চিনা জনসাধারণের জন্য ২০২৩ হল ‘খরগোশের বছর’ অর্থাৎ একগুচ্ছ প্রতিকূল ঘটনা সত্ত্বেও বছরটি দেশটির জন্য সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। চিনের জনসংখ্যা গত ছ’দশকের মধ্যে প্রথম বারের মতো হ্রাস পেয়েছে, বেকারত্ব রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে যা সরকারকে পরিসংখ্যান প্রকাশে দাঁড়ি টানতে প্ররোচিত করেছে। রিয়েল এস্টেট ক্ষেত্রের অর্থায়নের উপর নিষেধাজ্ঞা চিনের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তিকে প্রভাবিত করেছে। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ব্যবসায়ীদের সংক্ষিপ্ত মেয়াদের জন্য হলেও আটক করা, গুপ্তচরবৃত্তি-বিরোধী আইনের প্রবিধান সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগের পরিবেশও বিঘ্নিত হয়েছে। এ হেন নেতিবাচক অবস্থার পাশাপাশি বিদেশি সংস্থাগুলি চিনে নিজেদের কর্মপরিধি হ্রাস করছে এবং ধনী চিনারা নিজেদের সম্পদ ক্রমশ বিদেশে স্থানান্তরিত করছেন। এই সব কিছুই ইঙ্গিত দেয় যে, দেশটির আকর্ষণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
রিয়েল এস্টেট ক্ষেত্রের অর্থায়নের উপর নিষেধাজ্ঞা চিনের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তিকে প্রভাবিত করেছে।
এর নেপথ্যে শি-কে কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না-র (সিপিসি) মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাঁর হাতে বাছাই করা উত্তরসূরি প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী কিন গাং-এর চিত্তাকর্ষক উত্থান হঠাৎ করে পতনে পর্যবসিত হয়েছে। পিপলস লিবারেশন আর্মি-র (পিএলএ) সংস্কারে অভিজাত রকেট ফোর্সের শীর্ষ জেনারেলদের এবং প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লি শাংফু-র ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়। এমনকি দুর্নীতি-বিরোধী অভিযানের জন্য নতুন করে চাপ দেওয়ার সময় সিপিসি ক্ষমতার উপর ভাগ্যের খাঁড়া ঝুলে রয়েছে। ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার মাত্র কয়েক মাস পরেই শি-র অব্যবহিত অধস্তন প্রাক্তন প্রিমিয়র লি কেকিয়াং-এর আকস্মিক মৃত্যু পার্টির মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করেছিল। শি-র শাসনব্যবস্থার চোখধাঁধানো শৈলীর ফলস্বরূপ এই উভয় অভ্যন্তরীণ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। প্রথমত, শি-র জিরো-কোভিড কৌশলের কারণে দীর্ঘায়িত লকডাউন, তার পরে চিনের শহরগুলিতে বিক্ষোভের কারণে আকস্মিক ভাবে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কার্যকলাপকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং সিপিসি-র বিশ্বাসযোগ্যতাতেও আঘাত হেনেছে। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে উপকূলীয় প্রদেশ ঝেজিয়াং দর্শিয়েছে যে, ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ২০২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে শ্মশানে মৃত্যুর হারের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৩%। পরে অবশ্য ইন্টারনেট থেকে এই পরিসংখ্যানের সব উল্লেখ মুছে ফেলা হয়। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্টের মেয়াদের সীমা অপসারণ ও উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি উন্মুক্ত রাখা এ কথাই নিশ্চিত করে যে, শি-র ক্ষমতার সমস্ত সাধনী আপাতদৃষ্টিতে চিরস্থায়ী মনে হলেও তা দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের অনেক নেতার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করে দেয় এবং চিনের অভিজাত নেতৃত্ব পরিসর ঝোংনানহাই-এ রাজনৈতিক স্থবিরতা সৃষ্টি করে।
একই ভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শি দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করেছেন, ভারতীয় সীমান্তে সৈন্য সংগ্রহ করেছেন, তাইওয়ানকে সংযুক্ত করার নিজস্ব অভিপ্রায় ঘোষণা করেছেন এবং জাপানের বিরুদ্ধে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছেন। উল্লেখ্য যে, শেষ দু’টি অর্থাৎ তাইওয়ান এবং জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রশক্তি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশ্চিম থেকে অব্যাহত প্রতিরোধের মাধ্যমেই শি-র সামরিক শক্তির প্রদর্শনকে প্রতিহত করা হয়েছিল। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটকে পুনরুজ্জীবিত করেছে এবং চিনের প্রতিবেশী অর্থাৎ ভারত, জাপান, ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করেছে। দীর্ঘমেয়াদে, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে, যার লক্ষ্য হল পারমাণবিক ডুবোজাহাজ তৈরি করা এবং স্বয়ংচালিত ডুবো যানবাহন, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উন্নত সাইবার দক্ষতা ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধের মতো উন্নত প্রযুক্তিতে সহযোগিতা করা। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে এগুলির চিনের তুলনায় ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমী শক্তিগুলি সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তিতে রফতানি নিষেধাজ্ঞা চালু করেছে এবং চিনে উন্নত প্রযুক্তি খাতে বহির্মুখী বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনায়কদের জন্য এ কথা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, কখন জাতীয় স্বার্থে যুদ্ধ করতে হবে; এবং এ কথা জানা আরও গুরুত্বপূর্ণ যে, কখন দেশকে রক্ষা করতে শান্তি স্থাপন করতে হবে। অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় চ্যালেঞ্জের সমন্বয় শিকে– যিনি এক সময়ে ‘চিন বিকল্প’কে তুলে ধরেছিলেন – ইউরোপীয় ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দ্বারা প্রচারিত বিদ্যমান ওয়াশিংটন-চালিত ব্যবস্থার এক বিকল্প হিসেবে বেজিং-কেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে তুলে ধরতে বাধ্য করেছে। শি পুরনো মহাদেশের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমিত করার চেষ্টা করেছেন, যেখানে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিরোধ রয়েছে। জি৭ দেশগুলির মধ্যে একমাত্র ইতালি শি-র বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এ (বিআরআই) যোগদান করেছে এবং চিনের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার সদস্য দেশগুলিকে নিরাপত্তার কারণে চিন থেকে ঝুঁকি-মুক্তকরণের আহ্বান জানিয়েছে এবং চিনা বৈদ্যুতিক যানবাহন আমদানির সঙ্গে সম্পর্কিত ভর্তুকি নিয়েও তদন্ত শুরু করেছে। শি দ্বারা প্রদত্ত একাধিক ভাষণের পরে বাণিজ্য সমস্যা সমাধান করার জন্য একাধিক ওয়ার্কিং গ্রুপ গড়ে তোলা হয়েছে।
শি পুরনো মহাদেশের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমিত করার চেষ্টা করেছেন, যেখানে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিরোধ রয়েছে।
নিজের উচ্চ অবস্থান থেকে নেমে এসে চিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাদের নিজ নিজ দেশের ‘উন্নয়ন’ এবং ‘পারস্পরিক সমৃদ্ধি’র প্রয়োজনীয়তার প্রস্তাব করেছে। এপিইসি সম্মেলনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর সাম্প্রতিক সফরের সময় মার্কিন শ্রোতাদের কাছে শি-র বক্তব্য ছিল এই যে, চিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে বা প্রতিস্থাপন করতে চায় না এবং তাঁর দেশ বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার এক বড় সুবিধাভোগীও। চিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগের শৃঙ্খলগুলি পুনরায় চালু করতে সম্মত হয়েছে, যা ২০২২ সালের অগস্ট মাসে তৎকালীন হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইপে সফরের পরে ক্রুদ্ধ শি-র কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। শি-ও মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহযোগিতা উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং চিন-মার্কিন সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে বিনয়ী মনোভাব বজায় রেখেছেন।
মনে করা হচ্ছে শি তাঁর ক্ষমতার অত্যধিক ব্যবহার করেছেন, যা একটি উল্লেখযোগ্য পুনর্বিন্যাসের দিকে চালিত করেছে। এবং এর ফলে সৃষ্ট ধাক্কা তাঁর প্রশাসনিক শৈলীকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের জন্য শি-র প্রদত্ত চাপ অসময়ে ঘটেছে কি না বা চিন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার উত্থানের সময়ে তার সামনে এক নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থাপনের জন্য নিজের ক্ষয়িষ্ণু সংস্থান পুনর্নির্মাণের জন্য আরও সময় নিচ্ছে কি না… সেই প্রশ্নগুলি দীর্ঘস্থায়ী। কিন্তু চিনা কৌশলবিদ সান জু-র কথা আমাদের মনে রাখতেই হবে: যুদ্ধ প্রতারণার উপর ভিত্তি করে হয়, যেখানে আক্রমণ করতে সক্ষম হলেও আক্রমণে অক্ষম… এমনটা ভানটা করাই দস্তুর।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.