Author : Harsh V. Pant

Published on Feb 04, 2023 Updated 0 Hours ago
২০২২: আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের নিজের স্বর খুঁজে পাওয়ার বছর

আর একটি ঘটনাবহুল বছর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্ভবত একটি আনতিবিন্দুতে এসে পৌঁছেছে। বছরের শুরুতেও যেমনটা অনেকে ভাবেননি, ঠিক সেভাবেই যুদ্ধ এবার ইউরোপীয় উপকূলে পৌঁছেছে এবং বৃহৎ শক্তির রাজনীতি আরও বেশি করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী অবস্থার সঙ্গে পৃথিবী মানিয়ে নিতে শুরু করার আগেই ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে নতুন প্রতিবন্ধকতার মুখে ঠেলে দিয়েছে। রাশিয়া-চিন অক্ষ জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চিন বিরোধ আরও তীব্র হয়েছে৷ প্রায় সমস্ত কিছুর অস্ত্রায়ন নতুন স্বাভাবিক বা নিউ নর্মাল রূপে উত্থিত হওয়ার কারণে অ-বিশ্বায়নকে কেন্দ্র করে বিতর্ক ঘনিয়ে উঠেছে। এই সমস্ত অস্থিরতার মাঝে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলি নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করার নিরিখে যথেষ্ট প্রস্তুত নয়। ফলে নতুন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর খোঁজ গতি পেয়েছে।

ভারতের বিদেশনীতিকে এক বছরের মধ্যে এই সব পরিবর্তনের মোকাবিলা করতে হয়েছে, যখন দেশটির কৌশলগত চিন্তাধারার কিছু মৌলিক ধারণা প্রকাশ্যে বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। ২০২০ সালের গলওয়ান সঙ্কট যেমন নয়াদিল্লিকে তার চিন নীতির পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য করেছিল, তেমনই ইউক্রেন যুদ্ধ ভারতকে তার রাশিয়া নীতির চালিকাশক্তিকে ফের তলিয়ে দেখার দাবি জানায়। ফলে দেশটি পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পৃক্তির নতুন শর্ত স্থাপনে বাধ্য হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে রুশ আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর এক দিকে পাশ্চাত্য এবং অন্য দিকে বিধ্বংসী রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য ভারত কীভাবে বজায় রাখবে, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। কিন্তু ভারসাম্য বজায় রাখার কাজ হিসেবে যা শুরু হয়েছিল, সেটির মাধ্যমে নয়াদিল্লি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক বিষয়ে নিজস্ব কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়েছে।

ভারত রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং এমনকি শক্তি সুরক্ষার সন্ধানে মস্কোর সঙ্গে তার শক্তি সম্পর্ক উন্নত করেছে। প্রকাশ্যে রাশিয়ার নিন্দায় পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গত না দেওয়ায় নয়াদিল্লি পাশ্চাত্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সমালোচনার সম্মুখীন হলেও পশ্চিমের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সারা বছর ধরে গতিশীল ছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়ার আগ্রাসনকে না-দেখে ভারত তার অবস্থান বদল করে, যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রকাশ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আহ্বান জানিয়ে এ কথা বলেছিলেন যে, এটি যুদ্ধের সময় নয়, এই মনোভাব বালি শীর্ষ সম্মেলনে জি২০ কমিউনিকে-তে তার জায়গা খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছে। বছর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখনও ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশা রয়েছে যে, ভারত ইউক্রেন সঙ্কটের অবসান ঘটাতে আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করবে, এমনকি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি কয়েক সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ফোনও করেছেন।

পাশ্চাত্য প্রথম দিকে রাশিয়ার প্রতি ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করলেও নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সংযোগ পশ্চিমী দেশগুলিকে ভারতীয় যৌক্তিকতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট আকর্ষক ছিল এবং এই ভাবনার অন্তর্নিহিত ভণ্ডামিকেও প্রকাশ্যে এনেছিল যে ‘ইউরোপের সমস্যাগুলি বিশ্বের সমস্যা, কিন্তু বিশ্বের সমস্যা ইউরোপের সমস্যা নয়’। আশ্চর্যজনক ভাবে এই বছর ভারত-ইউরোপ সম্পর্ক দ্রুত ত্বরান্বিত হয়েছে, কারণ ইউরোপীয় দেশগুলি অবশেষে ইন্দো-প্যাসিফিক এবং সেখানে ভারতের কেন্দ্রিকতার সঙ্গে সমন্বিত হয়েছে। রাশিয়া ইউরোপীয় পরিধিকে আঘাত করলেও এ কথা স্পষ্ট যে, দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত চ্যালেঞ্জগুলি চিন এবং তার আগ্রাসী কৌশল থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

সম্পৃক্ততার কৌশলগত যুক্তি দ্বারা চালিত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও উন্নত হয়েছে। বর্তমানে ইন্দো-প্যাসিফিক হল সেই কেন্দ্র, যার চারপাশে এই সম্পর্ক বিকশিত হচ্ছে। কারণ এটি একটি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক মাত্রা লাভ করছে। প্রশান্ত মহাসাগরে কোয়াড এবং মধ্যপ্রাচ্যে আইটুইউটু (ইজরায়েল, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি) দু’টি প্রধান ভৌগোলিক অঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিক নোঙর হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নয়াদিল্লি এবং ওয়াশিংটন তাদের দ্বিপাক্ষিকতার সীমা পেরিয়ে আরও উচ্চাভিলাষী অবস্থান গ্রহণ করছে এবং তাদের সম্পৃক্ততার কর্মসূচিকে পুনর্সংজ্ঞায়িত করছে।

বিশ্ব ভারতের বৈশ্বিক ভূমিকাকে আরও গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ নয়াদিল্লি আজ গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সমস্যাগুলিতে নেতৃত্ব দিতে ইচ্ছুক এবং সক্ষম বলে মনে করা হচ্ছে। সমমনস্ক দেশগুলির সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে নয়াদিল্লি বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করতে ইচ্ছুক। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে নয়াদিল্লি তার সভাপতিত্ব ব্যবহার করে সংস্কারকৃত বহুপাক্ষিকতা, শান্তিরক্ষা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও সামুদ্রিক নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলি, যা শুধুমাত্র ভারতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্টই নয় বরং বিশ্বের বৃহত্তর অংশের সঙ্গেও অনুরণিত, সেগুলিকে তুলে ধরেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের সম্পৃক্ততার মধ্যে বাস্তববাদের একটি নতুন উপলব্ধি অনুভূত হওয়ার পাশাপাশি ভারতের স্বর মূলত এক বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের প্রতিনিধিত্ব করে, যাদের কথা কেউ শোনেনি বা জানে না। এই অগ্রাধিকারটিকে ভারত তার জি২০ সভাপতিত্বেও বহাল রাখতে চলেছে। এমন এক সময়ে যখন বহুপাক্ষিকতা বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কটের সম্মুখীন, তখন বিশ্বের সম্মুখে উপস্থিত প্রধান চ্যালেঞ্জগুলির কয়েকটির জন্য পথ নির্দেশিকা প্রদানের উদ্দেশ্যে সকলের চোখ থাকবে নয়াদিল্লির জি২০ সভাপতিত্বের উপরে। বিশেষ করে যখন ভারতের প্রেক্ষাপট আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে, তখন এটি ভারতের জন্য এক আদর্শ সময়, যখন সে বৈশ্বিক ফলাফলকে রূপদানকারী এক ‘নেতৃস্থানীয় শক্তি’ হিসাবে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে তুলে ধরবে।

ভারতের বৈশ্বিক ভূমিকার এই ক্রমবর্ধমান উপলব্ধিতে একটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হওয়া নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বেজিংয়ের প্রতি বিরক্তি যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখন নয়াদিল্লির দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধরত চিনের বিপরীতে জমি আঁকড়ে লড়াই করার ঘটনা নতুন সুযোগের সৃষ্টি করেছে। ভারতীয় বিদেশনীতি এ বছর বেশ কিছু সুযোগকে কাজে লাগাতে সফল হয়েছে এবং একটি কৌশলগত বর্ণনা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যা বর্তমান টানাপড়েনের প্রয়োজনীয়তার জন্য উপযুক্ত। শীতের মাসগুলি পেরিয়েও যদি ইউক্রেন সঙ্কট বজায় থাকে, তবে তা ভারত-রাশিয়া সম্পর্ককেও বৃহত্তর পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসবে এবং চিনের চ্যালেঞ্জ অদূর ভবিষ্যতেও নয়াদিল্লির সংকল্পের পরীক্ষা চালিয়ে যাবে। নয়াদিল্লির বহুকথিত ‘বহুবিন্যাস’ এ বছরে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে পারে। কিন্তু ২০২২ সালে আর যাই হোক না কেন, ভারতের স্বর বৈশ্বিক মঞ্চে শুধুমাত্র প্রসারিতই হয়নি, তার পাশাপাশি তার স্বরের স্বাতন্ত্র্য এমন নতুন অনুরণন খুঁজে পেয়েছে, যা শীঘ্রই বিলীন হয়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।


এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান টাইমস-এ

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.