এই নিবন্ধটি ‘৩০ বছর পরে: সংস্কার কর্মসূচির পর্যালোচনা ও পুনর্নবীকরণ’ সিরিজের অংশ।
অনেকেই হয়তো ‘রিফর্ম অ্যান্ড প্রোগ্রেস ইন ইন্ডিয়া’ বইটি পড়েননি। লেখক বা লেখিকা তাঁর নাম গোপন রাখতে চেয়েছিলেন, তাই বইটির রচয়িতার উল্লেখ ছিল ‘অ্যান অপটিমিস্ট’ হিসেবে। এর উপশিরোনামে লেখা ছিল, ‘দেশ ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রশাসনিক ও অন্যান্য প্রশ্ন সম্পর্কে কিছু ভাবনাচিন্তা।’ এর থেকে বইটি পুরনো দিনের বলে বোঝা যায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। সংস্কার প্রসঙ্গে আরও অনেক বই, পুস্তিকা, গবেষণাপত্র এবং সংবাদমাধ্যমে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে আর ১৯৯১ থেকে স্বাভাবিক ভাবেই এই সবের সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৯১–এর সংস্কারের ৩০তম বর্ষে পৌঁছে দেখা যাচ্ছে তার সংখ্যা আরও বাড়ছে।
এই নিবন্ধগুলির বক্তব্য, ‘সরকার সংস্কার করছে’ বা ‘সরকার সংস্কার করছে না’। এই বক্তব্যের মধ্যেই রয়েছে ‘সংস্কার’ বলতে কী বোঝায় আর তা চরিত্রগত ভাবে ব্যক্তিগত মূল্যবোধভিত্তিক মতামত।
একজনের কাছে যা ‘সংস্কার’ তা অন্যজনের কাছে ‘বিকৃতি’ হিসেবে গণ্য হবে এমন নয়, তবে সংস্কারের তালিকাটা বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন রকম। ‘রিফর্ম’ শব্দটি এসেছে লাতিন re, অর্থাৎ পিছনে, এবং formare ,অর্থাৎ আকার নেওয়া বা আকৃতি দেওয়া থেকে। মূল চেহারাটা ফিরিয়ে আনার একটা ভাব এর মধ্যে রয়েছে। অতএব কোন আকারটা ঠিক — মূল আকার, বর্তমান আকার না বিকল্প কিছু — সেটা আমাদের ভেবে নেওয়া প্রয়োজন। অনেকে হয়তো বলতে পারেন যে কোন কোন ক্ষেত্র সংস্কারের লক্ষ্য, তা নিয়ে মোটের উপর ঐকমত্য আছে: যেমন কৃষি, শিল্প, পরিষেবা, পরিকাঠামো, শ্রম, জমিসংক্রান্ত বিবাদ নিষ্পত্তি, আর্থিক বাজার, কর ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের সংস্থাগুলি, ভর্তুকি ইত্যাদি। একটা স্তরে এটা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু এগুলো সবই হচ্ছে সংস্কারের উদাহরণ, সংস্কার বলতে কী বোঝায় তা নয়।
একজনের কাছে যা ‘সংস্কার’ তা অন্যজনের কাছে ‘বিকৃতি’ হিসেবে গণ্য হবে এমন নয়, তবে সংস্কারের তালিকাটা বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন রকম।
১৯৯১ সালের আগে বৈদেশিক বাণিজ্য নীতির ক্ষেত্রে বাণিজ্যমন্ত্রকের কাছে থাকত পজিটিভ আর নেগেটিভ লিস্ট (এমন তালিকা এখনও আছে, কিন্তু তার গুরুত্ব অনেক কমে এসেছে)। নেগেটিভ তালিকাকে পজিটিভ তালিকা থেকে একটু বেশি উদার বলা যেতে পারে। নেগেটিভ তালিকায় আমদানিসহ কোনও লেনদেন স্পষ্ট ভাবে নিষেধ করা না–থাকলে তা করা বৈধ বলে ধরে নেওয়া হত। আর পজিটিভ তালিকার ক্ষেত্রে আমদানি সহ কোনও লেনদেনে স্পষ্ট ভাবে অনুমোদন দেওয়া না–থাকলে তা করা যাবে না বলে ধরা হত। এবার ভাবুন একটা পরিস্থিতি যেখানে আজকের ভারতে একজন একটা বড় বেসরকারি ব্যাঙ্ককে জাতীয়করণের কথা বলছেন। অধিকাংশ মানুষই মাথা নেড়ে বলবেন, ‘এটা সংস্কার নয়।’ এবার আপনি নিজেকে নিয়ে যান ১৯৬০–এর দশকের শেষের দিকে বা ১৯৭০–এর দশকের গোড়ার দিকে। অধিকাংশ মানুষই তখন সম্মতিসূচক ভাবে বলতেন, ‘হ্যাঁ, এটা সংস্কার।’ আমি এর মধ্যে দিয়ে দুটো বিষয় বলতে চাইছি। প্রথমত, সংস্কারের সংজ্ঞা হল প্রসঙ্গ ও সময়–ভিত্তিক। দ্বিতীয়ত, সংস্কারের উদাহরণগুলো হচ্ছে ওই পজিটিভ তালিকার মতো, যে মনোভাব নিয়ে ১৯৯১ সাল থেকে আমরা এগিয়েছি। সরকারের কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়, সে বিষয়ে একটা দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়াই হল পছন্দের নেগেটিভ তালিকার অনুসরণ।
আমরা যদি ‘সংস্কার’ শব্দটা ব্যবহার করি তা হলে ধরে নিতে হবে বর্তমান পরিস্থিতিতে যে ভাবে লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা হচ্ছে, তা নিয়ে আমরা খুশি নই। বেশ কিছু বছর আগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন মিখাইল গরবাচেভ গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, তখন ‘পেরেস্ত্রৈকা’ ও ‘গ্লাসনস্ত’ শব্দগুলো বেশ প্রচলিত ছিল। ‘পেরেস্ত্রৈকা’ মানে ‘পুনর্গঠন’, এবং তা ব্যবহৃত হত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন প্রসঙ্গে। গ্লাসনস্ত এর অর্থ ‘উন্মুক্ততা’, এবং তা সোভিয়েত নাগরিকদের অধিকারসমূহ পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হত। এই শব্দগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সংস্কার প্রসঙ্গে অনেক সময়েই অনেক সরলীকৃত সাধারণীকরণ করা হয়ে থাকে।
ভারতে অনেক গ্রাম রয়েছে যেখানে স্বাধীনতার সাত দশক পরেও সরকারের কোনও অস্তিত্ব নেই। যদি এখন সেই গ্রামে সরকারের দাক্ষিণ্যে বিদ্যুৎ পৌঁছে যায়, তাহলে সরকার বৃহত্তর হয়ে উঠে থাকতে পারে। কিন্তু তা কেন সংস্কার হিসেবে গণ্য হবে না?
যেমন, একটা ধারণা আছে যে শিল্প বিরোধ আইনের ৫বি অধ্যায়টি যদি বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে সেটা হবে একটা ‘সাড়া–ফেলে–দেওয়া’ সংস্কার। আর যদি তা না–করা হয়, তা হলে সংস্কার অর্থহীন হয়ে যাবে। এটা হচ্ছে সংস্কার সম্পর্কে অস্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। সংস্কার এর থেকে অনেক বড় একটা বিষয়। সরকার যদি ‘ক্ষুদ্রতর’ হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে এমন ‘সাড়া–ফেলে–দেওয়া’ সংস্কার হতে পারে, আর যদি না হয়ে থাকে তা হলে সংস্কার ব্যর্থ হয়েছে। সরকার ক্ষুদ্রতর হয়ে গিয়েছে — এর অর্থ কী? ভারতে অনেক গ্রাম রয়েছে যেখানে স্বাধীনতার সাত দশক পরেও সরকারের কোনও অস্তিত্ব নেই। যদি এখন সেই গ্রামে সরকারের দাক্ষিণ্যে বিদ্যুৎ পৌঁছে যায়, তা হলে সরকার বৃহত্তর হয়ে উঠে থাকতে পারে। কিন্তু তা কেন সংস্কার হিসেবে গণ্য হবে না?
সংবিধান ও ‘সংস্কার’
পেরেস্ত্রৈকা ও গ্লাসনস্ত এর মতো শব্দগুলোর সেই বৃহত্তর ব্যঞ্জনা রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ হল: কার্যনির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। সংস্কার বলতে বোঝায় এগুলির এবং এদের কাজকর্মের পর্যালোচনা। এবং অবশ্যই বর্তমান সংবিধান নিয়ে প্রশ্ন তোলা সংস্কারের অঙ্গ। সরকারের কী করা উচিত বলে আমাদের প্রত্যাশা, এবং কী করা উচিত নয় বলে আমরা মনে করি, তা নিয়ে একটা ঐকমত্য গড়ে তোলা হল সংস্কার। কোন পর্যায়ে (কেন্দ্র, রাজ্য, স্থানীয়) সরকার একটা বিশেষ কাজ করবে, সেই সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল সংস্কার। সেই কাজ করার জন্য সেই পর্যায়ের সরকার কী ভাবে সম্পদ তৈরি করবে তা নিয়ে ঐকমত্য গড়ে তোলা হল সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়। পেরেস্ত্রৈকা ছিল দল ও সরকারের কাঠামো সংক্রান্ত বিষয; আর গ্লাসনস্ত ছিল নাগরিক সংক্রান্ত। আমাদের সংস্কারেও নাগরিকদের দায়িত্ব সংক্রান্ত বিষয় আনতে হবে, শুধু তাঁদের দাবি সংক্রান্ত নয়। এটা আসলে অনেক বড় একটা পরিসর।
২০০৮ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি ওয়ার্কিং পেপারে বলা হয়েছিল,‘ বিভিন্ন দেশের মধ্যে সবথেকে বড় পার্থক্য হল সেগুলির অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির পার্থক্য। উন্নয়নের সমস্যা সমাধানের জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলির সংস্কার প্রয়োজন।’
যদি প্রতিষ্ঠানগুলি সংস্কার করার ক্ষমতাসম্পন্ন হয়, তাহলে আজকের ভারতের সব প্রতিষ্ঠানের পেছনে মূল ভিত্তিটা হল সংবিধান। বাকি সব কিছু তার থেকে উদ্ভূত। ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলি সংবিধান গ্রহণ করেছিল, আর তা কার্যকর হয়েছিল ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। অর্থাৎ ১৯৫0 সাল থেকেই সংবিধান আছে, এবং তারপর তাতে অনেকগুলি সংশোধন করা হয়েছে।
পেরেস্ত্রৈকা ছিল দল ও সরকারের কাঠামো সংক্রান্ত বিষয়; গ্লাসনস্ত ছিল নাগরিক সংক্রান্ত। আমাদের সংস্কারেও নাগরিকদের দায়িত্ব সংক্রান্ত বিষয় আনতে হবে, শুধু তাঁদের দাবি সংক্রান্ত নয়। এটা অনেক বড় একটা পরিসর।
বাজারভিত্তিক অর্থনীতি কাজ করে সম্পত্তির অধিকারের ভিত্তিভূমির উপর। কিন্তু সম্পত্তির অধিকার এখন আর মৌলিক অধিকার নয়। সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশে এখন যে শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে, তা হল ‘সমাজতান্ত্রিক’। আপাতত আমরা সংবিধানের প্রস্তাবনা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সংবিধানের অংশ কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন রায়ের আইনি সূক্ষ্মতা বরং সরিয়ে রাখি। উত্তরটা যাই হোক না কেন, প্রস্তাবনা অংশটি বিভিন্ন রায়কে প্রভাবিত করে। ডঃ বি আর অম্বেডকর ১৯৪৮ সালের ১৫ নভেম্বর কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির বিতর্কে অংশ নিয়ে একটা সংশোধনীর বিরোধিতা করেছিলেন, যার মাধ্যমে প্রস্তাবনা অংশে ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটিকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাওয়া হয়েছিল। ‘একটা রাষ্ট্রের নীতি কী হবে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমাজ কী ভাবে নিজেকে সংগঠিত করবে, এই সব বিষয় নিয়ে সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার অবশ্যই মানুষের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এগুলো সংবিধানে লিখে দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ তা হলে গণতন্ত্র পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হবে।’
এই যুক্তিতে ছিল ‘জীবন্ত নথি’ ধারণাটির সমর্থন। কিন্তু তারপরেও শব্দটি এখন সংবিধানের অংশ। একটি রাজনৈতিক দলের নথিভুক্তিকরণের বিষয়টি ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন রয়েছে। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে তাতে বলা আছে, দলটিকে ‘সমাজতান্ত্রিক নীতিসমূহ’ মেনে চলতে হবে। সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ করার জন্য আমরা মাথার চুল ছিঁড়তেই পারি। এখানে উদ্দেশ্য ধারা ধরে ধরে সংবিধান নিয়ে আলোচনা করা নয়। বাস্তবিক, ২০০০ সালে সংবিধানের কাজ পর্যালোচনার জন্য একটি জাতীয় কমিশন তৈরি হয়েছিল এবং তা ২০০২ সালে দুই খণ্ডের একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছিল। কিন্তু তা বিষয়টির মূলে পৌঁছয়নি, শুধু কিছু বিষয় এদিক–ওদিক করতে বলেছিল। সংস্কারের যে ব্যাখ্যাই করা হোক, তা অবশ্যই একদিক থেকে বাজারের উপর নির্ভরশীল। বাজার মানে তো মান্ডির কৃষিজ ও পণ্য বিক্রির কমিটি (এপিএমসি) নয়। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদরা সেই বুদ্ধিবৃত্তীয় ধারণা ব্যবহার করেন যা প্রাতিষ্ঠানিক প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে যুক্ত; এবং এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সংবিধানের সঙ্গে। আমার মনে হয় না সংবিধানের সমাজতান্ত্রিক চরিত্র এবং তার সংশ্লিষ্ট আইনশাস্ত্রের পরিবর্তন না–ঘটিয়ে অর্থনীতিবিদদের জমি, শ্রম বা পুঁজির বাজার (তথাকথিত উপকরণ বাজার) নিয়ে কাজের কথা বলার কোনও অর্থ হয়।
সংস্কারের যে ব্যাখ্যাই করা হোক, তা অবশ্যই একদিক থেকে বাজারের উপর নির্ভরশীল।
আইনের শাসন
আইনশাস্ত্রের বিষয়টি থেকেই আসে আইনের শাসন। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রে রাজার এখনকার সরকারের সমার্থক) কাছ থেকে প্রত্যাশা ছিল যে তিনি নির্দিষ্ট কিছু কাজ করবেন। মূলত টা রাজ্যের প্রতিরক্ষা, শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমন, এবং দ্রুত ন্যায়বিচার দেওয়ার ব্যবস্থা করা। আজকের সরকারের ক্ষেত্রে কী কী কাজের অগ্রাধিকার থাকা উচিৎ জানতে চাওয়া হলে অধিকাংশ মানুষই সম্ভবত একই কথা বলবেন — অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, বিদেশি শক্তির থেকে প্রতিরক্ষা এবং ন্যায়বিচার করা। কিন্তু যখন সংস্কার কর্মসূচির তালিকা চাওয়া হবে, তার মধ্যে এই বিষয়গুলি প্রায় থাকবেই না, এবং তা সম্ভবত এই কারণে যে এই কর্মসূচিগুলো বেশির ভাগ সময় অর্থনীতিবিদরা তৈরি করেন যারা সাদা চোখে পৃথিবীকে দেখতে পারেন না।
ন্যায়বিচার করা হল এমন একটা বিষয় যেখানে বেসরকারি ক্ষেত্রের কোনও ভূমিকা নেই, এবং থাকার কথাও না, যদিও তুলনামূলক ধনীরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী রাখেন, এবং সিনেমার পর্দার কি বাস্তবের স্থানীয় ডনরা নিজেদের মতো করে বিচারও করে আবার নিরাপত্তাও দিয়ে থাকে। আইনের শাসনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে: একটা হল আইন এবং অন্যটা হল তা কার্যকর করার প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ। এর মধ্যে রয়েছে মূলত দুটি প্রতিষ্ঠান: পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা। যে কোনও সংস্কার কর্মসূচিতে এগুলির প্রাধান্য পাওয়া উচিত। যদিও আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের কথা বলা হয়েছে — কার্যনির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভা — কেন সংস্কার নিয়ে আলোচনার সময় শুধু কার্যনির্বাহী বিভাগের কথাই ভাবা হয়, তাও আবার শুধুই কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে? রাজ্য সরকারগুলি কেন বাদ যায়? কেন আমরা বিচারবিভাগীয় সংস্কারের কথা বলি না যা একটু আগে আমি উল্লেখ করেছি? আমরা কেন কোনও সময় আইনসভার (সংসদ ও রাজ্য বিধানসভা) সংস্কারের কথা বলি না?
যদিও আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের কথা বলা হয়েছে — কার্যনির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভা — কেন সংস্কার নিয়ে আলোচনার সময় শুধু কার্যনির্বাহী বিভাগের কথাই ভাবা হয়, তাও আবার শুধুই কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে? রাজ্য সরকারগুলি কেন বাদ যায়?
উপযুক্ত প্রশাসনের জন্য রাজ্যগুলো এবং শাসনের অন্য প্রণালীগুলির সম্পর্কেই বা কী মনোভাব নেওয়া হবে? আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত শুধু একটাই রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন (এসআরসি) তৈরি হয়েছিল। তা তৈরি করা হয়েছিল ১৯৫৩ সালে, এবং তার রিপোর্ট জমা পড়েছিল ১৯৫৫ সালে। বোধগম্য কারণেই রাজ্য পুনর্গঠন একটা আবেগপূর্ণ বিষয়। রাজ্যগুলি তৈরি হয়েছিল ঐতিহাসিক এবং ভাষাগত ভিত্তিতে। এসআরসি রিপোর্টে কিছু নীতি নির্ধারিত হয়েছিল। যে নীতিগুলি সামনে এসেছে সেগুলোকে ‘এভাবে তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে: ১. ভারতের ঐক্য ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং আরও শক্তিশালী করা; ২. ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত সমসত্ত্বতা; ৩. আর্থিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বিবেচনা এবং ৪. জাতীয় যোজনাকে সফল করার উদ্দেশ্যে কাজ।’
এইগুলো ছিল যুক্তিপূর্ণ নীতি। নতুন রাজ্য গঠনের ক্ষেত্রে কখনওই এসব মেনে চলা হয়নি। ‘যোজনা’র অর্থ তাহলে কি? একটা বিশেষ‘ যোজনার যেসব’ উপাদান থাকে, নতুন আরেকটি যোজনা তৈরি করে–অথবা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ভেঙে দিয়ে সেই উপাদানগুলোকে মুছে ফেলা যায় না।
এই ‘যোজনা’ হল বেশ কিছু বছর পরে যাতে মানুষের জীবনের উন্নতি হয় সেই উদ্দেশ্যে পণ্য ও পরিষেবা দেওয়ার প্রশ্নে সরকারি খরচের পরিকল্পনা করা। এইটাকেই আগেকার যোজনা কমিশন ‘পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা’ বলে অভিহিত করত। সবচেয়ে সন্তোষজনক শাসনপদ্ধতি আদতে সুনির্দিষ্ট জনহিতকর পণ্য ও পরিষেবার উপরে নির্ভরশীল। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট স্তরের চাইতে বেশি এগোলেও অর্থনৈতিক দক্ষতা কমে যেতে পারে, তার চেয়ে কম এগোলেও আবার একই পরিণামের আশংকা।
বিশেষ করে যখন আজকের দিনে শাসনকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে অর্থনৈতিক অর্থে, তখন মনে হয় কতগুলো জ্য দক্ষভাবে শাসিত হওয়ার পক্ষে বিশাল বড় আর কতগুলো খুব ছোট।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়টি রাজ্যস্তরে কার্যকর নয়। কিন্তু রাজ্যস্তরে যে সমস্ত পরিষেবা ও পণ্য পৌঁছে দিতে হবে, তার অধিকাংশের কথাভেবেই একটা যুক্তিপূর্ণ ভাবনাচিন্তা অনুযায়ী রাজ্য তৈরি করার কথা ছিল। সবাই একমত হবেন যে একটা রাজ্যে জনসংখ্যা কী হবে বা তার ভৌগোলিক এলাকা কতটা হবে, তার একটা ঊর্ধ্ব ও নিম্ন সীমা থাকা উচিত। যদি সুশাসনের সংজ্ঞা দক্ষতার সঙ্গে পণ্য ও পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া হয়, তাহলে কোথাও জনসংখ্যা ২০ কোটি (উত্তরপ্রদেশ) আর কোথাও ৬১১,০০০ (সিকিম), এটা কখনওই আদর্শ অবস্থা নয়। কোনও রাজ্যের ভৌগোলিক পরিসর ৩৪২,২৬৯ বর্গ কিলোমিটার (রাজস্থান) হওয়া যেমন আদর্শ নয়, তেমনই ৩৭০২ বর্গ কিলোমিটারও (গোয়া) আদর্শ নয়।
অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের ভিত্তিতে কোনও রাজ্যের জনসংখ্যা বা আয়তন কী হওয়া উচিত তা বলা সম্ভব নয়। তবে বিশেষ করে যখন আজকের দিনে শাসনকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে অর্থনৈতিক অর্থে, তখন মনে হয় কতগুলো রাজ্য দক্ষ ভাবে শাসিত হওয়ার পক্ষে বিশাল বড় আর কতগুলো খুবই ছোট। অন্য ভাবে বললে, আমার সংস্কার কর্মসূচিতে থাকবে আর একটা রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন।
মূল কথাটা হল যে বাজারের সংস্কার নিয়ে যা কিছু বলা হচ্ছে তাতে আমার কোনও সমস্যা নেই। তবে তা হল একটা ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন ও সংকীর্ণ কর্মসূচি। আমার মতে, প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নজর দেওয়ার সময় এসেছে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.