এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ইকোনমিক টাইমস-এ।
ভারত সরকারের ২০২৩-২৪ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা দর্শিয়েছে যে, চিন থেকে ফরেন ডিরেক্ট ইনইভেস্টমেন্ট বা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রাপ্তি ভারতকে রফতানির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে তার অংশগ্রহণ উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে।
কৌশল নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অনেক সংস্থা উন্নত বৈদ্যুতিন পণ্য ও উপাদানগুলির জন্য বেজিংয়ের উপর নির্ভরতা কমাতে একটি ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশল গ্রহণ করেছে। চিন থেকে দূরে উৎপাদনকে বৈচিত্র্যময় করার জন্য এই পদ্ধতির তাৎক্ষণিক ‘সুবিধাভোগী’ ভারত যদি না-ও হয়, তা সত্ত্বেও ভারত সরকারের প্রোডাকশন-লিঙ্কড ইনসেনটিভ স্কিম বা উৎপাদন-সংযুক্ত প্রণোদনা প্রকল্প, করে ছাড় প্রদান এবং ভর্তুকি সংস্থাগুলিকে ভারতে বিনিয়োগের জন্য আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যে ভারত আন্তর্জাতিক মূল্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করতে চায়, সেই দেশটিকে ইস্ট এশিয়ান টাইগার অর্থাৎ পূর্ব এশীয় মহাশক্তির অর্থনীতির সফল কৌশলগুলি অনুকরণ করতে হবে, যেমন বিদেশি বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া। এই সমীক্ষায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, যখন চিন থেকে উৎপাদন সরিয়ে নেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন উৎপাদন-বাজারের অন্বেষণ করেছিল, তখন দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনাম উপকৃত হয়েছিল এবং এই দেশগুলি বেজিং থেকে প্রচুর পরিমাণে এফডিআই পেয়েছে। সমীক্ষা দর্শিয়েছে যে, ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশলকে অনুসরণ করলেও ‘বিশ্বের কারখানা’ অর্থাৎ চিনকে কখনওই উপেক্ষা করা যায় না। এমন ভাবনাও রয়েছে যে, চিনা বিনিয়োগের আমন্ত্রণ ভারতকে রফতানি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে এবং সর্বোপরি চিনের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে পারে।
ভারত সরকারও অবশ্য চিনের পুঁজির প্রবাহ সহজ হওয়ার বিষয়ে যে কোনও প্রকারের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল স্পষ্ট ভাবেই বলেছেন যে, দেশে চিনা বিনিয়োগকে সমর্থন করার বিষয়টি বর্তমানে পুনর্বিবেচনা করা হয়নি এবং বিষয়টিকে এ ভাবেই দেখা উচিত যে, সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষার পক্ষে চ্যালেঞ্জগুলির অভিনব সমাধান দেওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এ কথাও ন্যায্য যে, এই সমীক্ষার ফলেই ভারতে চিনা পুঁজির প্রবাহ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
২০২০ সালের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, যখন অতিমারির কারণে ভারত এবং বাকি বিশ্ব লকডাউনের মধ্যে সময় কাটাচ্ছিল এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রায় ধোঁয়াশায় ঢেকে গিয়েছিল, তখন দিল্লি তার প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) নীতি সংশোধন করে সেই সব ক’টি চিনা সংস্থার ভারতীয় কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছিল, যেগুলি থেকে বেজিং সুবিধা অর্জন করছিল। তৃতীয় সাংবাদিক বিবৃতিতে জানা যায়, ভারত সরকার বাধ্যতামূলক করেছে যে, ভারতের সঙ্গে স্থল সীমান্ত ভাগ করে নেওয়া দেশগুলিতে অবস্থিত কোনও সংস্থা কর্পোরেট অনুমোদন পাওয়ার পরেই ভারতে বিনিয়োগ করতে পারে। ভারতও এর ব্যতিক্রম ছিল না; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চিনা পুঁজির ভূমিকা মূল্যায়ন করতে চেয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন খাতগুলিকে চিহ্নিত করেছে, যেখানে চিন নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে এবং তার পরে সেখানে চিনা বিনিয়োগকে সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ করা বা অনুমোদন দেওয়ার আগে ভাল করে নিরীক্ষণ করার পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। এটিকে খানিক ‘স্মল ইয়ার্ড হাই ফেন্স’ (পরিসর স্বল্প হলেও, নজরদারিতে যেন খামতি না থাকে) পদ্ধতি হিসাবে পরিচিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন সরকার (এবং ভারত) জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তি দর্শিয়ে চিনা ৫জি নিষিদ্ধ করেছিল। ২০২০ সালে সীমান্তে ভারতীয় ও চিনা সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষও হয়, যার ফলে উভয় পক্ষের সৈন্যই শহীদ হন। দুই দেশের মধ্যে সে সময় সম্পর্কের অবনতি ঘটার ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবস্থানও আরও কঠোর হয়ে পড়ে।
বেশ কয়েক জন অর্থনীতিবিদ যুক্তি দিয়েছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের তুলনায় ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই সমস্ত চিনা পুঁজিকেই ভারত সন্দেহের চোখে দেখেছে। চিন এবং ভারতের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও ২০০০ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০২৪ সালের মার্চ মাসের মধ্যে চিনের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মোট এফডিআই প্রবাহের মাত্র ০.৩৭%।
চিন এবং ভারতের মধ্যে কাঠামোগত কারণগুলিও পরবর্তী সময়ে বাধা সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিরল ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজগুলির প্রক্রিয়াকরণে বেজিংয়ের আধিপত্য পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ও দূষণহীন জ্বালানি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রার জন্য দিল্লির প্রচেষ্টাকে বাধা দিয়েছে। এ ভাবে সমস্ত চিনা পুঁজিকে বাইরে রাখার অর্থনৈতিক নীতিতে নিরঙ্কুশতার প্রবণতা ভারতের প্রবৃদ্ধির আখ্যানের উপরেও আঘাত হেনেছে, যেমনটা ভারতীয় পুঁজিবাদীরা অভিযোগ করেছেন। ভারতে এবং সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চিন সংক্রান্ত নতুন বাস্তববাদের উদ্ভব ঘটছে। ইতালির প্রিমিয়ার জর্জিয়া মেলোনি সম্প্রতি শি জিনপিংয়ের স্বাক্ষরিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তের পরেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য বেজিং ভ্রমণ করেছেন। রোম ও বেজিং বৈদ্যুতিক যানবাহন উত্পাদন এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রসারিত করতে আগ্রহী। মেলোনি বলেছিলেন যে, ইতালিতে চিনের বিনিয়োগ ইতালির চিন-অভিমুখী মূলধন বহিঃপ্রবাহের এক তৃতীয়াংশ এবং তিনি এই ব্যবধান কমাতে আগ্রহী। ভারতেও এমনটা দেখা গিয়েছে, যখন স্বরাষ্ট্র ও বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে সংযুক্ত বাণিজ্য মন্ত্রক এমন একটি কাঠামোয় উপনীত হতে চেয়েছে, যাতে ভারতে সফরকারী চিনা পেশাদারদের ভিসা প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সময় হ্রাস করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিল্প যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত চুক্তিবদ্ধ প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য এমনটা করা হয়েছে। নীতি আয়োগ-এর সহ-সভাপতি - সরকারের প্রধান পাবলিক পলিসি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক - চিন থেকে বিনিয়োগ সংক্রান্ত পথ মসৃণ করার জন্য নির্দেশিকাগুলিতে স্পষ্টতার আবেদন করেছেন এবং উল্লেখ করেছেন যে প্রতিটি প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করা ধীর এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।
তাই চিনা এফডিআই নিয়ে বিতর্কের জন্য সম্পূর্ণ সরকারি পদ্ধতির প্রয়োজন। যেমনটা অর্থনৈতিক সমীক্ষাতেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, বেকারত্ব মোকাবিলাই প্রধান অগ্রাধিকারগুলির অন্যতম। বৈষম্য হ্রাস এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলেছে যে, দেশের উচিত একটি ভাল ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরির জন্য তার নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা ত্যাগ করা। তাই চিনা পুঁজি সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার সময় এসেছে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.