অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই যেমনটা অনুমান করেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি আমেরিকার বিদেশনীতি তার তুলনায় অনেক দ্রুত হারে বিবর্তিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলির বিন্যাসে গঠনগত পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে আমেরিকা এবং ভারত দু-দেশের আমলাতন্ত্রের উপরেই। এই প্রভাব এতটাই জোরালো যে তা সাধারণত অন্যান্য বিষয়ে উদাসীন আমলাদেরও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তৎপর করে তুলেছে। নয়া দিল্লির কাছে ভারত -মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগানোর এ এক অনন্য সুযোগ।
আফগানিস্তানে রাজনৈতিক পালাবদলের পরবর্তী সময়ে ভারতের মনোভাবকে পাত্তা না দিয়ে ওয়াশিংটনের তরফে ইসলামাবাদের সঙ্গে আরও একবার নতুন করে বোঝাপড়ার সম্ভাবনা নিয়ে ভারতে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এই ধারণা যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, তা বর্তমানে পাকিস্তানের প্রতি আমেরিকার রাজনৈতিক শীর্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই স্পষ্ট। তাই সম্প্রতি আমেরিকার ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট ওয়েন্ডি শেরমানের দক্ষিণ এশিয়া সফর ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের কৌশলগত ভাবনায় জেঁকে বসে থাকা মিথগুলির সময়োপযোগী সংশোধনে সাহায্য করবে বলেই আশা করা যায়।
শেরমান তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা বলেছেন।
প্রথমত, তিনি বিশেষ জোরের সঙ্গে এ কথা জানিয়েছেন যে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে তারা ভারত এবং পাকিস্তানকে একই বন্ধনীতে রাখার দিনগুলিতে আর ফিরে যেতে চান না। শেরমান জানান, “আমরা (আমেরিকা) অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও সুগভীর সম্পর্ক স্থাপন করতে এবং ভারত ও পাকিস্তান এই দুই দেশকে একই নজরে দেখতে আগ্রহী নই। বর্তমানে আমরা আমাদের পুরনো অবস্থান থেকে সরে এসেছি, এবং ভবিষ্যতেও আমরা কোনও মতেই আর পুরনো অবস্থানে ফিরে যাব না।”
ভারতে কৌশলগত বিশেষজ্ঞরা কোয়াড এবং অউকাসের বিশ্লেষণে সন্দিহান হয়ে পড়লেও ওয়াশিংটন এবং নয়া দিল্লির নীতি নির্ধারকরা বহুপাক্ষিক জোট দুটির ভূমিকা এবং গঠনগত পার্থক্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভাবে ওয়াকিবহাল। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে অঞ্চলটিতে শান্তি এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে একাধিক বহুপাক্ষিক মঞ্চ এবং কর্মসূচির প্রয়োজন।
ওয়াশিংটনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় পাকিস্তানের যে বিশেষ কোনও ভূমিকা নেই এ কথাও তিনি স্পষ্ট করে দেন। তিনি যে পাকিস্তানে শুধু মাত্র ‘সুনির্দিষ্ট এবং বিশেষ প্রয়োজনে’ যাচ্ছেন, এই উক্তি আফগান সংকটের পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান এবং আমেরিকার সম্পর্কের বাস্তব চিত্রকেই প্রতিফলিত করে।
দ্বিতীয়ত, একথা স্পষ্ট যে তালিবানশাসিত আফগানিস্তান থেকে উদ্ভূত সমস্যাগুলির মোকাবিলায় ওয়াশিংটন এবং নয়া দিল্লির নীতি নির্ধারকেরা একজোট হয়ে কাজ করছেন। শেরমান বলেন, “আফগানিস্তানে সৃষ্ট সন্ত্রাসবাদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা প্রসঙ্গে ভারতের দুশ্চিন্তার বৈধতা নিয়ে আমেরিকা সম্পূর্ণ সহমত।” তাঁর ইসলামাবাদ সফরের তথ্য যে তিনি নয়া দিল্লির সঙ্গে ভাগ করে নেবেন সে কথা স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন শেরমান বলেন, “আমাদের (ভারত-আমেরিকার) দুই দেশের সরকারের মধ্যে তথ্যের আদানপ্রদানের ব্যাপারটি খুবই নিয়মিত।”
আফগানিস্তানের বাস্তব পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে আমেরিকা এবং ভারতের এই পারস্পরিক সহযোগিতার দিকটি প্রশংসনীয়। এই বিষয়টি দীর্ঘদিন যাবৎ ভারতের দাবিদাওয়াগুলির অন্যতম ছিল । আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পারস্পরিক সাক্ষাতের পর দুই দেশের তরফে দেওয়া বিবৃতি এবং কোয়াড বা চতুর্দেশীয় জোটের শীর্ষ সম্মেলনের পরে জারি করা যৌথ বিবৃতি— দু-ক্ষেত্রেই অন্য দেশগুলির সুরক্ষার স্বার্থে আফগানিস্তানকে আরও একবার সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠতে না দেওয়ার ভারতীয় আবেদন সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তালিবানদের সমর্থনে এগিয়ে আসার জন্য পাকিস্তান সারা বিশ্বের কাছে আবেদন জানালেও আমেরিকা যে সে কথায় কান দিতে নারাজ, তা বোঝাই যাচ্ছে। নিজেদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিয়ে শেরমান বলেছেন, “এখনও পর্যন্ত তালিবানরা তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।” শেরমান আরও বলেন, “আগামী দিনে কোনও দেশেরই তালিবানদের মুখের কথায় বিশ্বাস করা উচিত হবে না। শুধু প্রতিশ্রুতি দেওয়া নয়, যে কোনও রকম সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদ রুখতে প্রতিশ্রুতিমাফিক কাজ করে প্রতিহিংসা থেকে নিরস্ত থাকা, সবাইকে নিয়ে একটি সরকার গঠন, মহিলাদের কাজ করার স্বাধীনতা দেওয়া, মেয়েদের জন্য শিক্ষার সুবন্দোবস্ত করা এবং এ রকম আরও অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে তালিবানদের।”
তৃতীয়ত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে ভারত এবং পাকিস্তানকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার মাধ্যমে শেরমান বর্তমান পরিস্থিতির আসল ছবিটা অর্থাৎ চিন এবং ভারতের অভূতপূর্ব উত্থান ও বিশ্ব রাজনীতিতে এই উত্থানের গুরুত্বের দিকটা তুলে ধরেছেন। শেরমান বলেন, “গত কয়েক দশকে ভারতের অভাবনীয় উত্থানের পিছনে রয়েছে রুলস বেসড ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার বা সব দেশের সহমত হয়ে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত নীতি মেনে চলার অঙ্গীকারে সামিল হওয়া। চিনও একই পথে হেঁটে সাফল্যের মুখ দেখেছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ভারত এবং চিন উভয়েই সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে এগিয়েছে। দুর্বল প্রতিবেশী দেশগুলিকে গায়ের জোর দেখিয়ে, তাদের উপর অন্যায় ভাবে চাপ সৃষ্টি করে পরিস্থিতি নিজেদের জন্য অনুকূল করার বেজিংয়ের মনোভাবের প্রেক্ষিতে ভারত-আমেরিকার সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম হয়ে উঠেছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারত -আমেরিকার পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক জোটগুলিতে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে আরও মজবুত হয়েছে। এই জোটগুলির মধ্যে কোয়াড বা চতুর্দেশীয় জোটটি সর্বাধিক আলোচিত।
ভারতে কৌশলগত বিশেষজ্ঞরা কোয়াড এবং অউকাসের বিশ্লেষণে সন্দিহান হয়ে পড়লেও ওয়াশিংটন এবং নয়া দিল্লির নীতি নির্ধারকরা বহুপাক্ষিক জোট দুটির ভূমিকা এবং গঠনগত পার্থক্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভাবে ওয়াকিবহাল। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে অঞ্চলটিতে শান্তি এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে একাধিক বহুপাক্ষিক মঞ্চ এবং কর্মসূচির প্রয়োজন।
ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক বর্তমানে এক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই রূপান্তরকে কাঙ্ক্ষিত পথে চালনা করতে হলে নয়া দিল্লিকে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে হবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.