২৮ এপ্রিল নয়াদিল্লি আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ প্রচেষ্টা এবং কার্যকর বহুপাক্ষিকতা নিয়ে আলোচনার জন্য সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সদস্য দেশগুলির প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের সম্মেলন আয়োজন করে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে রাশিয়া, চিন, ইরান, বেলারুশ, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান এবং তাজিকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত অংশগ্রহণ দেখা যায়। ভার্চুয়ালি এই সম্মেলনে যোগ দেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা।
মন্ত্রীরা এসসিও সনদের অধীনে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা চালান, একটি প্রোটোকল স্বাক্ষর করেন, এই অঞ্চলকে ‘নিরাপদ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ’ করার ব্যাপারে তাঁদের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং সর্বসম্মত ভাবে সন্ত্রাসবাদের তীব্র নিন্দা করেন। রাজনাথ সিং এসসিও সদস্য দেশগুলিকে সম্মিলিত ভাবে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার জন্য কাজ করা এবং তার সমর্থকদের দায়বদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। তিনি সদস্য দেশগুলিকে ‘সন্ত্রাসবাদকে কার্যকর ভাবে মোকাবিলা করা’কে শীর্ষ অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচনা করা এবং এসসিও-কে আরও বিশ্বাসযোগ্য ও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসাবে গড়ে তোলারও আহ্বান জানান। তিনি এসসিও সদস্যদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা এবং ‘অঞ্চলের বহুমাত্রিক কল্যাণ’ সাধনে নয়াদিল্লির প্রতিশ্রুতিও সুনিশ্চিত করেছেন। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় (এলএসি) চিনের আগ্রাসনের একটি উদাহরণ দর্শিয়ে তিনি সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান জানিয়ে একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক সহযোগিতা পরিকাঠামো তৈরিরও আহ্বান জানিয়েছেন।
ভারতকে ২০০৫ সালে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেওয়া হয় এবং ২০১৭ সালের জুন মাসে আস্থানা শীর্ষ সম্মেলনে দেশটি এসসিও-র পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করেছিল৷ পূর্ণ সদস্য হিসাবে তার সূচনা থেকেই ভারত শুধু মাত্র সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে এসসিও-র মূল কর্মসূচিকে শক্তিশালী করাকেই সমর্থন করেনি, বরং স্থিতিশীলতা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক সংযোগের প্রতি তার প্রতিশ্রুতিকে সশক্ত করেছে। নয়াদিল্লি সর্বদা ‘সংঘাত-বিধ্বস্ত দেশে স্থায়ী শান্তি ও পুনর্মিলনের জন্য আফগান-নেতৃত্বাধীন, আফগান-মালিকানাধীন এবং আফগান-নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া’কে সমর্থন করে এসেছে। সহযোগিতা জোরদার করার প্রচারে ভারত অবিচল ভাবে তার কূটনৈতিক মূলধন ব্যবহার করেছে এবং আঞ্চলিক প্রতিপক্ষদের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য এসসিও মঞ্চকে কাজে লাগিয়েছে। ২০১৮ সালে চিনের কিংদাওতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংক্ষিপ্ত শব্দ SECURE ব্যবহার করেছিলেন, যার লক্ষ্য ছিল এসসিও-র সামনে উপস্থিত তীব্র আঞ্চলিক সমস্যাগুলির উপর আলোকপাত করা। সেখানে S-এর অর্থ হল নাগরিকদের নিরাপত্তা, E- সকলের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন, C-অঞ্চলকে সংযুক্ত করা, U- জনগণকে একত্র করা, R- সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি সম্মান এবং E-এর অর্থ হল পরিবেশগত সুরক্ষা।
ভারত শুধু মাত্র সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে এসসিও-র মূল কর্মসূচিকে শক্তিশালী করাকেই সমর্থন করেনি, বরং স্থিতিশীলতা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক সংযোগের প্রতি তার প্রতিশ্রুতিকে সশক্ত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদী জোর দিয়েছিলেন যে, আফগানিস্তানে স্থায়ী শান্তি কেবল মাত্র এসসিও-এর পৃষ্ঠপোষকতায় আফগানিস্তান কন্ট্যাক্ট গ্রুপের (এসিজি) মাধ্যমেই অর্জন করা যেতে পারে। পারস্পরিক স্বার্থের নিরিখে কাবুলের সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা বজায় রাখার জন্য ২০০৫ সালে এসিজি তৈরি করা হয়েছিল। পশ্চিম এশিয়ায় হিংসা বৃদ্ধি পাওয়ার পর পরই গোষ্ঠীটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। যদিও ২০১৭ সালে এসিজি পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল এবং ভিন্ন স্বার্থ ও আস্থার ঘাটতি এসসিও সদস্য দেশগুলিকে আফগানিস্তানের বিষয়ে অন্যান্য আঞ্চলিক বহুপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা চালাতে বাধ্য করেছিল। এর পাশাপাশি কিছু এসসিও সদস্য রাষ্ট্র আফগানিস্তান এবং তালিবানকে তাদের নিজস্ব ভূ-অর্থনৈতিক এবং ভূ-কৌশলগত স্বার্থের জন্য পশ্চিমী শক্তির বিরুদ্ধে এবং একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। কিছু সদস্য দেশ ইউরেশীয় অঞ্চলে ভারতের ক্রমবর্ধমান মর্যাদাকে বাধা দিতে বিদেশ নীতির হাতিয়ার হিসেবে সন্ত্রাসবাদকে ব্যবহার করেছে।
রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ ভারতের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং জম্মু ও কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলায় সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলা, যেখানে পাঁচ জন সৈন্যের মৃত্যু হয়েছে, তা এসসিও সদস্য দেশগুলির চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ভারতকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে এসসিও-র প্রভাবশালী সদস্যদের সংবেদনশীল করতে হবে। একই সঙ্গে এসসিও এবং বৃহত্তর ইউরেশীয় অঞ্চলে আল-কায়দা, ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান প্রভিন্স (আইএসকেপি), লস্কর-ই-তইবা (এলইটি), জইশ-ই-মোহাম্মদ (জেইএম), ইসলামিক মুভমেন্ট অফ উজবেকিস্তান-এর (আইএমইউ) মতো ভয়ঙ্কর আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির উগ্র চরমপন্থী শক্তি থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখতে হবে। প্রসঙ্গটি চিন, রাশিয়া এবং মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রের (সিএআর) সঙ্গে অনুরণিত হয়, যারা ক্রমবর্ধমান হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এসসিও অঞ্চলের আর একটি সাধারণ চ্যালেঞ্জ হল আফ-পাক অঞ্চল থেকে নির্গত অবৈধ মাদক ব্যবসা। ২০২১ সালে আফিম এবং হেরোইন সরবরাহের ৮০ শতাংশেরও বেশি আফগানিস্তান থেকে বিভিন্ন পথের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আফিম বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। মাদক ব্যবসায় সন্ত্রাসী সংগঠনের বৃহত্তর সম্পৃক্ততা এসসিও-র জন্য নতুন ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়েছে। এই অঞ্চলের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী এবং উগ্র ইসলামপন্থীদের দ্বারা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের জন্য এটি একটি উল্লেখযোগ্য অর্থায়নের উৎস হয়ে উঠেছে।
একটি অস্থির আফগানিস্তান এবং আফ-পাক অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী আঁতুড়ঘর এসসিও সদস্য রাষ্ট্র এবং ইউরেশিয়ার অন্য আঞ্চলিক দেশগুলি দ্বারা শুরু করা সংযোগ প্রকল্পগুলিতে নানাবিধ বাধার জন্ম দিয়েছে৷ উপরন্তু, পাকিস্তান তার ভূখণ্ডের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপনের সুবিধা প্রত্যাখ্যান করে কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থকে বাধা প্রদান করেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া (টিএপিআই) পাইপলাইন ২০০৬ সাল থেকে আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা এবং পাকিস্তানের বাধার কারণে স্থবির হয়ে রয়েছে। এর বিপরীতে ইসলামাবাদ চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) অধীনে ফ্ল্যাগশিপ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) কাজকে সহজতর করে তুলেছে, যেটিতে বিনিয়োগের পরিমাণ হল ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সিপিইসি ভারতের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক সমন্বিতকরণ লঙ্ঘন করে পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর (পিওকে) জুড়ে বিস্তৃত। যাই হোক, ভারত ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের চাবাহার বন্দর এবং রাশিয়া, ইরান ও ভারতের মধ্যে ৭২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহণ করিডোর বা নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোরের (আইএনএসটিসি) মতো এই অঞ্চলে নতুন সংযোগ প্রকল্পগুলির কাজ শুরু করেছে। ভারতও ২০১৮ সালে আশগাবাত চুক্তির সদস্য হয়েছে। নয়াদিল্লিকে ইউরেশিয়ার উপর তার ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার করতে এবং অঞ্চলটিতে ‘নির্ভরযোগ্য, স্থিতিস্থাপক এবং বৈচিত্রপূর্ণ সরবরাহ শৃঙ্খল বিকাশের প্রচেষ্টা করতে’ আইএনএসটিসি-তে চাবাহার বন্দর-সহ এসসিও ফোরাম ব্যবহার করতে হবে।
একটি অস্থির আফগানিস্তান এবং আফ-পাক অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী আঁতুড়ঘর এসসিও সদস্য রাষ্ট্র এবং ইউরেশিয়ার অন্য আঞ্চলিক দেশগুলি দ্বারা শুরু করা সংযোগ প্রকল্পগুলিতে নানাবিধ বাধার জন্ম দিয়েছে৷
সর্বোপরি, পশ্চিমে একটি ধারণা এখন অব্যাহত রয়েছে যে এসসিও একটি পশ্চিম-বিরোধী মঞ্চ। যাই হোক, মাল্টি-ভেক্টর বৈদেশিক নীতির যুগে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা নয়াদিল্লিকে একটি পশ্চিম-বিরোধী জোটের পরিবর্তে ইউরেশিয়ায় একটি উন্নয়নভিত্তিক সংস্থায় পরিণত করার জন্য একটি সম্ভাব্য শক্তি করে তুলেছে। এই কারণে নয়াদিল্লি এই অঞ্চলের সম্মিলিত সমৃদ্ধিকে সুনিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদের বিধানের ভিত্তিতে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার উপর জোর দিয়ে এসেছে।
ভারত আঞ্চলিক বা ট্রান্স-আঞ্চলিক সংযোগ, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ব্লক ছাড়াই অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার ও শান্তিপূর্ণ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা-সহ একটি স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ আফগানিস্তানের জন্য এসসিও-র মধ্যে সকলের জন্য লাভজনক আন্তঃসহযোগিতার পক্ষে সওয়াল করেছে। আগামিদিনে্র চ্যালেঞ্জ হবে, নয়াদিল্লি ইউরেশীয় অঞ্চলকে এসসিও-র পরিধির মধ্যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির চালিকা শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কীভাবে তার উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক পুঁজি ব্যবহার করে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.