মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের মাত্র কয়েক দিন আগে এবং বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি মার্কিন জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর চূড়ান্ত ভাষণ দেওয়ার ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে ইজরায়েল ও হামাস দীর্ঘ প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করার কথা ঘোষণা করেছিল। মধ্যস্থতাকারী হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে টানাপড়েনে থাকা কাতারের কথা অনুযায়ী, ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার ঠিক এক দিন আগে ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি থেকে চুক্তিটি কার্যকর হয়। এই চুক্তির দরুন ইজরায়েলি আটক ও ফিলিস্তিনি বন্দিদের প্রত্যর্পণ করার ব্যবস্থাও করা হয়।
তাস ও তুরুপ
চুক্তির খবর প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে গাজার সেই ফিলিস্তিনিরা উদ্যাপনে পথে নেমে আসেন, যাঁরা ইজরায়েলি সামরিক বাহিনীর হাতে মৃত্যু ও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সন্ত্রাসবাদী হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইজরায়েলি সেনা প্রায় ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রতিক্রিয়াশীল থেকেছে এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা অব্যাহত থেকেছে। একটি বিবৃতিতে হামাস উল্লেখ করেছে যে, ‘তাদের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদী আগ্রাসন বন্ধ করে এবং তাদের উপর চলা গণহত্যা, যুদ্ধ ও ধ্বংসের অবসান ঘটিয়ে পবিত্র গাজা উপত্যকায় ধৈর্যশীল ও অবিচলিত জনগণের প্রতি নিজেদের দায়িত্বশীলতার ভিত্তিতে কর্তব্যপরায়ণ ও ইতিবাচকতা বজায় রেখে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।’
ওয়াশিংটন ডিসিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন চুক্তিটি সফল করার জন্য একজোট হয়ে কাজ করেছিলেন বলে জানা গিয়েছে এবং উভয়েই পৃথক পৃথক ভাবে এর কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ট্রাম্পের জন্য - যিনি ক্ষমতায় আসার আগেই এ হেন চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার বিষয়ে দাবি জানিয়েছিলেন - এটি ছিল তাঁর নির্বাচনী প্রচারের প্রতিশ্রুতি অনুসারে মার্কিন শক্তির পুনর্নবীকরণের একটি বাজারযোগ্য বিজ্ঞাপন। অন্য দিকে বাইডেনের জন্য এটি ছিল উত্তরাধিকার রক্ষা করার একটি প্রচেষ্টা।
ট্রাম্প নীতির চেয়ে ব্যক্তিত্বকে অগ্রাধিকার দেন। হামাসের সঙ্গে এই চুক্তিতে সম্মত হওয়া ট্রাম্পকে নেতানিয়াহুর জন্য সম্ভাব্য বৃহৎ অভ্যন্তরীণ মূল্য চুকিয়ে এক বিজয় প্রদান করবে।
এই ভূ-রাজনৈতিক তুরুপের জোকার হলেন ইজরায়েলের প্রাইম মিনিস্টার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে অবিচলিত ভাবে গাজায় তাঁর সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়ার জন্য আরও দীর্ঘমেয়াদ বরাদ্দ করবেন… এ হেন ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে এই মতামতও উঠে এসেছিল যে, একমাত্র বাইডেনই বিদ্যমান সংঘাতের প্রতিরোধ এবং ইজরায়েলের সামরিক অবস্থানের পুনর্বিন্যাস করার কাজ দু’টি করতে পারবেন। এটি মোটেই কাকতালীয় নয় যে, হামাসের পাশাপাশি ইজরায়েলি নেতৃত্ব এই চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল, যে চুক্তিটি বহু বার নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে। এই চুক্তির আর একটি লক্ষ্য ছিল ট্রাম্পের কাছে অংশীদারিত্ব ও সংকল্পের বার্তা প্রেরণ করা।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ইজরায়েলি নেতাকে রিপাবলিকানদের তরফে আমন্ত্রণ জানানোর পরেও কেন নেতানিয়াহু ট্রাম্পের পক্ষাবলম্বন করেছেন, সেই প্রশ্নের একটি সহজ উত্তর রয়েছে। ট্রাম্প নীতির চেয়ে ব্যক্তিত্বকে অগ্রাধিকার দেন। হামাসের সঙ্গে এই চুক্তিতে সম্মত হওয়া ট্রাম্পকে নেতানিয়াহুর জন্য সম্ভাব্য বৃহৎ অভ্যন্তরীণ মূল্য চুকিয়ে এক বিজয় প্রদান করবে। দীর্ঘদিন ধরে নেতানিয়াহু এ কথা বলে এসেছেন যে, শুধুমাত্র হামাসের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ বিজয়ই গ্রহণযোগ্য। এই চুক্তির মাধ্যমে তিনি এমন একজন ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠেছেন, যিনি হামাসকে সম্পূর্ণ নির্মূল না করেও চিরশত্রুর সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসা করেছেন।
হামাস ও ইজরায়েল প্রসঙ্গ
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, গত এক বছরে ইজরায়েল কর্তৃক পরিচালিত দুই দলের নেতাদের শিরশ্ছেদ অভিযানের পর লেবাননে হামাস এবং হিজবুল্লাহ-র ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
একই সঙ্গে বিদায়ী মার্কিন বিদেশমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনও বলেছেন, বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে যে, হামাস যত সংখ্যক জঙ্গি হারিয়েছে, তত সংখ্যক নতুন জঙ্গি নিয়োগও করেছে। যুদ্ধবিরতির জন্য সুনিশ্চিত রাজনৈতিক পদক্ষেপের অভাব উদ্বেগের বিষয়। আগামিদিনেও হামাসই গাজার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ ফিলিস্তিনি রাজনীতিকে এমন ভাবে পুনর্গঠিত করার জন্য খুব কমই আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, যেখানে দলটিকে একটি বৃহত্তর ও আরও মূলধারার ফিলিস্তিনি-নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক বাস্তুতন্ত্রের অধীনে আনা যেতে পারে।
হামাস নিজে থেকেই ইজরায়েলি নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে তার আদর্শে অটল থাকবে, অন্য দিকে স্থায়ী শান্তির জন্য একমাত্র কার্যকর বিকল্প হিসেবে বিশ্বব্যাপী চাপ সৃষ্টি করা সত্ত্বেও হামাস এবং ইজরায়েল দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের ক্ষেত্রে বিরুদ্ধ মত পোষণ করছে।
আগামিদিনেও হামাসই গাজার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ ফিলিস্তিনি রাজনীতিকে এমন ভাবে পুনর্গঠিত করার জন্য খুব কমই আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, যেখানে দলটিকে একটি বৃহত্তর ও আরও মূলধারার ফিলিস্তিনি-নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক বাস্তুতন্ত্রের অধীনে আনা যেতে পারে।
যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও এই স্থিতাবস্থার বিদ্যমান অবস্থায় যদি হামাস ইজরায়েলি অঞ্চল ও জনসংখ্যার বিরুদ্ধে পুনরায় আক্রমণ শুরু করে, তা হলে নেতানিয়াহু এই স্থিতাবস্থাকে কাজে লাগাতে পারবেন। এ হেন পরিস্থিতিতে হামাস চুক্তিতে সম্মত হওয়ার দরুন নেতানিয়াহু এক সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সমর্থ হবেন। এই সন্ধিক্ষণে প্রতিশোধমূলক কৌশলে প্রত্যাবর্তন সব ক্ষেত্রেই ট্রাম্পের তরফে পূর্ণ সমর্থন পাবে, যেমনটা ইজরায়েল বাইডেনের সময়েও পেয়েছিল এবং এটি ইজরায়েলের অবস্থানকে পুনরায় শক্তিশালী করবে। এর আগে ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছেন যে, যদি মার্কিন নাগরিক-সহ ইজরায়েলি বন্দিদের মুক্তি না দেওয়া হয়, তা হলে হামাসকে ‘ব্যাপক মূল্য’ চোকাতে হবে।
গাজা এবং তার পুনর্নির্মাণ
এই যুদ্ধবিরতি ব্যবস্থার রাজনৈতিক জটিলতার ঊর্ধ্বে উঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে গাজার জনগণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান। কারণ খাদ্য ও চিকিৎসার ঘাটতি বহু দিন আগেই বিপদসীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। ত্রাণ প্রসঙ্গের ঊর্ধ্বে উঠে গাজার পুনর্নির্মাণ এখনও একটি অপরিণত আলোচনা বলেই মনে হচ্ছে, যেহেতু বিকল্প রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলি ফিলিস্তিনি নির্ভর। এখানেই আরব শক্তিগুলির প্রভাব বিস্তারের সুযোগ রয়েছে এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পুনর্গঠন, পুনর্নির্মাণ ও পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ রয়েছে, যাতে ফিলিস্তিনি রাজনীতিকে একটি চ্যালেঞ্জিং ভবিষ্যতের মূল অংশীদার হিসেবে আরও ভাল ভাবে প্রস্তুত করা যায়, যেখানে বহু আলোচিত দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান এক সুদূর বাস্তব হয়েই থেকেছে।
পরিশেষে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও এই চুক্তির স্থিতিশীলতার জন্য নিজেদের ভূমিকা পালন করতে হবে। পশ্চিম এশিয়ার সমৃদ্ধির ভবিষ্যৎ, ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোরের মতো নতুন ভূ-অর্থনৈতিক কাঠামো, আব্রাহাম চুক্তির সম্ভাব্য সম্প্রসারণ এবং এমনকি সৌদি আরব-ইজরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মতো অভাবনীয় ঘটনাও শেষ পর্যন্ত এই গতির উপরই নির্ভর করবে। সবশেষে বলা যায়, আঞ্চলিক শক্তিগুলি দ্বারা আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক ফাটলগুলির পুনর্ব্যবস্থাপনাই সকল ফলাফল নির্ধারণ করবে।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য হিন্দু-তে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.