Published on Dec 08, 2021 Updated 0 Hours ago

ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সাইক্লোন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে উঠেছে ঋতুবিশেষের বাস্তবতা, এবং এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও ঘনঘন হতে থাকবে ও ক্রমশ আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেবে।

বঙ্গোপসাগরে অ–চিরাচরিত নিরাপত্তা

বৃহৎ শক্তিগুলির প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে চলার ফলে অনেক বেশি নজর পড়েছে চিরাচরিত বা রাষ্ট্রনির্ভর নিরাপত্তার বাড়তি গুরুত্বের দিকে। এই ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা এখনও মোটের উপর ‘‌কী হলে কী হবে’‌ গোত্রের। যেমন, চিন যদি ‘ক’ কাজ করে তা হলে কী হবে?‌ অথবা আমেরিকা–চিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কী প্রভাব খ দেশের উপর পড়বে?‌ এগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাস্য। কিন্তু যখন অ–চিরাচরিত নিরাপত্তা, অর্থাৎ রাষ্ট্রনির্ভর নিরাপত্তার আওতা পেরিয়ে যে সব বিষয় আছে, তা নিয়ে আলোচনা হবে তখন অংশীদারদের সামনে প্রশ্নটা আর ‘‌কী হলে কী হবে’‌ থাকবে না, হয়ে যাবে ‘‌কখন’‌।

ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সাইক্লোন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে উঠেছে ঋতুবিশেষের বাস্তবতা, এবং এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও ঘনঘন হতে থাকবে ও ক্রমশ আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেবে। বঙ্গোপসাগরে যখন বর্ষা দাপিয়ে বেড়াল তখন প্রচুর বাসস্থানচ্যুতি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটল। তখনই ভেবে দেখার সময় হল পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত অ–চিরাচরিত সমস্যার মোকাবিলায় এই অঞ্চলে কী কী বিষয়ে ভাল ভাবে কাজ হচ্ছে, আর নিরবচ্ছিন্ন প্রশ্নগুলোই বা কী।

বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যেখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বেশি আসে, আর তার মধ্যে থাকে কুখ্যাত সাইক্লোনগুলো যার জন্য আন্তর্জাতিক সামরিক সহায়তার প্রয়োজন পড়ে। তারপরেও দেশটি বিপর্যয়ের পর দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা উন্নততর করেছে বিভিন্ন কোস্টাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও শতশত সাইক্লোন শেল্টার তৈরি করে। এই সক্ষমতা অর্জনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারি ছিল গুরুত্বপূর্ণ শক্তিবর্ধক। নিজের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষমতাও বাড়িয়েছে, এবং দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্রতর রাষ্ট্রগুলির ত্রাণের কাজেও এগিয়ে এসেছে। যেমন ২০১৬ সালে শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক বন্যা ও ধসের পর বাংলাদেশের নৌবাহিনী ত্রাণসামগ্রী নিয়ে গিয়েছিল। ২০১৪ সালে মলদ্বীপে জলসঙ্কটের সময়েও বাংলাদেশ ত্রাণের কাজে নেমেছিল।

প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো এত ভয়ঙ্কর হয় যে ত্রাণকাজের জন্য অনেক সময় আন্তর্জাতিক সামরিক সহায়তার প্রয়োজন পড়ে। কতগুলো সুস্পষ্ট ব্যবস্থা ও শর্তের ভিত্তিতে নেতারা নিজেদের দেশে বিদেশি সামরিক বাহিনীকে কাজ করতে দেয়। যে দেশ অনুরোধ করছে তার আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণের পর সামরিক বাহিনীগুলি দ্রুত চলে আসবে, এবং ত্রাণ কাজ শেষ হওয়ার পর ততটাই দ্রুত চলে যাবে, এটাই প্রত্যাশিত। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯১–র সুপার সাইক্লোন ও ২০০৪–এর সুনামির পর বঙ্গোপসাগরে সফল ভাবে বিপর্যয় ত্রাণের কাজ চালিয়েছে। কিন্তু কিছু দেশ এই ধরনের ত্রাণ–সহায়তা দেওয়ার ইচ্ছাকে ভাল ভাবে নেয়নি। বঙ্গোপসাগরে দুটো ঘটনা থেকে দেখা গিয়েছে ত্রাণ–সহায়তা দিতে চাইলেও তা সব সময় গৃহীত হয় না।

২০০৭ সালে বাংলাদেশে আছড়ে পড়েছিল সাইক্লোন সিড্র। তার পর ভারতের বিপর্যয় ত্রাণকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর ও ঢাকা বিমানবন্দরে। ভারতের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে ভারত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণকাজের জন্য অনেকগুলি হেলিকপ্টার পাঠাতে চেয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তা গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশ নৌক্ষেত্রে এবং ফিক্সড–উইং এয়ারক্র‌্যাফটের সহায়তা নিতে তৈরি ছিল, কিন্তু দূরবর্তী অঞ্চলে রোটারি উইং বিমানের মাধ্যমে সহায়তা নিতে রাজি হয়নি।

আর একটা উদাহরণ হল ২০০৮–এ মায়ানমারে সাইক্লোন নারগিসের পরের ত্রাণকাজ। যদিও মায়ানমারের জলসীমার কাছে মার্কিন এসেক্স এক্সপিডিশনারি স্ট্রাইক গ্রুপ ২২ দিন অপেক্ষা করেছিল, সে দেশের সামরিক শাসকেরা নৌ–ত্রাণের অনুমতি দেননি। কিন্তু সেই সময় মায়ানমার নেতৃত্ব ভারত ও তাইল্যান্ডের উপর আস্থা রেখে তাদের চিকিৎসক দলকে ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের ত্রাণে যেতে দিয়েছিল। আবার মার্কিন নৌ–সহায়তা না–নেওয়া হলেও মার্কিন বিমান বাহিনীর সহায়তা কিন্তু নেওয়া হয়েছিল, আর তা থেকেই স্পষ্ট কী ধরনের সহায়তা দিতে চাওয়া হচ্ছে তা ক্ষতিগ্রস্ত দেশের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এই উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর ক্ষতিগ্রস্ত দেশটির স্পর্শকাতরতা বোঝাটা কতটা আবশ্যক। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় পরিবেশের নানা অ–চিরাচরিত বিপদের মাত্র একটি। জলবায়ু পরিবর্তনে কার্বন নিঃসরণের ভূমিকা ছাড়াও বিভিন্ন অংশীদারদের আরও মনোযোগ দিতে হবে বঙ্গোপসাগরের অন্য সেই সব সঙ্কটের দিকে যা মানুষের অতীত কাজকর্ম থেকে উদ্ভূত, কারণ সেগুলোর আশু ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে।

একটি জাহাজ–দুর্ঘটনার পর তেল ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে ভারত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তের মরিশাস ২০২০ সালের জুলাই মাসে ‘‌পরিবেশগত জরুরি অবস্থা’‌ জারি করেছিল। তার কিছুদিন পরেই বঙ্গোপসাগরেও একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। ২০২০–র সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কার পূর্ব উপকূলে একটা তেলের ট্যাঙ্কারে আগুন লেগে গেলে ২৫ মাইল এলাকায় ডিজেল ছড়িয়ে পড়ে। আরও খারাপ ঘটনা ঘটে ২০২১–এর মে মাসে, যখন একটি মালবাহী জাহাজ আগুন লাগার পর ডুবে যায়, আর তার বাহিত সামগ্রী ছড়িয়ে পড়ে জলে ও সমুদ্রতীরে। এখনও অবধি ধ্বংসাবশেষের ৪০০ খণ্ড শ্রীলঙ্কার পশ্চিম তটের কাছে সমুদ্রপৃষ্ঠে ছড়িয়ে আছে বলে অনুমান। ২০২১ সালেই একটি চিনা রকেটের ধ্বংসস্তূপ ভারত মহাসাগরে পড়েছিল মলদ্বীপের কাছে।

এই ধরনের মানুষের–কারণে–ঘটা বিষয়গুলোর জন্য পরিবেশগত ক্ষতি কী হবে তা এখনই পুরোটা বোঝা দুষ্কর। পরিবেশগত ক্ষতি ছাড়াও শ্রীলঙ্কা ও মলদ্বীপ অর্থনৈতিক ভাবে পর্যটনের উপর নির্ভরশীল, যা তাদের অতি–প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারের উৎস। স্থানীয় মানুষের জন্য মৎস্য সম্পদও একই ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

বঙ্গোপসাগরে অ–চিরাচরিত নিরাপত্তা সমস্যার ব্যাপ্তি ও গুরুত্ব এখন ভাল ভাবেই জ্ঞাত, এবং তার সঙ্গে লড়াই করে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রেও অনেক দূর এগনো সম্ভব হয়েছে। তা হলেও বিপর্যয়–উত্তর ত্রাণ পাঠানোর ক্ষেত্রে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো মুখ্য শক্তিধর দেশগুলোকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর আমন্ত্রক দেশগুলোর সংবেদনশীলতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তা ছাড়া মানুষের–কারণে–ঘটা এখনকার বিপর্যয়গুলো, যেমন জাহাজ–দুর্ঘটনা, পরিবেশগত নিরাপত্তার বড়সড় বিপদের কারণ হলেও অনেক সময় তা নজর এড়িয়ে যায়। মানুষের বেহিসাবের মোকাবিলার দিকটি নিয়ে স্বতঃসক্রিয়তা, আর তার সঙ্গে বিপর্যয়ের পর ঘুরে দাঁড়ানোর অধিক ক্ষমতা, এই দুটির সমন্বয়ে আগামী বছরগুলোতে বঙ্গোপসাগরে অ–চিরাচরিত নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিপদজনিত পরিস্থিতির মোকাবিলা অনেকটা ভাল ভাবে করা সম্ভব হবে।


নিলন্থি সমরনায়কে ওয়াশিংটন এলাকার অলাভজনক গবেষণা সংস্থা সিএনএ স্ট্র‌্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি অ্যানালিসিস প্রোগ্র‌্যামের ডিরেক্টর। বিপর্যয়উত্তর ত্রাণ  স্থিতিস্থাপকতাসহ চিরাচরিত নিরাপত্তার প্রশ্নগুলো নিয়ে তিনি কাজ করেন। মতামতগুলো তাঁর নিজস্ব, এবং যে সব সংস্থার সঙ্গে তিনি জড়িত তাদের নয়।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.