Author : Premesha Saha

Published on Jan 17, 2022 Updated 0 Hours ago

চিন বিরোধী প্রচারের ঊর্ধ্বে উঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামগ্রিক ভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার কূটনৈতিক উদ্যোগ বৃদ্ধির চেষ্টা করছে।

আমেরিকা কি অবশেষে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সঠিক ভাবে পা ফেলছে?

মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সম্প্রতি তাঁর সর্ব প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরের সূচনা করেন ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে এবং তার পরেই তিনি মালয়েশিয়া এবং তাইল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে সফরকারী সংবাদমাধ্যমের এক কর্মী কোভিড-১৯ দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার ফলে তাঁর সফরটি অনভিপ্রেত ভাবে গুটিয়ে আনতে হয়। ব্লিঙ্কেন তাইল্যান্ডের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং বিদেশমন্ত্রী ডন প্রমুদউইনাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই তাঁর সফর শেষ করছেন। এই সফর এমন এক অঞ্চলে বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রথম পদক্ষেপ যা ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় আমেরিকা-চিন বৈরিতার মাঝে জড়িয়ে পড়েছে। এই সফরের প্রধান বার্তাটি ছিল ‘অঞ্চলটিতে ব্যাপক পরিমাণে বিনিয়োগ না করলেও চিনের তুলনায় অংশীদার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উন্নততর বিকল্প।’ ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতায় আসার পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ব্যক্তিগত ভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও প্রচেষ্টাই করেননি এবং এর ফলে বাইডেন প্রশাসনের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের সূচনা মোটেও সুখকর হয়নি। কিন্তু ২০২১ সালের জুন মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি সেক্রেটারি অফ স্টেট ওয়েন্ডি শেরম্যান ইন্দোনেশিয়া, তাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়ায় সফর করেছেন। অতি সম্প্রতি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসও ২০২১ সালের আগস্ট মাসে সিঙ্গাপুর এবং ভিয়েতনাম সফরে গিয়েছিলেন। এক দিকে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার বন্ধু এবং সহযোগী দেশগুলির কাছে পৌঁছতে দেরি করেছে, তখন অন্য দিকে চিনের স্টেট কাউন্সিলর এবং বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই আসিয়ান বিদেশমন্ত্রীদের সঙ্গে সম্মেলনে শারীরিক ভাবে উপস্থিত থেকেছেন যেখানে তিনি কোভিড-১৯-এর ফলে সৃষ্ট জরুরি অবস্থার প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক সাহায্য এবং অন্যান্য পরিষেবার আশ্বাস দিয়েছেন। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে উচ্চ পর্যায়ের সফরের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কূটনৈতিক উদ্যোগগুলিকে সক্রিয় করে তোলার প্রচেষ্টা চালাবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতায় আসার পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ব্যক্তিগত ভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও প্রচেষ্টাই করেননি এবং এর ফলে বাইডেন প্রশাসনের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের সূচনা মোটেও সুখকর হয়নি।

২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতার সময়ে ব্লিঙ্কেন পাঁচটি মূল নীতির কথা তুলে ধরেন যা স্বাধীন এবং মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির কথাই ব্যাখ্যা করে। এই নীতিগুলি অঞ্চলটির সমমনস্ক অংশীদার এবং বন্ধু দেশগুলি দ্বারাও সমর্থিত। এই মূল নীতিগুলিকে সামনে তুলে ধরার পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের প্রত্যক্ষ বিবাদকে আড়াল করা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলির সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের মজবুতিকরণ সুনিশ্চিত করা। যদিও বিশেষ করে দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের আগ্রাসী পদক্ষেপের উপরে জোর দেওয়া হয়েছে: ‘দক্ষিণ চিন সাগরে বেজিংয়ের কার্যকলাপ প্রতি বছর ৩ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল্য বাণিজ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।’ কিন্তু তাঁর পূর্ববর্তী সফর এবং বক্তব্যের মতো এ ক্ষেত্রে চিনের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল না। এ বারের সফরে এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা চালানো হয় যে, ‘জবরদস্তি এবং ভয়ের বাতাবরণের বাইরেও দেশগুলির অধিকার আছে নিজেদের স্বাধীন পথ বেছে নেওয়ার’ এবং সমগ্র ব্যাপারটি ‘কোনও মার্কিনকেন্দ্রিক অথবা চিনকেন্দ্রিক অঞ্চলের মধ্যকার সংঘাতের বিষয় নয়’। কারণ ইন্দো-প্যাসিফিক নিজেই একটি স্বাধীন অঞ্চল।’ ফলে এই সফরে মার্কিন মনোভাবের একটি সুস্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি এর আগেও বার বার জানিয়েছে যে, তারা কোনও বিশেষ দেশেরই পক্ষাবলম্বন করতে স্বচ্ছন্দ নয়। এ কথায় মার্কিন প্রশাসন শেষ পর্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে।

পূর্বে উল্লিখিত পাঁচটি মূল উপাদান আসিয়ান সদস্য দেশগুলির কাছে আমেরিকার প্রকৃত উদ্দেশ্যের একটি স্পষ্ট ছবি তুলে ধরে যেখানে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে স্বতন্ত্র জায়গা দেওয়া হয়েছে। এবং সেটি যে অঞ্চলটিকে শুধু মাত্র চিনের উত্থানকে রোখার এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেয়ে স্বতন্ত্র, তাও ফুটে উঠেছে। প্রথম নীতিটিতে সমস্যাগুলির প্রত্যক্ষ সমাধান এবং নীতি নির্ধারণের স্বচ্ছতার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এ কথাও বলা হয়েছে, প্রশাসনকে স্বচ্ছ এবং জনহিতকর হতে হবে। দ্বিতীয় নীতিটিতে ‘এই অঞ্চলের মধ্যে এবং তার সীমানার বাইরেও’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় এবং সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য নীতিটি হল এই যে, প্রয়োজনে অঞ্চলটিতে আমেরিকা আরও বেশি পরিমাণে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত। এমনটা ঘোষণা করা হয়েছে এই জল্পনার ভিত্তিতে যে, বাইডেন প্রশাসন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি সুসংহত অর্থনৈতিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি সব সময়েই আমেরিকার কাছে অঞ্চলটিতে আরও বেশি করে বিনিয়োগের দাবি জানিয়ে এসেছে। ফলে আগামী দিনে সুসমন্বিত অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর নির্মাণ এ বিষয়ে এক সদর্থক পদক্ষেপ হয়ে উঠবে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতীতেও ব্লু ডটের মতো পরিকাঠামো এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উদ্যোগের কথা ঘোষণা করেছিল যার প্রধান লক্ষ ছিল চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের তুলনায় উন্নত বিকল্প গড়ে তোলা। কিন্তু তা খুব একটা সফল হয়নি। বর্তমানে চলতে থাকা অতিমারির ফলে চিনের অর্থনীতি ধাক্কা খেতে পারে এবং তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে পারে বি আর আই কর্মসূচির সাফল্য এবং বিনিয়োগের উপরে— এমন জল্পনার মধ্যে দাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি যথার্থ অর্থনৈতিক পরিকাঠামো নির্মাণে ব্রতী হওয়া এক ভাল সুযোগ তৈরি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। চতুর্থত, অতিমারির প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও একটি স্থিতিস্থাপক ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। এবং সবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে সম্ভাব্য সকল ক্রমবর্ধমান বিপদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সুরক্ষার দিকটিকে জোরদার করা। এই বিপদগুলি মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপগুলিকে সময়ের সঙ্গে অভিযোজিত হতে হবে এবং এমনটা জোট গঠন এবং অংশীদারিত্বের মাধ্যমেই করা সম্ভব।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি সব সময়েই আমেরিকার কাছে অঞ্চলটিতে আরও বেশি করে বিনিয়োগের দাবি জানিয়ে এসেছে। ফলে আগামী দিনে সুসমন্বিত অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর নির্মাণ এ বিষয়ে এক সদর্থক পদক্ষেপ হয়ে উঠবে।

ব্লিঙ্কেন তাঁর ভাষণে আসিয়ান দেশগুলির কেন্দ্রিকতার উপরেও জোর দেন এবং আশ্বাস দেন যে, আসিয়ানের কর্মপদ্ধতির উপরে ওয়াশিংটনের এখনও আস্থা রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মায়ানমারের অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে তিনি হিংসাত্মক ঘটনা বন্ধ করতে, অনৈতিক ভাবে আটকে রাখা মানুষদের মুক্তি দিতে এবং মায়ানমারের প্রতি মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে সে দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য বিশ্বব্যাপী দেশগুলিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে মার্কিন প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও তিনি আসিয়ান এবং মায়ানমারের অভ্যুত্থান নেতা মিন আং লাইং-এর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তৈরি হওয়া ‘পাঁচ দফা ঐকমত্য’-এর পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন।

বাইডেন প্রশাসনের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতি গড়িমসির দৃষ্টিভঙ্গি অঞ্চলটি তথা সমগ্র এশিয়ার প্রতি তাঁর প্রশাসনের দীর্ঘমেয়াদি দায়বদ্ধতা নিয়েও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। পাশাপাশি, শুধু মাত্র চিন বিরোধী প্রচার এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সুনির্দিষ্ট নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁর অসমর্থতাও এ ক্ষেত্রে সহায়ক হয়নি। ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারিত্ব থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের সরে যাওয়ার স্মৃতি এখনও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতাদের মনে যথেষ্ট উজ্জ্বল। সুতরাং উচ্চ পর্যায়ের এই সফরগুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে আসিয়ান দেশগুলিকে উচ্চতর বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পাশাপাশি ওয়াশিংটনের কাছ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারিত্ব এবং সুসংহত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের সুসমন্বিত এবং উন্নয়নশীল চুক্তিকে সমর্থন জোগানোর মাধ্যমে আরও বেশি করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াকে সংযুক্ত করার কথাও আশা করা হচ্ছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভৌগোলিক প্রভাবের কথা মাথায় রাখলে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলির ইন্দো-প্যাসিফিক নীতিতে তার অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রয়োজন। তদুপরি এটি এমন একটি অঞ্চল যা শুধু মাত্র দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের সম্প্রসারণবাদী কার্যকলাপেরই সঙ্গে পরিচিত নয়, এটি বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় চিনের বিনিয়োগের শীর্ষ প্রাপকদের মধ্যে একটি। সুতরাং আমেরিকা যদি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার জন্য অংশীদারিত্ব এবং জোট গড়ে তুলতে চায়, তা হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সুদৃঢ় যোগাযোগ গড়ে তোলাও তার জন্য আবশ্যিক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পরিকাঠামোগত উন্নয়নের চাহিদা মেটাতে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক বিনিয়োগের বন্দোবস্ত করাই এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ। সুতরাং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন জাতীয় সুরক্ষা পরিষদের সমন্বয়সাধক কার্ট ক্যাম্পবেল বলেছেন, ‘একটি কার্যকর এশীয় কৌশলের জন্য এবং একটি কার্যকর ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আরও ব্যাপক ভাবে কাজ করা প্রয়োজন।’

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.