বৃহৎ শক্তির রাজনীতি এবং আঞ্চলিক শত্রুতার মাঝে আটকে পরা লোহিত সাগরে দুটি সাম্প্রতিক ঘটনা সেখানকার পুনরুত্থিত ভূ-রাজনীতির উপরে আলোকপাত করেছে। ইয়েমেনের জলভাগ এবং তার চারপাশে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান রোধে নজর রাখার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নতুন বহুজাতিক টাস্ক ফোর্স গঠন করার সিদ্ধান্ত এবং লোহিত সাগর অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি জোরদার করার জন্য ইরানের সিদ্ধান্ত বিপরীত প্রবণতাকেই তুলে ধরে যা লোহিত সাগরের ভূ-রাজনীতিকে তীব্রতর করে তুলতে পারে।
অঞ্চলটিতে নিজেদের স্বার্থ বজায় রেখে আঞ্চলিক ভারসাম্যের পুনর্মূল্যায়নের নিরিখে ‘লোহিত সাগর, বাব আল-মান্দেব এবং অ্যাডেন উপসাগরে আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার জন্য’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কম্বাইন্ড টাস্ক ফোর্স (সি টি এফ) ১৫৩ গঠন করেছে। সি টি এফ-১৫৩ কম্বাইন্ড মেরিটাইম ফোর্সের (সি এম এফ) অংশ হবে যার সদর দফতর বাহরিনের মানামায়। সি এম এফ কাঠামোর অধীনে কার্যকর তিনটি টাস্ক ফোর্সের (সি টি এফ ১৫০, ১৫১ এবং ১৫২) প্রচেষ্টার পরিপূরক হিসেবে এটি কাজ করবে। পশ্চিম ভারত মহাসাগরের কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলভাগে সি টি এফ-১৫৩ প্রতিষ্ঠা এবং সি এম এফ-এর ভৌগোলিক বিস্তৃতির সামগ্রিক সম্প্রসারণ সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে এবং বেশির ভাগই অপ্রচলিত নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর হবে। আই টু ইউ টু নামে পরিচিত ভারত, ইজরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি (ইউ এ ই) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্দেশীয় জোট এই দেশগুলির জন্য লোহিত সাগর অঞ্চলে একজোট হয়ে কাজ করার নতুন সুযোগ করে দিয়েছে। এ কথা গুরুত্বপূর্ণ যে, ভারতীয় নৌবাহিনী গত বছরের মতো এ বছরও লোহিত সাগরে মহড়া চালিয়েছিল।
আই টু ইউ টু নামে পরিচিত ভারত, ইজরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি (ইউ এ ই) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্দেশীয় জোট এই দেশগুলির জন্য লোহিত সাগর অঞ্চলে একজোট হয়ে কাজ করার নতুন সুযোগ করে দিয়েছে।
দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি হল, লোহিত সাগর অঞ্চলে ইরানের সামরিক উপস্থিতি সম্পর্কে ইজরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গ্যান্টজের উদ্বেগ প্রকাশ করা। তিনি বলেন যে, ‘গত কয়েক মাস ধরে এই অঞ্চলে আমরা বিগত এক দশকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইরানি সামরিক উপস্থিতি লক্ষ করেছি।’ ২০১৫ সালের পরবর্তী সময়ে ইয়েমেনে যুদ্ধ তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোহিত সাগর অঞ্চলে অংশত হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থন করার জন্য ইরানি সেনার ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি আরব এবং ইজরায়েলের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে আগ্রাসী আঞ্চলিক নীতি সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলির সঙ্গে তার কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে তীব্রতর করে তুলেছে। লোহিত সাগর অঞ্চলে ইরানের সামরিক উপস্থিতি এই সব আরব দেশের ক্ষমতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার কাজ করতে পারে। এর ফলে ইজরায়েলের জন্য নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ বৃদ্ধি পায় এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক জলপথে সামরিক উপস্থিতিকে নিশ্চিত করে।
লোহিত সাগরে আন্তর্জাতিক সামরিক উপস্থিতির প্রসার
গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলি লোহিত সাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলিতে তাদের নিজস্ব সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। লোহিত সাগরের উপকূলস্থ সাতটি দেশ বর্তমান : মিশর, সুদান, ইরিত্রিয়া ও জিবুতি পশ্চিম উপকূলরেখা এবং সৌদি আরব ও ইয়েমেন পূর্ব উপকূলরেখা তৈরি করে। ইজরায়েলের ইলাত বন্দরটি কৌশলগত জলপথটির উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত। এর মধ্যে মিশর, ইজরায়েল এবং সৌদি আরব তাদের নিজস্ব ক্ষমতার নিরিখে অঞ্চলটির প্রধান শক্তিশালী দেশ রূপে স্পষ্ট হলেও বাকি চারটি রাষ্ট্র দুর্বল, দরিদ্র, অশান্ত এবং অরক্ষিত। এ কথা আশ্চর্যের নয় যে, এ হেন একটি অঞ্চলে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সামরিক শক্তিগুলির আগ্রহ ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে।
রাশিয়া সুদানে একটি নৌঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে যেখানে জিবুতিতে ইতিমধ্যেই চিনের একটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ জলভাগগুলির মধ্যে যে কোনও একটিতে প্রভাব বিস্তার এবং সামরিক উপস্থিতি স্থাপনের অপরিহার্যতা তাদের প্রচেষ্টার চালিকাশক্তি। চিনের জন্য ২০১১ সালে লিবিয়া থেকে এবং ২০১৫ সালে ইয়েমেন থেকে অপসারণের ঘটনা একটি অগ্রবর্তী কার্যকর ঘাঁটি বহাল রাখার প্রয়োজনীয়তাকেই তুলে ধরে। জিবুতিতে ঘাঁটি, মিশর, ইজরায়েল এবং সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক ও সি এম এফ-এর মতো বহুদেশীয় প্রচেষ্টা আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে আমেরিকার ভূমিকাকেই মজবুত করে তোলে। লোহিত সাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন এবং রাশিয়ার উপস্থিতি বৃহৎ শক্তির রাজনীতিকে তীব্রতর করে তোলার ক্রমবিকশিত বাস্তবতার দিকেই নির্দেশ করে।
ইয়েমেনে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সাল থেকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং সৌদি আরব ইরান-সমর্থিত হুতিদের ক্ষমতা সীমিত করতে এবং দক্ষিণ লোহিত সাগর অঞ্চলে ইরানের প্রভাবকে খর্ব করার বিষয়ে তৎপর হয়েছে। তারা সুদান, জিবুতি এবং ইরিত্রিয়ার সঙ্গে অংশীদারি গড়ে তোলার মাধ্যমে তাদের প্রভাবের পাশাপাশি সামরিক উপস্থিতিও প্রসারিত করেছে। তুর্কিয়ে সুদানের সুয়াকিন বন্দর পুনর্নির্মাণ করতে আগ্রহী যা সোমালিয়ায় তার উপস্থিতির পরিপূরক হবে। মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিগুলি বৃহত্তর লোহিত সাগর অঞ্চলে অবস্থিত আফ্রিকার দেশগুলির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িত। মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিগুলির মধ্যে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা লোহিত সাগরের ভূ-রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ করেছে।
কয়েকটি দিক থেকে লোহিত সাগর অঞ্চলে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঔপনিবেশিক অতীতের কথাই মনে করিয়ে দেয়। লোহিত সাগর অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রিটেন, ইতালি এবং ফ্রান্সের মধ্যে তীব্র ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতার ফলস্বরূপ সাগরটির উপকূলীয় অঞ্চলে দেশগুলির উপনিবেশ গড়ে ওঠে। ব্রিটেন মিশর, সুদান, ইয়েমেন এবং ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেছিল, যেখানে ইতালি ইরিত্রিয়া এবং ইতালীয় সোমালিল্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করত। দক্ষিণ লোহিত সাগর অঞ্চলে জিবুতিতে তার ঘাঁটির মাধ্যমে ফরাসি সামরিক উপস্থিতি আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির এক ধ্রুবক বৈশিষ্ট্য। এই অঞ্চলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ই ইউ) এবং নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) জড়িত হওয়ার নেপথ্যে ফ্রান্স ছিল এক মূল চালিকাশক্তি। ই ইউ লোহিত সাগরে তার উপস্থিতি অপারেশন আটলান্টার মাধ্যমে এবং ন্যাটো অপারেশন ওশান শিল্ডের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছে। লোহিত সাগরের কাছে অবস্থিত সোমালিয়ার জন্য ই ইউ-র একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিগুলি বৃহত্তর লোহিত সাগর অঞ্চলে অবস্থিত আফ্রিকার দেশগুলির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িত। মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিগুলির মধ্যে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা লোহিত সাগরের ভূ-রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ করেছে।
এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক সামরিক উপস্থিতি সত্ত্বেও লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে সামুদ্রিক যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্নে হয়। লোহিত সাগরে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক স্বার্থ অঞ্চল সংশ্লিষ্ট দেশগুলি দ্বারা সর্বাধিক সুবিধার স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। দেশটিতে সক্রিয় বৈদেশিক সামরিক ঘাঁটি দ্বারা প্রদত্ত ভাড়ার অর্থ জিবুতিকে সচল রেখেছে। ইরিত্রিয়া এবং সুদান আঞ্চলিক শক্তিগুলির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে তাদের পৃথকীকৃত অবস্থার অবসান ঘটাতে চেয়েছে। তবে এই অঞ্চলে বহিরাগত সম্পৃক্ততার বিরূপ প্রভাবও পড়েছে। ইয়েমেন গৃহযুদ্ধ এবং আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে জেরবার হয়ে পড়েছে। জিবুতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের ঘাঁটিগুলির মধ্যে চাপা উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
এই অঞ্চলে তার কৌশলগত উপস্থিতি বাড়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের দু’টি মূল উদ্দেশ্য রয়েছে: এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব হ্রাস পেতে চলেছে এমন ধারণার পরিবর্তন ঘটানো এবং সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো বন্ধু দেশগুলিকে এই বিষয়ে আশ্বস্ত করা যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য তাদের চেয়ে পৃথক নয়। এ ছাড়া বিদ্যমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট ব্যাঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে তেল উৎপাদন বৃদ্ধিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সহযোগিতা চায়। ইরানের ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতি, জে সি পি ও এ পুনরুজ্জীবিত করার কাজে বিলম্ব এবং রাশিয়া ও পশ্চিমের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য খুব একটা সুখকর নয়।
লোহিত সাগরে তার কৌশলগত উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তও এই অঞ্চলে আফগানিস্তান পরবর্তী কোন্দলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইরানের রুশ অক্ষের শক্তিশালীকরণ, ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের প্রতি তার অবিরাম সমর্থন এবং একটি নড়বড়ে জে সি পি ও এ একত্রে অঞ্চলটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজের জায়গা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার তৎপরতার প্রধান কারণ। বিশেষ করে অ্যাব্রাহাম অ্যাকর্ডের পরবর্তী কালে আমেরিকা পশ্চিম এশিয়ায় দ্রুত পরিবর্তনশীল আঞ্চলিক সমীকরণের মাঝেও নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়।
১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল খুলে দেওয়ার পর থেকে লোহিত সাগরের কৌশলগত গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে গিয়েছে। সুয়েজ খাল লোহিত সাগরকে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করে এবং এটি বিশ্ব বাণিজ্যের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধমনী। গত বছর একটি বিশালাকার মালবাহী জাহাজ এইচ এম এস এভার সুয়েজ খালে আটকে পড়লে তা বিশ্ব অর্থনীতিতে আতঙ্কের প্রবাহ ছড়িয়ে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি লোহিত সাগর চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। লোহিত সাগরে সাম্প্রতিক সময়ে বৃহৎ শক্তিগুলির দ্বন্দ্ব শুধু মাত্র বাণিজ্যের নিরিখেই নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য এই অঞ্চলের অব্যাহত গুরুত্বকেই মনে করিয়ে দেয়।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.