Published on Mar 05, 2025 Updated 0 Hours ago

বেজিংয়ের অবৈধ, জবরদস্তিমূলক, আগ্রাসী প্রতারণামূলক' কৌশল নয়াদিল্লিকে পরীক্ষার মুখে ফেলবে।

চিন-ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দুর্গম পথ

ভারতের সঙ্গে গতিশীলতার কঠিন গতিপথের প্রতিটি সন্ধিক্ষণেই চিনের চমক দেখানোর প্রবণতা যথেষ্ট সন্দেহজনক। এমন একটি ধারণা ছিল যে, চিন ভারত ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে ডেপসাং ডেমচোকে টহল বন্ধ করা এবং সেনা বিচ্ছিন্নকরণের প্রক্রিয়ায় সম্মত হওয়ার পরে এবং উভয় পক্ষই চার বছরের সামরিক স্থবিরতার পরে নিজেদের মধ্যেকার সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে

চিনের বেআইনি প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের ফলে নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলএসি) ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। চিন জিনজিয়াংয়ের হোতান প্রিফেকচারে দুটি কাউন্টি তৈরি করেছে এবং এই নতুন প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলির কিছু অংশ লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলেও অন্তর্ভুক্ত। হেন ঘটনাপ্রবাহের সময়টি বেশ আকর্ষণীয় কারণ দুই বিশেষ প্রতিনিধি (এসআর) অর্থাৎ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের বৈঠকের পরেই এমনটা ঘটেছে ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর বেজিংয়ে সরকারি সফরের সময় স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির দরুন এসআর-এর কাঠামো তৈরি হয়েছিল, যার মাধ্যমে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সীমানা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। নয়াদিল্লি অবিলম্বে এই কথা বলে একটি কূটনৈতিক প্রতিবাদ জানিয়েছিল যে, ভারত বেজিংয়ের ভারতীয় ভূখণ্ডের অবৈধ দখলে সম্মত হয়নি এবং নতুন প্রশাসনিক ইউনিটগুলির ঘোষণা কখনওই ভারতের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে না।

চিন জিনজিয়াংয়ের হোতান প্রিফেকচারে দুটি কাউন্টি তৈরি করেছে এবং এই নতুন প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলির কিছু অংশ লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলেও অন্তর্ভুক্ত।

চিনের একতরফা পদক্ষেপ এ ভাবে একটি চুক্তির ভুল ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করেছেআঞ্চলিক বিরোধ মোকাবিলায় চিনের প্রধান হাতিয়ারই হল প্রতারণা। ফিলিপিন্সের বিদেশমন্ত্রক দক্ষিণ চিন সাগরে বিদ্যমান সামুদ্রিক বিরোধের প্রেক্ষিতে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য চিনের তরফে ভুয়ো আখ্যানপ্রচারের অভিযোগ এনেছে। ২০২৪ সালে চিন একটি অডিয়ো রেকর্ডিং প্রকাশ করার পরে ফিলিপিন্সের তথাকথিত এক ঊর্ধ্বতন নৌ কর্মকর্তা এবং এক চিনা কূটনীতিকের মধ্যে বাক্‌যুদ্ধ বেড়ে যায় এবং চিন এই ধারণাই প্রতিষ্ঠা করার তীব্র চেষ্টা চালায় যে, সেকেন্ড মাস শোল সম্পর্কিত একটি বিরোধের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক বোঝাপড়া ছিল।

চিন তিব্বতের ইয়ালুজাংবু নদীর উপর বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের উপর জোর দিয়েছে। নতুন পরিকল্পনাটিতে চিনের ইয়াংজি নদীর উপর থ্রি গর্জেস বাঁধের তিন গুণ বিদ্যুৎ-উৎপাদন সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে - যা এখন পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। নয়াদিল্লি এ নিয়ে পরিবেশগত উদ্বেগ উত্থাপন করেছে এবং স্বচ্ছতা সম্পর্কিত বিষয়গুলি নিম্ন নদীতীরবর্তী অঞ্চলগুলির সঙ্গে এ নিয়ে পরামর্শ করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে। এ বিষয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীর নীচের অংশের রাজ্যগুলির বিষয়ে সংবেদনশীলতাও প্রকাশ করা হয়েছে।

এই আশঙ্কা নেহাতই ভিত্তিহীন নয় কারণ চিন এর আগে জলেরও অস্ত্রায়ন করার চেষ্টা করেছে। মেকং নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিম্ন নদী তীরবর্তী রাজ্যগুলিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ভারতের ঘরের কাছে ভুটানের ডোকলাম ত্রিপাক্ষিক সঙ্গমে ২০১৭ সালের সামরিক সংঘর্ষের সময় বেজিং নয়াদিল্লির সাথে হাইড্রোলজিক্যাল ডেটা অর্থাৎ জল সংক্রান্ত যে কোনও রকমের তথ্য ভাগ করে নিতে অস্বীকার করেছিল। এই ধরনের তথ্য ভাগ করে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এ হেন তথ্য বন্যা অন্যান্য অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্ভাবনার পূর্বাভাস দিতে সাহায্য করে। চিন আবার নিজে সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের ভূমিকা পালন করতে চাইছে কি না তা নিয়েও নেতিবাচক অনুভূতি রয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্যই জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে কি না, যা লাদাখের মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ সিকিমের মতো কয়েকটি সীমান্তবর্তী রাজ্যে নিয়মিত ব্যবধানে ব্যাপক প্রভাব ফেলছেতিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, হিমালয় পর্বতমালা অন্যান্য রাজ্যে বিস্তৃত থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে। এর নেপথ্যে কোনও শত্রু দেশজড়িত কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য নিরাপত্তা সংস্থা নানাবিধ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে

বেজিং আন্তরিক ভাবে দুই পক্ষেরই জয়ের জন্য সহযোগিতার ধারণাকে প্রচার করেকিন্তু বাস্তবে নিজের প্রতিবেশীদের সঙ্গে ন্যায্য ন্যায়সঙ্গত উপায়ে প্রাকৃতিক সম্পদ ভাগাভাগির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়ার চাইতে চিনের নিজের স্বার্থ পূরণকেই দর্শায়।

বেজিং জলবায়ু পরিবর্তন নির্গমনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রচেষ্টায় নিজেকে একটি দায়িত্বশীল অংশীদার হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জৈব বৈচিত্র্য সংক্রান্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের শীর্ষ সম্মেলনে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০৬০ সালের মধ্যে চিনের কার্বন নিরপেক্ষ হয়ে ওঠার লক্ষ্যমাত্রার কথা ঘোষণা করেছিলেন। তাই চিন ইয়ালুজাংবু নদী পরিকল্পনায় একটি দূষণহীন মাত্রা যোগ করতে চায় এবং নিজের লক্ষ্য অনুযায়ী কার্বন নিরপেক্ষ শক্তির উৎস পূরণের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে সরে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটিকে তুলে ধরতে চায়। বিদ্যুৎ প্রকল্পটি কী ভাবে তিব্বত মালভূমির ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্র, স্থানীয় বাসিন্দা নদীর নীচের দিকে অবস্থিত দেশগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে, সে সম্পর্কে উদ্বেগকে চিন খুব স্বাভাবিক ভাবেই এড়িয়ে গিয়েছেএটি নয়াদিল্লিকে পরিবেশের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতিতে শি-র মহৎ কথা এবং বিভ্রান্তিকর কাজের মধ্যকার ব্যবধান বিশ্বের সামনে তুলে ধরার একটি সুযোগ করে দিয়েছেথ্রি গর্জেস ড্যাম নির্মাণের জন্য যদি ১.৪ মিলিয়ন চিনা বাস্তুচ্যুত হন, তা হলে বর্তমান জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের দরুন কত জনের ঘর ভেসে যাবে, তা নিয়েও অবশ্যই আলোচনা হওয়া উচিত। এ ছাড়া প্রকৌশলীদেরকে সুড়ঙ্গ নির্মাণের জন্য কঠিন পর্বত পাথরের মধ্য দিয়ে ড্রিল করতে হবেএর ফলে নদীর প্রবাহ কিছুটা হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের খাতে কাজে লাগবে। জানুয়ারি মাসে তিব্বতে ভূমিকম্পের পর এ হেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি ভূখণ্ডে এমন ধরনের খননকাজ আদৌ কতটা নিরাপদ তা ঘোষণা করার দায়িত্ব বেজিংয়ের উপরেই বর্তায়। অবশেষে, বেজিং আন্তরিক ভাবে দুই পক্ষেরই জয়ের জন্য সহযোগিতার ধারণাকে প্রচার করেকিন্তু বাস্তবে নিজের প্রতিবেশীদের সঙ্গে ন্যায্য ন্যায়সঙ্গত উপায়ে প্রাকৃতিক সম্পদ ভাগাভাগির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়ার চাইতে চিনের নিজের স্বার্থ পূরণকেই দর্শায়।

অক্টোবর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর মধ্যে একটি বৈঠকের পরপরই যা কিনা আবার ২০২০ সালে গলওয়ান সীমান্ত সংঘর্ষের পর দুই দেশপ্রধানদের মধ্যে প্রথম বৈঠক ছিল - উভয় পক্ষ এলএসি বরাবর উত্তেজনা হ্রাস করতে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। নতুন ঘটনাপ্রবাহ অবশ্য ভারত-চিনের সেই সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে, সাম্প্রতিক সময়ে যে সম্পর্কটির উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

নতুন ঘটনাপ্রবাহ অবশ্য ভারত-চিনের সেই সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে, সাম্প্রতিক সময়ে যে সম্পর্কটির উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

উপসংহারে বলা যায়, একজন ফিলিপিনো জেনারেল যুক্তি দিয়েছেন যে, বেজিংয়ের যুদ্ধবাজ আচরণ ধূসরাঞ্চলের যুদ্ধের ম্লান পরিভাষার ঊর্ধ্বে উঠেছে। চিনের এ হেন আচরণকে নতুন ভাবে আইসিএডিবলে অভিহিত করা হচ্ছে। অর্থাৎ ইললিগ্যাল, কোয়েরসিভ, অ্যাগ্রেসিভ অ্যান্ড ডিসেপটিভ’, যা তরজমা করলে দাঁড়ায় অবৈধ, বলপূর্বক, আক্রমণাত্মক প্রতারণামূলকদক্ষিণ চিন সাগরে ফিলিপিনো বেসামরিক জাহাজের বিরুদ্ধে চিনের ক্রমবর্ধমান সামুদ্রিক দাদাগিরি ও জল কামান ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ফিলিপিন্সের তরফে এই শব্দবন্ধের ব্যবহার করা হয়েছে। শি-র সামরিক-জবরদস্তি যদি কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থও হয়, তা হলেও আমাদের সেই সব অপ্রচলিত ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, যার মাধ্যমে চিন এলএসি ও তার ঊর্ধ্বে উঠে ভারতকে বাধা দিতে পারে। আগামী মাসগুলিতে তাই বেজিংয়ের আইসিএডিকৌশলটি নয়াদিল্লি সতর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াকে পরীক্ষার মুখে ফেলবে।

 


এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ফিন্যানশিয়াল এক্সপ্রেস-এ।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.