Published on Jan 15, 2024 Updated 3 Days ago

গোটা বিশ্ব তাইওয়ানের নির্বাচনকে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে কারণ এটি এশিয়ায় শক্তির সমীকরণকে আকার দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে

তাইওয়ানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এশিয়ার ভবিষ্যৎকে আকার দিতে পারে

২০২৪ আক্ষরিক অর্থেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর হয়ে উঠতে চলেছে। কারণ এ বছর গোটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে প্রস্তুত। ১৩ জানুয়ারি নির্ধারিত তাইওয়ানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল তার সীমানা ছাড়িয়ে অন্যত্রও প্রতিফলিত হতে চলেছে।

 

তাইওয়ানের ভোটাররা দ্বীপটিকে একটি স্ব-শাসিত দ্বীপ বলে মনে করে। চিআবার সেটিকে এমন একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ বলে মনে করে, যেটিকে চিন শান্তিপূর্ণ উপায়ে অথবা যুদ্ধের মাধ্যমে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে পুনরায় সংযুক্ত করায় আগ্রহী। যাই হোক, তাইওয়ানের উপর চিনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) পরিকল্পনাগুলি এই সত্য দ্বারা বিঘ্নিত হয় যে, চিন তাইওয়ানকে নিজের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করার চেষ্টা চালালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইনত দ্বীপটিকে রক্ষা করতে দায়বদ্ধ। তাইওয়ানের নির্বাচনের প্রার্থীরা হলেন ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) লাই চিং-তে, বিরোধী দল কুওমিনতাং-এর (কেএমটি) হাউ ইউ-ইহ এবং তাইওয়ান পিপলস পার্টি (টিপিপি) কো ওয়েন-জে। ২৭-২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে পরিচালিত একটি মতামত সমীক্ষা দর্শিয়েছে যে, প্রায় ৩৯.৬ শতাংশ উত্তরদাতা ডিপিপি-কে সমর্থন করেছেন এবং কেএমটি টিপিপি-পক্ষে মতদান করেছেন যথাক্রমে ২৮.৫ শতাংশ ও ১৮.৯ শতাংশ মানুষ

১৩ জানুয়ারি নির্ধারিত তাইওয়ানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল তার সীমানা ছাড়িয়ে অন্যত্রও প্রতিফলিত হতে চলেছে।

 

চিনের প্রশ্ন

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং ঘন ঘন মহড়া আকাশপথে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে এই দ্বীপটিকে সংযুক্ত করার জন্য চিনের নিয়মিত সামরিক হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে তাইওয়ানের ভোটারদের মনে সংঘাতের ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। চিন বলেছে যে, তারা এক দিকে শান্তি ও সমৃদ্ধি এবং অন্য দিকে সংঘাত ও অর্থনৈতিক পতনের মধ্যে তাইওয়ানের নির্বাচনকে বিবেচনা করে। চিন স্বাধীনতামনস্ক রাজনৈতিক দলগুলির বিরোধিতা এবং ‘১৯৯২ সালের ত্য'কে সমুন্নত রাখার জন্য তাইওয়ানের কাছে আবেদন রাখার চেষ্টা চালিয়েছে। ১৯৯২-এর ঐকমত্যটি সেই রাজনৈতিক সমঝোতাকেই দর্শায়, যেটি তাইওয়ানের তৎকালীন শাসক কেএমটি মূল ভূখণ্ডের সিপিসি-র মধ্যে ঘটেছিল এবং সেই সময়ে উভয়েই সম্মত হয়েছিল যে শুধু মাত্র ‘ওয়ান চায়না’ই বিদ্যমান। এই সম্মতি একটি মোডাস ভিভেন্ডিকেই সুযোগ করে দেয়, যা উভয় যুদ্ধকারী পক্ষকে নিজ নিজ স্বার্থ অনুযায়ী এই শব্দবন্ধটিকে সংজ্ঞায়িত করার অনুমতি প্রদান করে। এই ব্যবস্থা উভয় পক্ষেরই স্বার্থের অনুকূল ছিল। এটি সমগ্র প্রণালী জুড়ে বিচ্ছিন্ন দেশবাসী সম্পৃক্ত হওয়ার ভিত্তিও প্রদান করেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে কেএমটি-র ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাইওয়ানের সুশীল সমাজে রোষের জন্ম হয়, যাঁরা মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তাইওয়ানের সংযুক্তিকরণকে ইতিবাচক বলে মনে করতেন না। ডিপিপি-র সাই ইং-ওয়েনের ক্ষমতায় আসার নেপথ্যে অন্যতম কারণ ছিল এই বিক্ষোভ। তাইওয়ানের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি ১৯৯২ সালের ঐকমত্য মেনে চলতে অস্বীকার করেন, যে কারণে বেজিং তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদীর তকমা দেয়। হংকংয়ে সুশীল সমাজের প্রচারকারীদের নেতৃত্বে চিনে ২০১৯ সালের ব্যাপক বিক্ষোভের পর ২০২০ সালে সাই-এর অভূতপূর্ব বিজয় বেজিংয়ের মনে শঙ্কা সৃষ্টি করেছিল। তাইওয়ানের ভোটারদের কাছে সাই-এর আবেদন ছিল এই যে, তাঁদের মতদান আসলে দ্বীপটিতে গণতন্ত্র রক্ষা’র জন্য জরুরি। তাইওয়ানের জন্য বেজিংয়ের করা ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’র কাঠামো প্রত্যাখ্যান করার নেপথ্যে প্রধান কারণ হিসেবে সাই হংকংয়ে ২০১৯ সালের বিক্ষোভকে দর্শান। তাইওয়ানের সংযুক্তির বাস্তবায়নের জন্য চিন এই কাঠামোর উপর অনেক আশা রেখেছিল।

১৯৯৭ সালে ব্রিটেন হংকংকে চিনের কাছে এই শর্তে তুলে দেয় যে, শহর-রাষ্ট্রটি ‘ওয়ান কান্ট্রি টু সিস্টেমস’ বা ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হবে। এই ব্যবস্থার অধীনে নগর-রাষ্ট্রের স্বায়ত্তশাসন বজায় থাকবে এবং সিপিসি শাসনের বৃহত্তর ক্ষমতার আওতায় তার পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে পারবে, যেখানে সিপিসি তার প্রতিরক্ষা বৈদেশিক বিষয়গুলি পরিচালনা করবে। বেজিং এক দেশ দুই ব্যবস্থা চুক্তি এই আশাতেই মেনে চলেছে যে, এই ব্যবস্থা তাইওয়ানকে ভবিষ্যতে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করতে প্রলুব্ধ করবে।

 

হংকংয়ে সুশীল সমাজের প্রচারকারীদের নেতৃত্বে চিনে ২০১৯ সালের ব্যাপক বিক্ষোভের পর ২০২০ সালে সাই-এর অভূতপূর্ব বিজয় বেজিংয়ের মনে শঙ্কা সৃষ্টি করেছিল।

 

সাম্প্রতিক সময়ে বেজিং তাইওয়ান প্রসঙ্গে অগ্রসর হয়েছে। ২০২২ সালের গস্ট মাসে তৎকালীন ইউএস হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করার পরে বেজিং তার সামরিক শক্তি প্রদর্শন করেছিল। আমেরিকা এবং তাইওয়ানের নেতৃত্বের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতাকে চিএক চি ধারণার উপর আঘাত বলেই মনে করে। এর পরে, পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) সামরিক মহড়া মঞ্চস্থ করে, যা একটি আংশিক অবরোধের সমতুল্য ছিল এবং তাইওয়ান প্রণালীর মধ্যরেখা বরাবর বিমান চলাচলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এই প্রণালীটি একটি ডি ফ্যাক্টো ডিমার্কেশন পয়েন্ট বা কার্যত নির্ণায়ক বিন্দু হিসাবে কাজ করে। ন্যাশনাল পার্টি কংগ্রেসে নিজের বক্তৃতায় শি তাইওয়ানকে শান্তিপূর্ণ ভাবে সংযুক্ত করার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেওয়ার পাশাপাশি বলেছিলেন যে, চাইলে চিন শক্তি প্রয়োগ করেও এমনটা করতে পারে।

 

এই নির্বাচনেও আন্তঃপ্রণালী সম্পর্ক একটি মুখ্য বিষয়। ডিপিপি-র প্রার্থী লাই - যিনি তাইওয়ানের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন - এর আগে তাইওয়ানকে স্বাধীন করার বিষয়ে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ্যে বলেছিলেন। প্রচারাভিযানের সময়ে লাই দ্বীপটিকে স্বাধীন এবং সার্বভৌম’ বলে বর্ণনা করেছেন, যা কার্যত আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার দাবিরই ইঙ্গিতবাহী। কেএমটি চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততায় আগ্রহী। টিপিপি আবার ডিপিপি-কে সংঘাতপন্থী হিসেবে এবং কেএমটি-কে চিনের সঙ্গে ‘সন্দেহজনক’ সম্পর্ক স্থাপনকারী বলে মনে করে।

আমেরিকা এবং তাইওয়ানের নেতৃত্বের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতাকে চিএক চি ধারণার উপর আঘাত বলেই মনে করে।

 

গণতন্ত্রে সরকারি অবস্থান প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনগণের আবেগ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রকৃতপক্ষে, তাইওয়ান সরকারের মেনল্যান্ড অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিল দ্বারা ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত একটি মতামত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, ৮৫ শতাংশ উত্তরদাতা এক দেশ দুই ব্যবস্থা’ কাঠামোর বিরোধী। সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে যে, সাক্ষাৎকার প্রদানকারী প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ তাইওয়ানের আশপাশে পিএলএ বিমান এবং যুদ্ধজাহাজ চলাচলের মতো বেজিংয়ের জবরদস্তিমূলক কৌশলের স্পষ্ট বিরোধিতা করেছেন। সবশেষে প্রায় ৯০ শতাংশ উত্তরদাতা তাইওয়ানের আত্মরক্ষার দক্ষতা বৃদ্ধি এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছেন। ২০২২ সালে প্রকাশিত তাইওয়ানের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অ চেংচির আর কটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, উত্তরদাতাদের ৭৩ শতাংশই চিনা হামলার ঘটনায় দ্বীপটিকে রক্ষা করতে প্রস্তুত। এ সবই ইঙ্গিত দেয় যে, তাইওয়ানের সমাজ চিনের সঙ্গে সংযুক্তিকরণের পক্ষে নয়।

 

ভারত-তাইওয়ান সম্পর্ক

এ ভাবে ২০২৪ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল তাইওয়ানের বিদেশনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিরক্ষা এবং চিনের সঙ্গে আন্তঃপ্রণালী সম্পর্ককে নির্ধারণ করবে। সাই প্রশাসনের নিউ সাউথ-বাউন্ড পলিসি-র (এনএসপি) অধীনে, ভারত-তাইওয়ান সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে, যদিও ভারত তাইওয়ানকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। নীতিটিতে তাইওয়ান শ্চিম ভারতের মধ্যে প্রযুক্তি, শিক্ষা সংস্কৃতিতে আদান-প্রদান এবং সহযোগিতা উন্নত করতে আগ্রহ দর্শানো হয়েছে। সেমিকন্ডাক্টর সংস্থাগুলি ভারতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। তাইপে ইকোনমিক অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা চলছে যা, ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বইতে ডি ফ্যাক্টো কূটনৈতিক সম্পর্ক হিসাবে কাজ করবে। ডিডিপি-র বিজয় এই উদ্যোগগুলিকে আরও সুসংহত করার ক্ষমতা রাখলেও কেএমটি যদি ক্ষমতায় আসে, তা হলে তা ভারতের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে। এমন একটি সময়ে যখন ভারত ও চিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চাপানউতোর বিদ্যমান এবং দুই পক্ষই সীমান্তে সেনা মোতায়েন বৃদ্ধি করছে, তখন কেএমটি-র জয় সদ্যোজাত ভারত-তাইওয়ান সম্পর্কের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। বিশ্ব তাইওয়ানের নির্বাচনকে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে কারণ সাই-এর উত্তরসূরি যিনিই হোন না কেন, তা এশিয়ায় শক্তি-সমীকরণকে আকার দিতে পারে।

 


কল্পিত এ মানকিকর অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ফেলো।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.