এই প্রতিবেদনটি ‘রি-ইগনাইটেড অ্যাজেন্ডাজ: ট্রাম্প’স রিটার্ন অ্যান্ড ইটস গ্লোবাল রেপারকাশন’ সিরিজের অংশ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে, এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। বিশ্বব্যাপী জল্পনা-কল্পনা চলছে ট্রাম্প প্রশাসন বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির কী কী পরিবর্তনের সূচনা করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওয়াশিংটনে পূর্ববর্তী কার্যকাল (২০১৭-২০২১) বিশ্লেষকদের জন্য এ ক্ষেত্রে তাঁর আসন্ন প্রশাসনের অগ্রাধিকার ও স্বার্থ সম্পর্কে ধারণা তৈরি করার সহায়ক। যাই হোক, ট্রাম্পের আগের মেয়াদের পর থেকে বিশ্বের অবস্থা নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, এবং তা তাঁর সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপগুলিতে প্রতিফলিত হতে পারে। যদিও এটি স্বাভাবিক যে আগামী প্রশাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বিশ্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে সেই বিষয়ে কিছু পরিবর্তন আনবে, তবে ইন্দো-প্যাসিফিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনগুলি সূক্ষ্ম হতে পারে। অর্থনৈতিক ফ্রন্টে, চিনের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা তীব্রতর হতে পারে। বিভিন্ন উপায়ে এটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ওয়াশিংটনের নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গিকে রূপ দেবে।
ট্রাম্প ১.০-এর ইন্দো-প্যাসিফিক উত্তরাধিকার
বিভিন্ন উপায়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইন্দো-প্যাসিফিকে আমেরিকার অবস্থানকে আনুষ্ঠানিক করেছিলেন। পূর্ববর্তী ট্রাম্প প্রশাসন পূর্ববর্তী এশিয়া-প্যাসিফিক থেকে বৃহত্তর 'ইন্দো-প্যাসিফিক' ফোকাসের দিকে আমেরিকার স্থানান্তরের নেতৃত্ব দিয়েছিল। ট্রাম্পের পূর্বসূরি বারাক ওবামা প্রথমে 'পিভট' কৌশলের মাধ্যমে সামুদ্রিক এশিয়ায় ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে নোঙর করতে চেয়েছিলেন, এবং পরে 'রিব্যালান্স টু এশিয়া’ হিসাবে কৌশলটির পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। এর অনেক পরে, বিশ্ব নেতারা দুটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসাগরকে — ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর —একক কৌশলগত থিয়েটারে একীভূত করার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে লড়াই করতে শুরু করেন। ২০১৮ সালে, ট্রাম্প প্রশাসন পূর্বের হাওয়াই-ভিত্তিক ইউএস প্যাসিফিক কমান্ড (ইউএসপাকম)-এর নাম পরিবর্তন করে ইউএস ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড (ইউএসইন্ডোপাকম) করে।
বিশ্ব নেতারা দুটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসাগরকে — ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর —একক কৌশলগত থিয়েটারে একীভূত করার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে লড়াই করতে শুরু করেন।
যদিও তাঁর পূর্ববর্তী প্রশাসনের ভিত্তিতে চালিত ট্রাম্পের প্রচারণার বেশিরভাগই তাঁর মিত্র ও অংশীদারদের ক্ষেত্রে মার্কিন ব্যয় যাচাই করার প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, পূর্ববর্তী ট্রাম্প প্রশাসন কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিক জুড়ে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার দিকে গতি আনার ক্ষেত্রে ভাল কাজ করেছিল। এটি আংশিকভাবে চিনের উত্থানের আসন্ন হুমকি এবং বেজিংয়ের একতরফা পদক্ষেপগুলিকে রোধ করার করার প্রয়োজনীয়তার ফলে ঘটেছিল, যা এই অঞ্চলে মার্কিন কৌশলগত স্বার্থের জন্য উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি করেছিল। গুরুত্বপূর্ণভাবে, ট্রাম্প জমানায় ২০১৭ সালে চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ (কোয়াড)-এর অংশীদার দেশগুলির — অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র — বিদেশমন্ত্রীরা প্রথমবারের মতো আলোচনায় বসেছিলেন , যা ইন্দো-প্যাসিফিকের মূল পরিসর শাসনের জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসাবে গোষ্ঠীটির আবির্ভূত হওয়ার পথ প্রশস্ত করেছিল।
যাই হোক, ইন্দো-প্যাসিফিকের কৌশলগত বাস্তবতার গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। এটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নতুন মার্কিন অংশীদারিত্বও প্ররোচিত করেছে। কোয়াড ছাড়াও ইন্দো-প্যাসিফিকের প্রতি ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি নির্দেশিত করে এমন তিনটি মূল অংশীদারিত্ব হল: দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় নিরাপত্তা সহযোগিতা; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিপিন্সকে নিয়ে গঠিত স্কোয়াড; এবং অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য (ইউকে) ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত অওকাস। একদিকে মার্কিন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া ত্রিপক্ষ যখন উত্তর কোরিয়ার সৃষ্ট নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে, সেই সময় দক্ষিণ চিন সাগরে অব্যাহত চিনা আগ্রাসী মনোভাবের — যা প্রায়শই ফিলিপিন্সের সঙ্গে চিনের বিভিন্ন সামুদ্রিক পরিষেবার মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়ায় — প্রতিক্রিয়ায় স্কোয়াডটি সম্প্রতি রূপ নিয়েছে। ইতিমধ্যে, অওকাস ক্রমবর্ধমান অস্থির ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সম্ভাব্য সংঘাত রোধ করতে নিবারণমূলক (ডেটারেন্স) পদক্ষেপ হিসাবে অস্ট্রেলিয়াকে পরমাণু-চালিত সাবমেরিন সরবরাহ করার জন্য একটি ত্রিপাক্ষিক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে । আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক ভূচিত্রের পরিবর্তনশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে তার নিরাপত্তা ও বিদেশনীতিকে পুনর্নির্মাণ করবে, সেই প্রশ্নটির উত্তর সম্ভবত ওয়াশিংটন তার জাতীয় স্বার্থের অনুসরণে তার জটিল ও বিভিন্ন অংশীদারিত্বের উপযোগিতাকে কীভাবে দেখবে, তার উপর নির্ভর করতে পারে।
অওকাস ক্রমবর্ধমান অস্থির ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সম্ভাব্য সংঘাত রোধ করতে নিবারণমূলক (ডেটারেন্স) পদক্ষেপ হিসাবে অস্ট্রেলিয়াকে পরমাণু-চালিত সাবমেরিন সরবরাহ করার জন্য একটি ত্রিপাক্ষিক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।
কৌশলগত প্রতিযোগিতা থেকে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা
আগামী ট্রাম্প প্রশাসন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে জো বাইডেন প্রশাসনের প্রতিষ্ঠিত একটি শক্তিশালী নিরাপত্তা ‘জালিকা’র উত্তরাধিকারী হবে। বাইডেনের 'ডিপ্লোম্যাসি ফার্স্ট' পদ্ধতি অনুসৃত ও লালিত উদ্যোগগুলি ট্রাম্প প্রশাসনে একই কূটনৈতিক দৃঢ়তার সঙ্গে অব্যাহত রাখা হবে কি না তা অনিশ্চিত। এর উত্তর সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক পদ্ধতির গতিপথকে রূপ দেবে। ক্ষুদ্রতর অংশীদারিত্বের ভবিষ্যৎ সম্ভবত ট্রাম্পের লেনদেনমূলক কূটনীতির সাপেক্ষে নির্ধারিত হবে। এটা খুবই স্পষ্ট যে মার্কিন বিদেশনীতিতে ট্রাম্পের অগ্রাধিকার ও স্বার্থের প্রাধান্য থাকবে। যাই হোক, ট্রাম্প ২.০ ক্যাবিনেট নিয়োগের ভিত্তিতে মনে হচ্ছে চিনের সঙ্গে একটি বাণিজ্য যুদ্ধ নিশ্চিত। এটি ইন্দো-প্যাসিফিকের প্রতি ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মার্কিন জোট ও অংশীদারিত্ব টিকিয়ে রাখার পদ্ধতিতে ছড়িয়ে পড়বে, যা মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা স্থাপত্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। চিনের সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক বিষয়গুলিতে ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক বেশি জোর দেওয়ার কারণে নিরাপত্তা বিবেচনাগুলি সম্ভবত পিছনের সারিতে চলে যাবে।
ওয়াশিংটনে অর্থনৈতিক অনুভূতি এমন একটি বিষয় যা ট্রাম্প ২.০ কূটনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। তাঁর প্রথম মেয়াদে শুরু হওয়া চিনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ সম্ভবত আবার শুরু হবে এবং তীক্ষ্ণতর হবে। এই প্রেক্ষাপটে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের নিজেদের নিরাপত্তা স্বার্থ যাতে বাধাহীন থাকে তা নিশ্চিত করতে নিজেদের কৌশলগুলি পুনর্নির্মাণ করতে হবে। পূর্ববর্তী ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা্র ভিত্তিতে এই নির্বাচনের ফলাফল ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা স্থাপত্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ তৈরি করেছে, বিশেষ করে এই অঞ্চলের প্রতি নতুন মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে ওয়াশিংটনের মিত্রদের স্থানের বিষয়ে। ফলস্বরূপ, অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু থাকবে কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের নিজেদের নিরাপত্তা স্বার্থ যাতে বাধাহীন থাকে তা নিশ্চিত করতে নিজেদের কৌশলগুলি পুনর্নির্মাণ করতে হবে।
তার উপর, নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের আগমন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আরও ক্ষুদ্রপাক্ষিকের বিস্তারের দিকে নিয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে যদি ওয়াশিংটন নিরাপত্তা সহযোগিতাকে অবহেলা করে বা বন্ধ করে দেয়। সেক্ষেত্রে উদীয়মান ও মধ্যম শক্তিগুলি এগিয়ে যাওয়ার এবং সহযোগিতা করার সুযোগ পাবে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্প ১.০-এর সময় শিনজো আবের অধীনে জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মতো আঞ্চলিক অংশীদারদের জড়িত ও আশ্বস্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল, এবং কমপ্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রোগ্রেসিভ এগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (সিপিটিপিপি)-এর মতো উদ্যোগগুলির পাশাপাশি চিনের অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগানোও অব্যাহত রেখেছিল।
উপসংহার
আগামী ট্রাম্প প্রশাসন ট্রাম্প ১.০-এর চেয়ে চিনের প্রতি আরও বেশি কঠোর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এটি বাইডেনের নিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার দিকে সরে যেতে পারে। ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে একটি তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে, যা সামনের দিনে আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি এবং আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ করবে। যাই হোক, যা দেখার বাকি আছে তা হল চিনের প্রতি মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণে প্রধান চালক হিসাবে থাকবে, না কি ট্রাম্প ১.০ যুগের সংঘাত বিন্দুগুলি মার্কিন বিদেশনীতিতে পুনরায় আবির্ভূত হবে। দুটি পরিস্থিতির যে কোনওটিই উল্লেখযোগ্যভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থাপত্যকে পরিবর্তন করবে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ফ্রন্টে তার আগের বাণিজ্যবাদী অবস্থানে ফিরে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে, তাই আমরা সম্ভবত ইন্দো-প্যাসিফিক ইকনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ফর প্রসপারিটি (আইপিইএফ)-কে সুপ্ত হয়ে যেতে দেখব, যা বেজিংকে আরও জায়গা দেবে। যাই হোক, নিরাপত্তা ফ্রন্টে, এটি প্রত্যাশিত যে ট্রাম্প অওকাস ও কোয়াড-এর মতো ক্ষুদ্রতর নিরাপত্তা গোষ্ঠীগুলিতে বিনিয়োগ চালিয়ে যাবেন। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি প্রধান উদ্বেগ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি 'নিরলস কূটনীতি' পদ্ধতির মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসনের মতো নেতৃত্বের ভূমিকা খুঁজতে থাকবে, না কি ইন্দো-প্যাসিফিকে তার 'আমেরিকা ফার্স্ট' অ্যাজেন্ডা অনুসরণ করে সন্তুষ্ট থাকবে।
অভিষেক শর্মা ও সায়ন্তন হালদার অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের গবেষণা সহকারী।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.