রাজনীতিতে অস্বচ্ছতা ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সেই অস্বচ্ছতা আরও বেশি গাঢ়। যত্নবান না হলে দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব কূটনীতিকদের দ্বারা গড়ে তোলার চাইতে দ্রুত হারে ভেঙে পড়তে পারে। আর দেশীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে তা আরও বেশি সমস্যাজনক হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক একটি কঠিন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে চলেছে এবং ক্রমশ বাড়তে থাকা সঙ্কট কয়েক মাস আগেও প্রাণবন্ত থাকা অংশীদারিত্বকে অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলেছে। এই উত্তাল পরিস্থিতিকে সামাল দিতেই বিদেশসচিব বিক্রম মিসরি ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকা সফরে যান, যেখানে তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর ঘনিয়ে আসা ‘কালো মেঘ’ দূর করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন এবং ‘একটি ইতিবাচক, গঠনমূলক ও পারস্পরিক লাভজনক অংশীদারিত্ব’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই আহ্বানে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সমর্থন পান, যিনি মিসরির মতামতকেই পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন।
উচ্চ পর্যায়ের সমন্বয় শক্তিশালী জনসংযোগকে ত্বরান্বিত করেছিল, যখন উভয় দেশ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক পরিসরে বৃহত্তর প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করার জন্য একজোট হয়ে কাজ করেছিল।
কিন্তু কাজের মাধ্যমেই কথার প্রমাণ মিলবে। প্রকৃতপক্ষে, এমনটা বাস্তবে মনে করা হয়েছিল যে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারত যে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে, নয়াদিল্লি-ঢাকা সম্পর্কে এক চাপানউতোর আসতে চলেছে। উচ্চ পর্যায়ের সমন্বয় শক্তিশালী জনসংযোগকে ত্বরান্বিত করেছিল, যখন উভয় দেশ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক পরিসরে বৃহত্তর প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করার জন্য একজোট হয়ে কাজ করেছিল। মানুষ এ কথা সহজেই ভুলে গিয়েছে যে, ২০০৯ সালে হাসিনার ক্ষমতায় আসার আগে এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কতটা বিষাক্ত ছিল এবং গত কয়েক বছরের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ‘সুবর্ণ যুগ’ কী ভাবে সম্পর্কটিকে গভীরতর করার জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছিল।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের ফলে ভারতকে বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে নতুন করে মানিয়ে নিতে হবে ও সম্পৃক্ত হতে হবে। এই উদীয়মান বাস্তবতাই দক্ষিণ এশিয়ার এই জটিল সম্পর্ককে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ফেলেছে। অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের মূল অংশীদারদের তরফে ভারত-বিরোধী মন্তব্য সরকারি সম্পৃক্ততার বাতাবরণকে নষ্ট করেছে এবং এই সব কিছুর নেপথ্যে থেকেছে বিশেষ করে বাংলাদেশি হিন্দুদের মতো সংখ্যালঘুদের উপর হিংসার ঘটনা ও মন্দিরে হামলার মতো এমন ঘটনা, যা দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী সামাজিক সংযোগকে বিপন্ন করে তুলেছে।
এই ক্রমবর্ধমান বিভাজনের সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ হল চট্টগ্রামভিত্তিক হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে সাম্প্রতিক গ্রেফতার, তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে গৃহীত আইনি পদক্ষেপের দরুন – চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিনের আবেদন আবারও আদালত কর্তৃক খারিজ হয়েছে - ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশি দূতাবাসকে লক্ষ করে বিক্ষোভের ঘটনা।
উভয় পক্ষের সক্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা এই অবনমনের ধারাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছেন, যা কূটনীতিকদের কাজকে আরও কঠিন করে তুলেছে। ভারতের জন্য বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ মন্থন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং বাংলাদেশের জন্য ভারতে শেখ হাসিনার অব্যাহত উপস্থিতি একটি শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ। কারণ বিচারের জন্য হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
গত কয়েক মাসে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের দরুন দেশীয় রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতামূলক আধিপত্যের কারণে মিসরির সফর এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ঘটেছে, যা দুই দেশকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা, জ্বালানি, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন সহযোগিতার উপর মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করেছে, যা সম্পর্কের পাশাপাশি বিস্তৃত অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশের জন্য প্রধান বিপদ হল, গত কয়েক বছরে তার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে, যদি না দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
ঢাকার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে নয়াদিল্লি সঠিক পথেই হেঁটেছে। এখন বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক প্রশাসনকেও একই সদিচ্ছা দর্শাতে হবে। দেশটির সামনে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে এবং কয়েক মাস ক্ষমতায় থাকার পরেও অন্তর্বর্তী সরকারের দেশে সুশাসন ফিরিয়ে আনার ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠেছে।
অর্থনৈতিক বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যেহেতু রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের লড়াই একটি একত্রিত জাতীয় প্রতিক্রিয়ার পথে অন্তরায় হয়ে উঠেছে। সামগ্রিক প্রশাসনের ভেঙে পড়া স্পষ্ট এবং ভারতকে দোষারোপ করা আদৌ কোনও বাস্তব সমাধান নয়। বাংলাদেশের জন্য প্রধান বিপদ হল, গত কয়েক বছরে তার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে, যদি না দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। দুর্ভাগ্যবশত, ক্ষমতায় শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে এখন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা পাকিস্তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করা প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন।
হাসিনার শাসনামলে ভারত ও বাংলাদেশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপর দুই দেশের মনোযোগ জ্বালানি, সংযোগ ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি বৃহত্তর অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছিল। কিন্তু এমনটা অনুমান করা কল্পনাসমই হবে যে, এই সম্পর্কেও চাপানউতোর ছিল না। হাসিনার শাসনামলে উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলি ছিল সীমান্ত নিরাপত্তা, অভিন্ন সাধারণ নদীর জল বণ্টন ব্যবস্থা এবং অভিবাসন।
এ ছাড়াও, হাসিনা ভারত ও চিনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারদর্শী ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই চিন বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়। তা সত্ত্বেও দিল্লি ও ঢাকা হাসিনার অধীনে নিজেদের সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। কারণ উভয় পক্ষই রাজনৈতিক আস্থা নির্মাণে ব্রতী ছিল এবং একে অপরের মূল উদ্বেগের কথা নিয়ে আলোচনা চালাতে ইচ্ছুক ছিল।
ভূগোল অনুযায়ী, ভারত ও বাংলাদেশ অভিন্ন সাধারণ সীমান্তবিশিষ্ট প্রাকৃতিক অংশীদার এবং উভয় দেশের মধ্যে সংস্কৃতি ও পারস্পরিক জৈব নির্ভরতা রয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমীকরণের ঊর্ধ্বে।
নয়াদিল্লি ইঙ্গিত দিয়েছে যে, ইউনূস সরকারের সমস্ত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ভারত ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণে এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক। তবে এমনটা করার জন্য এমন এক অংশীদারের প্রয়োজন হবে, যিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সম্পর্ককে দেখতে সক্ষম। ভূগোল অনুযায়ী, ভারত ও বাংলাদেশ অভিন্ন সাধারণ সীমান্তবিশিষ্ট প্রাকৃতিক অংশীদার এবং উভয় দেশের মধ্যে সংস্কৃতি ও পারস্পরিক জৈব নির্ভরতা রয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমীকরণের ঊর্ধ্বে। আগামিদিনের পথ কঠিন বলে মনে হলেও দুই প্রতিবেশী দেশকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে, যেহেতু দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ এক শক্তিশালী দিল্লি-ঢাকা সম্পৃক্ততাতেই নিহিত।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দি ইকোনমিক টাইমস-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.