।
ত্রিপাক্ষিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য ফিলিপিন্সকে সংযুক্ত করার মাধ্যমে বাইডেন হয়তো এই ইঙ্গিতই দিতে চাইছেন যে, জাপান-ফিলি্পিন্স-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জোট দক্ষিণ চিন সাগরে চিনকে মোকাবিলায় সবচেয়ে শক্তিশালী ত্রয়ী হয়ে উঠতে পারে।
মার্কিন-জাপান সম্পর্ক সবচেয়ে শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্যতম জোটগুলির অন্যতম এবং জোটের বিষয়ে কংগ্রেসের কোনও বিরোধিতা বা সমস্যা নেই। দ্বিধাবিভক্ত কংগ্রেসে ও গাজায় যুদ্ধবিরতির উদ্দেশ্যে ইজরায়েলকে বাধ্য করার জন্য বাইডেন প্রশাসন খুব সামান্যই প্রচেষ্টা চালিয়েছে… এ হেন পূর্ব ধারণার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক ভাবে বাইডেনকে ভাল সুযোগ প্রদান করেছে দু’টি বিষয়। এবং সেগুলি হল টোকিয়োর সঙ্গে সামরিক সম্পর্কের একটি কৌশলগত সংস্করণ এবং ম্যানিলাকে আশ্বাস প্রদান।
প্রত্নশ্রী বসু অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
বিবেক মিশ্র অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.