এই প্রতিবেদনটি ‘রিইগনাইটেড অ্যাজেন্ডাস: ট্রাম্প’স রিটার্ন অ্যান্ড ইটস গ্লোবাল রিপারকেশন’ সিরিজের অংশ।
২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্ণায়ক বিজয়কে মধ্যপ্রাচ্যের অনেকেই ইতিবাচক বলে মনে করছেন। গাজায় যুদ্ধ নিরবচ্ছিন্ন ভাবেই অব্যাহত রয়েছে এবং সিরিয়ায় ইজরায়েলি সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি লেবাননে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া এবং ইয়েমেন পর্যন্ত এলাকাব্যাপী এই যুদ্ধের সম্প্রসারণের আশঙ্কা বাড়ছে। মনে করা হচ্ছে যে, ট্রাম্প একই সঙ্গে ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন পক্ষকে শত্রুতা বন্ধ করার বিষয়ে চাপ দেবেন।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি ছিল অন্য রকম। তাঁর প্রশাসনের অধীনেই ঐতিহাসিক আব্রাহাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা ২০২০ সালে আরব রাষ্ট্র এবং ইজরায়েলের একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ককে স্বাভাবিক করে তুলেছিল। চুক্তিগুলি গাজায় সঙ্কটের প্রেক্ষিতে এখনও খারিজ না হয়ে গেলেও বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা অব্যাহতও রয়েছে এবং শত্রুতার কোনও শেষ নেই। আরব-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব স্পষ্ট এবং ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের পর থেকে এই অঞ্চলের বাস্তবতা ব্যাপক ভাবে বদলে গিয়েছে। বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলির সমাধান করাও কঠিন। কারণ ট্রাম্প আশা করেন যে, সমস্ত পক্ষকেই তিনি দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে সহমত পোষণ করাতে সক্ষম হবেন। এমনটা করার জন্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ইজরায়েলের প্রাইম মিনিস্টার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে, যিনি জো বাইডেনের বিদায়ী প্রশাসনের আহ্বানগুলিকে মূলত উপেক্ষা করেছেন। পরিবর্তে, নেতানিয়াহু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইজরায়েল শক্তি সমীকরণকে প্রতিসম দেখাতে সক্ষম হয়েছেন, যেখানে ইজরায়েল একটি পরাশক্তি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যম শক্তির মতো কাজ করেছে।
বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলির সমাধান করাও কঠিন। কারণ ট্রাম্প আশা করেন যে, সমস্ত পক্ষকেই তিনি দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে সহমত পোষণ করাতে সক্ষম হবেন।
যাই হোক, কৌশলগত ভাবে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন মধ্যপ্রাচ্যের কিছু মূল নিরাপত্তা অবকাঠামোকে এমন একটি সময়ে নজরের আলোয় তুলে এনেছে যখন ইতিমধ্যে আঞ্চলিক সংঘাত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অঞ্চলটির পুনর্নির্মাণ চলছে। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ইজরায়েলের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে বলেছেন, তারা যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে ইরানের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে না ফেলে। রিয়াধ ও তেহরানের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও - যারা চির আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী রয়ে গিয়েছে - সৌদিরা বৃহত্তর ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধে সম্পৃক্ত না হতে বদ্ধপরিকর। সর্বোপরি, আরব বিশ্বের সমাধান করার মতো নিজস্ব ধাঁধা রয়েছে। সবচেয়ে বড় ধাঁধাটি হল ফিলিস্তিনি সঙ্কটের নিরিখে সঠিক নৈতিক অবস্থান নেওয়া সংক্রান্ত ভারসাম্য বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে অর্থনৈতিক লাভ রক্ষা করা।
ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে, যেমনটি তিনি তাঁর প্রথম মেয়াদে করেছিলেন। যাই হোক, ২০২৫ সালের সম্পৃক্ততার নিয়মগুলি ২০১৬ সালের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। ইরাকের মতো জায়গায় মার্কিন অবকাঠামোগুলি ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর-এর (আইআরজিসি) মদতপুষ্ট জঙ্গিহামলার শিকার হয়েছে। ওয়াশিংটন প্রতিক্রিয়া জানালেও সরাসরি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি। ট্রাম্প সিরিয়া থেকে প্রায় ৯০০ মার্কিন সৈন্যের অপসারণের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তবে তাঁর পূর্ববর্তী উপদেষ্টারা ট্রাম্পকে এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেন। এই ৯০০ সৈন্য সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্সের নৈতিক সাহায্যকারী ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা কুর্দি নেতৃত্বাধীন সামরিক ইউনিয়ন তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের (আরবিতে আইএসআইএস বা দায়েশও বলা হয়) সঙ্গে লড়াই করার জন্য এবং আইএসআইএস-পন্থী জঙ্গিদের থাকার অস্থায়ী কারাগারগুলি বজায় রাখার জন্য দায়ী। ইরানের নজর রাখার ঘটনা ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পুনরায় সম্পৃক্ত করে তুললেও এ কথা মনে রাখা জরুরি যে, এ হেন ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জন বোল্টন এর আগে ট্রাম্পের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার বা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছিলেন এবং তাঁর মতে, ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করা অত্যন্ত বিরক্তিকর।
ট্রাম্প সিরিয়া থেকে প্রায় ৯০০ মার্কিন সৈন্যের অপসারণের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তবে তাঁর পূর্ববর্তী উপদেষ্টারা ট্রাম্পকে এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেন।
এর ফলে অঞ্চলটি একাধিক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। ইরানের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্কের ইতিহাস দর্শায় যে, ব্যক্তিগত স্বার্থ অব্যাহত থাকবে। এটিতে একই সঙ্গে মার্কিন স্বার্থ বা সুবিধার বিরুদ্ধে তেহরানের প্রক্সিগুলির আরও সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনাও জোরদার করেছে, যা শিয়া রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মার্কিন সামরিক প্রতিক্রিয়াকে উস্কে দিতে পারে। মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট বা বিচার বিভাগ অভিযোগ করেছে যে, ট্রাম্পকে হত্যার ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে ইরানও ছিল। ইরান এই ধরনের কোনও চক্রান্তের অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে ট্রাম্প ও ইরানের মধ্যে উচ্চ-বাজিসম্পন্ন দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। যুদ্ধের নিষ্পত্তি সংক্রান্ত ট্রাম্পের নিজস্ব আখ্যান সত্ত্বেও এই সব কিছুই ইরানের জমিতে প্রত্যক্ষ মার্কিন কার্যকলাপের সম্ভাবনাকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়িয়ে তুলবে। ইরানও একই ধরনের হিসেব-নিকেশের পথে হেঁটে প্রত্যক্ষ সংঘাত এড়িয়ে যেতে চাইবে, যেমনটা বাইডেন প্রশাসনের অধীনে প্রায় সুনিশ্চিত ছিল। ইরানের ফরেন মিনিস্টার আব্বাস আরাগচি বলেছেন, ‘আমাদের স্বার্থ সুরক্ষিত হলে আমরা আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা করব।’
অন্য দিকে, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পের ইরান-বিরোধী অবস্থানের উপর ভিত্তি করে তাঁর উপর বাইডেন এবং ডেমোক্র্যাটদের তরফে সৃষ্ট রাজনৈতিক চাপ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। এই চাপ সৃষ্টি হয় যখন গাজা ও লেবানন উভয় জায়গাতেই নাগরিক হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্প উভয়েই ইরান সম্পর্কে একই মনোভাব পোষণ করলেও এবং গোপনে আরব শক্তিগুলিও নিজেদের মনোভাব তাদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেও ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির দিকে অগ্রসর না হয়ে ইজরায়েলকে তার বর্ধিত সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেবেন বলে মনে হয় না। নেতানিয়াহুর জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে, যেহেতু আগামী দিনে ট্রাম্পের জন্য তাঁকে বেশ কিছু ছাড় মঞ্জুর করতে হতে পারে এবং তাঁর ক্ষেত্রে নীতির বদলে ব্যক্তিত্বের উপর ভিত্তি করে বাজারযোগ্য সাফল্য, ফটো-অপস এবং ‘যুদ্ধের সমাপ্তি’র আখ্যানের বাস্তবায়ন প্রধান লক্ষ্য হতে চলেছে।
নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্প উভয়েই ইরান সম্পর্কে একই মনোভাব পোষণ করলেও এবং গোপনে আরব শক্তিগুলিও নিজেদের মনোভাব তাদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেও ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির দিকে অগ্রসর না হয়ে ইজরায়েলকে তার বর্ধিত সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেবেন বলে মনে হয় না।
মার্কিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, হামাস বা ইজরায়েল কেউই জায়গা ছাড়তে এবং সমঝোতা করতে প্রস্তুত নয়। হামাসের দুই মূল নেতা, ইসমাইল হানিয়াহ এবং ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে ইজরায়েল হত্যা করার সঙ্গে সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য নেতাদের অপসারণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষোভের ঊর্ধ্বে উঠতে সমর্থ হয়েছে। হানিয়াহকে তেহরানের কেন্দ্রে হত্যা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েল এখনও পর্যন্ত বন্দিমুক্তি ও সামরিক অভিযানের মতো বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে সহমত পোষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
অবশেষে, ট্রাম্পের নির্বাচনকারীরা - যাঁরা তাঁকে এ বার হোয়াইট হাউস চালাতে সাহায্য করবেন – সম্পূর্ণ রূপে সেই প্রথাগত রক্ষণশীল হবেন না, যাঁরা রিপাবলিকান এবং ক্যাপিটল হিলের সঙ্গে পরিচিত। বরং, তাঁরা ট্রাম্পের নিজস্ব সমর্থন ভিত্তি থেকে উঠে এসেছেন এবং তিনি যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেখান থেকে আসে্ননি। এটি মধ্যপ্রাচ্যের সকল অংশীদারের জন্যই অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি করেছে। আপাতত, ট্রাম্প এই অঞ্চলটির জন্য ভবিষ্যতে কী করতে চলেছেন, তা এখন অনুমান সাপেক্ষ। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা ও প্রভাবের অভিক্ষেপ নির্ভর করবে ট্রাম্পের নীতি ও তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে বিদ্যমান লড়াইয়ের উপর।
কবীর তানেজা অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর ও ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.