জো বাইডেন প্রশাসনের প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞার জন্য নতুন করে চাপ দেওয়া এবং ক্ষমতায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রাম্পের শুল্ক সংক্রান্ত হুমকির পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। চিনা কৌশলবিদরা চিন-মার্কিন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন বলেই আশঙ্কা করছেন।
বাইডেন প্রশাসন অর্ধপরিবাহী সংক্রান্ত প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ সশক্ত করেছিল এবং ১৪০টি চিনা সংস্থাকে একটি বাণিজ্যিক কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল। নতুন নিয়মগুলি অর্ধপরিবাহী উত্পাদন ও চিপ তৈরির সরঞ্জাম এবং ডিজাইনিং সফ্টওয়্যারগুলিতে আনুষঙ্গিক বাস্তুতন্ত্রকে লক্ষ্য করেই গৃহীত হয়েছে। মার্কিন সরকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে ব্যবহৃত মেমরি চিপগুলির রফতানিও বন্ধ করেছে। নতুন প্রবিধানগুলি মার্কিন প্রযুক্তির সাহায্যে বিদেশে উত্পাদিত পণ্যগুলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এবং চিন ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংস্থাগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে। কালো তালিকায় এমন বেসরকারি ইক্যুইটি সংস্থাও রয়েছে, যারা চিনের প্রযুক্তি ক্ষেত্রের উন্নয়নে বিনিয়োগ করেছে। এই সংস্থাগুলিকে আমেরিকা ও তার মিত্রদের ‘প্রতিরক্ষা শিল্প ঘাঁটি’র জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্ধপরিবাহীগুলির উৎপাদনের দক্ষতার স্বদেশিকরণ করার চিনা উদ্যোগের সহায়ক বলে মনে করা হয়েছিল। সংবেদনশীল প্রযুক্তিতে চিনের প্রবেশাধিকার সীমিত করার জন্য গত তিন বছরে বাইডেন প্রশাসনের দ্বারা তৈরি করা আগের পরিকল্পনার ভিত্তিতে নতুন নিয়ম গৃহীত হয়েছিল।
নতুন প্রবিধানগুলি মার্কিন প্রযুক্তির সাহায্যে বিদেশে উত্পাদিত পণ্যগুলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এবং চিন ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংস্থাগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে।
ক্ষমতাসীন প্রশাসনের দ্বারা উন্নত জ্ঞানের উপর নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও ট্রাম্প চিন, মেক্সিকো ও কানাডার উপর শুল্ক আরোপ করার অভিপ্রায় ঘোষণা করেছেন, যাতে এই দেশগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন ও মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য হয়।
চায়না ইনস্টিটিউট অফ কনটেম্পরারি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সের ঝাং ঝিক্সিন যুক্তি দিয়েছেন যে, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের পর থেকে চিনের উত্থানের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘৃণা বেড়েছে এবং ফলস্বরূপ চিনের উত্থানকে প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়েছে। ঝাং অনুমান করেছেন যে, চিনের উত্থান মার্কিন কৌশলগত সম্প্রদায়কে চিনের প্রতি ‘চরম কঠোরতা’ প্রদর্শন করতে চালিত করেছে এবং সহযোগিতার জন্য যে কোনও ধরনের সমঝোতা ও প্রসারকে ‘রাজনৈতিক ভাবে ভুল’ এবং ‘দুর্বলতা প্রদর্শন’ বলেই মনে করা হয়েছে। তাঁর মতে, ‘চিনের হুমকি তত্ত্ব’ স্বার্থান্বেষী লোভ দ্বারা আকার পাচ্ছে, যেহেতু এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতার বৃদ্ধি থেকে সামরিক-উৎপাদন প্রতিষ্ঠান লাভ করেছে।
চায়না ইনস্টিটিউট অফ কনটেম্পরারি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের ইনস্টিটিউট অফ আমেরিকান স্টাডিজের শি গুয়ানান মূল্যায়ন করেছেন যে, বাইডেন প্রশাসন চিনের সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখার জন্য একটি পদ্ধতি অনুসরণ করছে এবং চিনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। এই মূল্যায়ন আমেরিকার নতুন নেতৃত্বের ধারণার বিপরীত। শি অনুমান করেছেন যে, কূটনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তামূলক ভাবমূর্তির জন্য ট্রাম্পের মনোনীত ব্যক্তিরা ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর নীতিবাক্য মেনে চলেন এবং তাঁরা চিনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট। সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সেন্টার ফর আমেরিকান স্টাডিজ-এর সু লিউকিয়াং যুক্তি দিয়েছেন যে, প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পকে রিপাবলিকান প্রবীণদের নিয়োগ করতে হয়েছিল। কারণ সে সময়ে ট্রাম্পের নিজস্ব দলের অভাব ছিল। সু এই দাবিও করেছেন যে, এই মেয়াদে ট্রাম্প ‘মূলধারার বাইরের’ রাজনীতিবিদদের মন্ত্রিসভার প্রধান পদে নিয়োগ করেছেন এবং ট্রাম্পের প্রথম জমানার সেক্রেটারি অফ স্টেট মাইক পম্পেও ও রাষ্ট্রপুঞ্জে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছেন। কারণ এই দুই ব্যক্তিত্ব ট্রাম্পের তেমন অনুগত নন। এর পাশাপাশি সু মূল্যায়ন করেছেন যে, ট্রাম্প ২.০-এর অধীনে মন্ত্রিসভা গঠনের ফলাফল শাসন ক্ষমতা বাড়াতে পারে। তবে তা নীতির জন্য একটি ইকো চেম্বার তৈরির ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসন উল্লেখযোগ্য ভাবে শুল্ক বাড়াতে পারে, সবচেয়ে পছন্দের দেশের মর্যাদা প্রত্যাহার করতে পারে এবং চিন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের আকারে একটি নতুন যুদ্ধকে উস্কে দিতে পারে।
চিনা কৌশলবিদরা আশঙ্কা করছেন যে, ট্রাম্প আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি এবং চিনের ‘অন্যায্য’ বাণিজ্যিক অনুশীলনের বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। ট্রাম্প প্রশাসন উল্লেখযোগ্য ভাবে শুল্ক বাড়াতে পারে, সবচেয়ে পছন্দের দেশের মর্যাদা প্রত্যাহার করতে পারে এবং চিন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের আকারে একটি নতুন যুদ্ধকে উস্কে দিতে পারে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এই আশঙ্কাও রয়েছে যে, ট্রাম্পের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনের উপর প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করতে পারে, এমনকি দুই দেশের মধ্যে দ্রুত গতিতে ‘প্রযুক্তিগত বিচ্ছিন্নকরণ’ও করতে পারে। এই পূর্বাভাসটি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে হুয়াইয়ের মতো চিনা পরাশক্তির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করার বিষয়টি থেকেই স্পষ্ট। বেজিং মনে করছে, ওয়াশিংটন নীতিগত ক্ষেত্রে এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে।
চিনা কৌশলবিদরা স্বীকার করেছেন যে, বাইডেন প্রশাসন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অর্ধপরিবাহীর মতো ক্ষেত্রগুলিতে চিনের উপর রফতানি নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে। তবে এই আশাও করা হচ্ছে যে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে চিনের বিরুদ্ধে প্রযুক্তিগত যুদ্ধের ক্ষেত্রে এক সামগ্রিক সরকারি মনোভাব লক্ষ করা যাবে এবং নিষেধাজ্ঞার তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে।
বেজিং সম্পর্কে ট্রাম্পের মূল্যায়নটি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারাও আকার পেয়েছে যে, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে শি জিনপিংয়ের অব্যবস্থাপনা ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ের দিকে চালিত করেছিল। চিনা শিক্ষাবিদরাও মনে করেন যে, এই মন গড়া শত্রুতা তাঁর বর্তমান মেয়াদে একটি কঠিন সম্পর্কের দিকে চালিত করতে পারে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘কোভিড-১৯ উৎস সন্ধান’ সংক্রান্ত তার প্রচারকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। ২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়া করোনাভাইরাস অতিমারির উত্স সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক তদন্তের জন্য সমর্থন সংগ্রহ করতে আগ্রহী ছিল। এর পরেই চিন ক্যানবেরার আমদানি বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তাইওয়ান সম্পর্কেও একটি আতঙ্কও রয়েছে। তাঁর প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন এবং ১৯৭০-এর দশকে স্থির হওয়া ইউএস কূটনৈতিক কনভেনশনকে উপেক্ষা করেছিলেন, যেটিতে এক সময় ওয়াশিংটন তাইপেইয়ের বদলে বেজিংকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসন তাইপেইকে অস্ত্র প্যাকেজ পাঠিয়েছে। বর্তমানে ঝোংনানহাইতে এই নতুন উদ্বেগ রয়েছে যে, মাইক ওয়াল্টজ ও মার্কো রুবিওকে যথাক্রমে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও সেক্রেটারি অফ স্টেটের ভূমিকায় বহাল করার দরুন তাইওয়ানের বিষয়ে ওয়াশিংটনের নীতি ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ থেকে ‘কৌশলগত স্পষ্টতা’য় হয়েছে।
বেজিং সম্পর্কে ট্রাম্পের মূল্যায়নটি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারাও আকার পেয়েছে যে, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে শি জিনপিংয়ের অব্যবস্থাপনা ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ের দিকে চালিত করেছিল।
ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির চিনা মূল্যায়ন মার্কিন জোট ব্যবস্থার সারাংশের সঙ্গে দ্বন্দ্বপূর্ণ। এমনটাও মনে করা হচ্ছে যে, বাইডেন আমেরিকার ‘বিচ্ছিন্ন’ মিত্রদের কাছে পৌঁছনোর নতুন প্রয়াস চালালেও ট্রাম্প সেই মিত্রদের ‘বোঝা’ বলে মনে করেন এবং তাই ট্রাম্প মার্কিন জোট ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে চাইছেন। চিনা কৌশলবিদরাও ট্রাম্পের অধীনে ইউক্রেনের ক্ষেত্রে মার্কিন অগ্রাধিকারগুলির পুনর্মূল্যায়নের পূর্বাভাস দিয়েছেন, যা কিয়েভকে সমর্থন করার প্রচেষ্টায় ইউরোপকে আরও বেশি চাপের মধ্যে ফেলতে পারে। একই সময়ে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন ইউরোপে দক্ষিণপন্থী নেতাদের নির্বাচনী বিজয়কে উস্কে দিতে পারে, যা চিনা কৌশলবিদদের অনুমান অনুযায়ী, ব্রাসেলস ও ওয়াশিংটনের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ হতে পারে।
এমনটাও মনে করা হচ্ছে যে, নতুন মার্কিন অভিজাতদের মতামত অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, যা চিন-মার্কিন সম্পর্কের সামগ্রিকতাকে প্রভাবিত করে। বেজিং এই আশঙ্কাও করছে যে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে চিনের উপর নিষেধাজ্ঞার কড়াকড়ি ভূ-রাজনৈতিক চ্যুতিরেখাগুলিকে আরও প্রকট করে তুলতে পারে।
কল্পিত এ মানকিকর অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.