-
CENTRES
Progammes & Centres
Location
ট্রাম্পের অধীনে ওয়াশিংটনে ‘বিজার্’ বা ‘কিম্ভুত’ শব্দবন্ধটি নতুন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
প্রথমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যগুলিকে এলোমেলো ও অসংলগ্ন বলে মনে হয়েছিল। ডেনমার্কের কাছ থেকে গ্রিনল্যান্ড কেনার জন্য তাঁর ইচ্ছা, কানাডাকে আমেরিকার একটি মহান ৫১তম স্টেট হিসেবে সংযুক্ত করা, পানামা খাল পুনরুদ্ধার করা, মেক্সিকো উপসাগরের নাম পরিবর্তন করা এবং বৈদেশিক নীতির একটি উপকরণ হিসাবে শুল্ক আরোপের বিষয়ে তাঁর প্রবণতা কেবল উদ্ভটই ছিল না। উনিশ শতকের সাম্রাজ্যবাদের স্বর্ণযুগ থেকেই এ হেন সিদ্ধান্তের প্রবণতা চলে আসছে - এমন এক সময়ে যখন বৈদেশিক ভূখণ্ড বলপূর্বক দখল করা যেত, স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে তার উল্লেখ না করেই তা কেনা-বেচা করা সম্ভব হত এবং এই ভাবে বাণিজ্যিক অর্থনীতি সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
হতবাক মিত্র ও প্রতিবেশ অঞ্চলের তরফে এ হেন অধিগ্রহণের মন্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া এসেছে দ্রুত এবং স্বাভাবিক ভাবেই তা ক্ষোভে পরিপূর্ণ। আর অন্য দিকে ওয়াশিংটন ডিসির প্রতি ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন বন্ধু দেশগুলি প্রাণপণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে যে, ট্রাম্পের এ হেন মন্তব্যটিকে কী ভাবে দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পসুলভ ‘দ্য আর্ট অফ দ্য ডিল’ বা ‘বাজি রাখার অন্যতম কৌশল’ হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
ওয়াশিংটনে ‘বিজার্’ নতুন শব্দ হয়ে উঠেছে। হোয়াইট হাউসে ইজরায়েলি প্রাইম মিনিস্টার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে গাজা সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের ৪ ফেব্রুয়ারি করা মন্তব্যটি এই নতুন বাস্তবতাকেই দর্শায়। হোয়াইট হাউসের যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক আবহে এবং একটি লিখিত পাঠ্য থেকে পড়ার সময় ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাজা স্ট্রিপ দখল করবে এবং আমরা এটিকে কাজে লাগাব…... আমরা এটির মালিকানা নেব এবং এটি সম্পর্কে দায়বদ্ধ থাকব...। আমরা এই টুকরো অংশ দখল করতে চলেছি এবং এটির উন্নয়ন ঘটাব।’
এর পাশাপাশিই তিনি যোগ করেছেন যে, ট্রাম্প এটিকে ‘দীর্ঘমেয়াদি মালিকানার অবস্থান’ বলে মনে করছেন এবং ‘এই সিদ্ধান্ত হালকা চালে গ্রহণ করা হয়নি।’ এই কথা শোনার পরে নেতানিয়াহুর চোখেমুখে সন্তুষ্টি প্রকাশ পায়। ট্রাম্প আরও বলেন, তিনি আশা করেন যে, জর্ডন ও মিশর গাজা থেকে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দেবে। রাজা আবদুল্লাহ দ্বিতীয় এবং প্রেসিডেন্ট এল-সিসিকে এমনটা করানোর জন্য রাজি করার বিষয়ে তিনি আত্মবিশ্বাসী। কারণ এর আগেই ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, মার্কিন ত্রাণ ট্রাম্পকে ওই দুই ক্ষমতাধরের উপর প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি্র সুবিধে করে দিয়েছে।
তবে এটি নেহাতই ট্রাম্পের এলোমেলো চিন্তাভাবনার ফসল নয়। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে করা তাঁর মন্তব্য থেকেই ট্রাম্পের ইচ্ছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। জর্ডন ও মিশর-সহ আরব বিদেশমন্ত্রীদের একটি জোটের তরফে ১ ফেব্রুয়ারি কায়রো থেকে জারি করা একটি যৌথ বিবৃতিতে এই বক্তব্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘তাঁদের ভূমি থেকে ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তর বা উৎখাত’ করার যে কোনও পরিকল্পনাকে উত্সাহ জোগানোর বিষয় আসলে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলবে, সংঘাত বৃদ্ধি করবে এবং শান্তির সম্ভাবনাকে ক্ষুণ্ণ করবে।
সৌদি বিদেশ দফতর ট্রাম্পের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, ‘ইজরায়েলি বন্দোবস্ত নীতির মাধ্যমে হোক, ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করা হোক বা ফিলিস্তিনি জনগণকে তাঁদের ভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত করার চেষ্টা হোক না কেন… ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ অধিকারের কোনও প্রকারের লঙ্ঘনকে রিয়াধ সম্পূর্ণ ভাবে প্রত্যাখ্যান করে।’
রাজা আবদুল্লাহ দ্বিতীয় এবং প্রেসিডেন্ট এল-সিসিকে এমনটা করানোর জন্য রাজি করার বিষয়ে তিনি আত্মবিশ্বাসী। কারণ এর আগেই ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, মার্কিন ত্রাণ ট্রাম্পকে ওই দুই ক্ষমতাধরের উপর প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টির সুবিধে করে দিয়েছে।
বিবৃতিতে আরও যোগ করা হয়েছে, ‘বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কর্তব্য হল ফিলিস্তিনি জনগণের উপর যে গুরুতর মানবিক দুর্ভোগ নেমে এসেছে, সেটি লাঘব করার জন্য একজোট হয়ে কাজ করা। ফিলিস্তিনি জনগণ নিজের ভূমির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে এবং সেখান থেকে একচুলও নড়বে না।’
প্রেসিডেন্ট এল-সিসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী ও ধারাবাহিক অংশীদার হলেও ট্রাম্পের মন্তব্য মিশরকে এক কঠিন পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের অধীনে মিশরের উদ্যোগ ছিল উল্লেখযোগ্য যা ১৯৭৮ সালে যুদ্ধের অবসান এবং ইজরায়েলের সঙ্গে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ক্যাম্প ডেভিড অ্যাকর্ডস-কে চালিত করে। কিন্তু শান্তির সুফলকে কাজে লাগানোর পরিবর্তে মিশর নিজে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে, যেখানে ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে মিশর ইজরায়েল-গাজা সংঘাতের পরবর্তী ডামাডোল সামলানোর কাজে বাধ্য হয়েছে। গত ১৫ মাসে মিশরীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করেছেন এবং কাতার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে কাজ করেছেন, যাতে বিদ্যমান যুদ্ধবিরতির কৌশল এবং ইজরায়েলি ও ফিলিস্তিনি বন্দিদের একযোগে মুক্তির বিষয়টি সহজ করা যায়। মিশরকে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দিতে হবে… এ হেন হুমকি এমন একটি সত্যিকারের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে যে, ট্রাম্পের অপ্রয়োজনীয় উস্কানি শুধু মিশরের নতুন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকেই হুমকির মুখে ফেলে না, বরং এই জ্বলন্ত আবেগ মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও প্রভাবিত করতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর এক কট্টর মিত্র জর্ডনও একই ধরনের বিড়ম্বনায় পড়েছে। ১৯৪৮ সালের নাকবা এবং ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের ফলস্বরূপ, দেশটি ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের দু’টি বৃহৎ প্রবাহের সম্মুখীন হয়েছে, যার আনুমানিক পরিমাণ দেশের ১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার ৫০-৬০ শতাংশ। ১১ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সময় শালীন ও প্রজ্ঞাবান রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ আক্ষরিক অর্থেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।
মিশর, জর্ডন এবং বৃহত্তর আরব বিশ্বের এই তাৎক্ষণিক উদ্বেগের উর্ধ্বে উঠে একগুচ্ছ প্রশ্ন যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাকেই অস্বীকার করে। যুদ্ধবিরতির পর উত্তর গাজায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনির ধ্বংস হওয়া বাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার নানাবিধ চিত্র প্রকাশ্যে এসেছে। এই ছবি এ কথাই দর্শায় যে, ফিলিস্তিনিরা শান্তিতে বসবাসের জন্য তাঁদের জীবন পুনর্নির্মাণ করতে চান। ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তাঁর পরিকল্পনার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে সে দেশে মার্কিন সেনা মোতায়েন করতে পারেন।
যুদ্ধবিরতির পর উত্তর গাজায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনির ধ্বংস হওয়া বাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার নানাবিধ চিত্র প্রকাশ্যে এসেছে। এই ছবি এ কথাই দর্শায় যে, ফিলিস্তিনিরা শান্তিতে বসবাসের জন্য তাঁদের জীবন পুনর্নির্মাণ করতে চান।
ট্রাম্প প্রশাসন কি জনগণের বলপূর্বক বাস্তুচ্যুতির বৈধতার কথা বিবেচনা করেছে? সেই বাস্তুচ্যুতি কি অস্থায়ী না কি স্থায়ী? তাঁরা কী ভাবে ফিলিস্তিনিদের তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে স্থানান্তর করবেন? সে ক্ষেত্রে কি বোমার মাধ্যমে তাঁদের বিলুপ্তিই একমাত্র পথ হবে, যা কি না ইজরায়েলের পক্ষাবলম্বী? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কি ওয়েস্ট ব্যাঙ্ককে সংযুক্ত করার নেতানিয়াহুর উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করবে? এবং ট্রাম্প কি এই ধরনের দ্বন্দ্ব থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনার নিজস্ব প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও আর একটি চিরকালীন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাকে বিবেচনা করবেন? তেমনটা হলে তা কী ভাবে ট্রাম্পের এমএজিএ সমর্থকদের বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের সঙ্গে সমাপতিত হবে?
ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়িত করতে ও নিজের দেশের সীমান্ত বন্ধ করতে আগ্রহী হলেও তিনি চান, মিশর ও জর্ডন যেন উদার ভাবে কয়েক লক্ষ মানুষকে আশ্রয় দেয়। এই সকল মানুষের পুনর্বাসনের জন্য অর্থ কে প্রদান করবে? মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা তৈরি করার জন্য কে অর্থ জোগাবে, যা ট্রাম্প হঠাৎ গাজার জন্য পরিকল্পনা করেছেন? ট্রাম্পের জামাই জ্যারেড কুশনার যেমনটা অনুমান করেছিলেন, সেই সুবিশাল জলরাশি সংলগ্ন অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বেসরকারি পুঁজি ও রিয়েল-এস্টেট ডেভেলপারই বা কারা? এত বছর ফিলিস্তিনিরা সমস্ত যন্ত্রণা ও বেদনা সহ্য করার পর গাজা কি এখন শুধু মাত্র রিয়েল এস্টেটের খেলায় পরিণত হয়েছে?
সম্প্রতি জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে গিডিয়ন লেভি এবং নাথান থ্রালের নৈতিক স্বচ্ছতা, অভি শ্লেইমের বৃত্তি, পঙ্কজ মিশ্রের সহানুভূতি এবং সেলমা দাবাঘের আবেগপূর্ণ বক্তব্য সুপঠিত দর্শকদের মনে আশার আলো জ্বালিয়েছিল। তবে ৪ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্পের ঘোষণায় ফিলিস্তিনিদের আশা-আকাঙ্ক্ষার উপর আবারও শঙ্কার কালো ছায়া নেমে এসেছে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য ট্রিবিউন-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.