২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ রুশ শহর কাজান আফগানিস্তানের বিষয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য ‘মস্কো ফরম্যাট’-এর আয়োজন করে, যাতে ১৪টি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। এই আলোচনাসভার স্থায়ী সদস্য অর্থাৎ চিন, ভারত, ইরান, কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, পাকিস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান,
তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তান ছাড়াও সম্মানিত অতিথি দেশ হিসেবে সৌদি আরব, তুর্কিয়ে, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির (ইউএই) প্রতিনিধিরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির নেতৃত্বে তালিবান প্রতিনিধিদলও আলোচনায় অংশগ্রহণ করে। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া আফগানিস্তান বিষয়ক ‘মস্কো ফরম্যাট’ আলোচনায় আফগান বিষয়ক মীমাংসা একটি ধারাবাহিক জায়গা করে নিয়েছে। রাশিয়া এই আলোচনার মঞ্চটিকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং এ কথা সুনিশ্চিত করেছে যে, ইউরেশিয়া ব্যাপী তার সব অংশীদার তালিবান গোষ্ঠীর প্রতি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা সত্ত্বেও আফগানিস্তান সংক্রান্ত পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মতামত ও উদ্বেগ বিনিময় করতে এই মঞ্চে একত্রিত হয়। রাশিয়ায় একটি নিষিদ্ধ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও তালিবান মস্কোর নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকে না। কয়েক মাস আগে ২০২৩ সালের মে মাসে ইসলামিক এমিরেত অফ আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত বাণিজ্যমন্ত্রী নুরউদ্দিন আজিজি এবং ভারপ্রাপ্ত সংস্কৃতিমন্ত্রী খায়রুল্লাহ খাইরখোয়া কাজানে অনুষ্ঠিত ‘রাশিয়া এবং ইসলামিক বিশ্ব’ শীর্ষক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই সম্পৃক্ততা কাবুলে রাশিয়ার ব্যবসায়িক কেন্দ্র খোলার মতো কিছু চুক্তির পথ প্রশস্ত করলেও তালিবান শাসিত আফগানিস্তানের সাথে পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক সহযোগিতা একটি সদ্যোজাত পর্যায়েই রয়েছে এবং দীর্ঘমেয়াদি উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলি - যেমন তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ভারত গ্যাস পাইপলাইন বা ট্রান্স-আফগান রেলওয়ে রোড - যা রুশ সরকারি সংস্থাগুলির স্বার্থের অনুকূল, তা বাস্তবায়িত হওয়া এখনও অনেক দূরের কথা। অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন এবং মানবিক ত্রাণ পাঠানোর জন্য সূচনাপর্বে রাশিয়া তালিবানের সঙ্গে তার সম্পর্ক অস্পষ্টই রেখেছে। আফগানিস্তানের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত, জামির কাবুলভ তাঁর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে জোর দিয়ে বলেন যে, রাশিয়া তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। একই সময়ে তিনি দাবি করেন যে, ‘আমরা [তালিবানদের] বস্তুগত ভাবে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে মনে করি না, যেহেতু তারা আফগানিস্তানের ‘জাতীয় আন্দোলন থেকে বিকশিত হয়েছে।’ রুশ রাজনৈতিক অভিজাতরাও এই একই মতামত বিশ্বাস করেন কি না, তা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। এর আগে রুশ নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি নিকোলাই পাত্রুশেভ আফগানিস্তানের অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছিলেন, যখন তাজিকিস্তানে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত সেমিয়োন গ্রিগোরিয়েভ স্পষ্টতই তালিবানদের দুর্বল শাসনব্যবস্থা এবং সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলিকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়ার বিষয়টির সমালোচনা করেন। কিন্তু রুশ কর্মকর্তাদের মতে, আফগানিস্তানের মাটি থেকে উদ্ভূত বড় সন্ত্রাসবাদী হুমকি হল ইসলামিক স্টেট (ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশ, আইএস-কে), যা কথিত ভাবে ‘বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা লাভ করে’ এবং যাদের বিরুদ্ধে ‘তালিবান’ লড়াই চালাচ্ছে।’
মস্কো তালিবানদের প্রতি ক্যারট অ্যান্ড স্টিক পদ্ধতি (হয় প্রণোদনা, নয়তো শাস্তি) ব্যবহার করার চেষ্টা করছে, যেখানে তাদের প্রশাসনিক স্বীকৃতি এক ‘সত্যিকারের অন্তর্ভুক্ত সরকার’-এর বিনিময়ে চূড়ান্ত ‘লাভজনক’ হয়ে উঠতে পারে।
মস্কো তালিবানদের প্রতি ক্যারট অ্যান্ড স্টিক পদ্ধতি (হয় প্রণোদনা, নয়তো শাস্তি) ব্যবহার করার চেষ্টা করছে, যেখানে তাদের প্রশাসনিক স্বীকৃতি এক ‘সত্যিকারের অন্তর্ভুক্ত সরকার’-এর বিনিময়ে চূড়ান্ত ‘লাভজনক’ হয়ে উঠতে পারে। কাবুলভের মতে, রাশিয়া নির্দিষ্ট জাতি-রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলিকে শাসন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করবে না। কারণ আন্তঃ-আফগান আলোচনার প্রচার তালিবানদের নিজেদেরকেই চালাতে হবে। তবুও, রাশিয়াও তালিবান-বিরোধী শক্তির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক জোরদার করার পাশাপাশি আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের অসন্তুষ্টিরও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে। ২০২৩ সালের অগস্ট মাসের
শেষের দিকে আফগানিস্তানের ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট-এর (এনআরএফ) নেতা আখমাদ মাসুদ মস্কোয় একটি আকস্মিক সফর করেছিলেন এবং তাঁকে রুশ পার্লামেন্টে আমন্ত্রণও জানানো হয়। আফগানিস্তানের প্রধান বিরোধী নেতার রাশিয়ায় এই ধরনের প্রথম সফর - যা এনআরএফ প্রতিনিধিদের সঙ্গে পূর্ববর্তী কিছু অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার এক প্রয়াস – এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই উস্কে দেয় যে, মস্কো তালিবানের সঙ্গে আপস করার বিষয়ে আস্থা হারিয়েছে এবং রাশিয়া নিজের আফগান নীতির ধারার পরিবর্তন করেছে। যদিও রাশিয়ান স্টেট ডুমার তৃতীয় বৃহত্তম ‘স্প্রভেদলিভায়া রশিয়া’ পার্টি মাসুদকে মস্কোতে আমন্ত্রণ জানায় এবং বৈঠকটি পার্টির চেয়ারম্যান সের্গেই মিরোনভ ও মুষ্টিমেয় সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন যে, ক্রেমলিনের সম্মতি ছাড়া এ হেন বৈঠক ঘটেছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে পার্টির প্রেস সার্ভিস আলোচনার কিছু অংশও প্রকাশ করে, যেখানে মাসুদ তালিবানের অধীনে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির কথা বলেছেন: ‘সন্ত্রাসবাসী সংগঠন এবং মাদক পাচার দেশে জাঁকিয়ে বসেছে এবং অন্য দিকে জনগণের অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে।’ ২০২৩ সালের মস্কো ফরম্যাট সমাবেশের একটি ফলাফলমূলক নথি কাজান ডিক্লেয়ারেশন শব্দচয়নের ক্ষেত্রে খুবই কৌশলী, যা তাকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতি (তালিবানকে তখনও আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়নি) থেকে যথেষ্ট আলাদা করে তোলে। স্পষ্টতই তালিবানদের সঙ্গে আলোচনা করার ক্ষেত্রে একটি ‘লাইট-টাচ অ্যাপ্রোচ’ বা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ পদ্ধতিকে সব অংশগ্রহণকারী ভাল চোখে দেখেনি। তাজিকিস্তান ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে এবং এমনকি বৈঠকের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রাশিয়ান এমএফএর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও সে কথা উল্লেখ করা হয়নি। কাবুলভ অবশ্য পরে প্রকাশ করেন যে, তাজিকিস্তানের প্রতিনিধি দল দুটি বিষয় অর্থাৎ আইএস-কে-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তালিবানের সাফল্যের স্বীকৃতি এবং তাদের ‘কার্যকর’ মাদকবিরোধী নীতির বিষয়টি অনুমোদন করেনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর রাশিয়া আফগানিস্তান নিয়ে আলোচনার একটি আঞ্চলিক পরিসর হিসাবে মস্কো ফরম্যাটের প্রচার চালিয়েছে এবং তার অংশগ্রহণকারীদের ও পশ্চিমের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছে।
তালিবানদের প্রতি এই দ্বৈত মনোভাব ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অশেষ দ্বন্দ্ব রুশ আফগান নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নিয়েছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই মস্কো সেই শূন্যতা পূরণ করতে এবং তালিবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরিতে নেতৃত্ব প্রদানে আগ্রহী ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর রাশিয়া আফগানিস্তান নিয়ে আলোচনার একটি আঞ্চলিক পরিসর হিসাবে মস্কো ফরম্যাটের প্রচার চালিয়েছে এবং তার অংশগ্রহণকারীদের ও পশ্চিমের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছে। উদাহরণস্বরূপ, অংশীদারদের তরফে কথা বলতে গিয়ে মস্কো বলেছে যে, ‘[ক] এই অঞ্চলের দেশগুলি এবং ন্যাটো দেশগুলির মধ্যে প্রচেষ্টার সম্পূর্ণ মাত্রা শুধুমাত্র এই শর্তেই অর্জন করা সম্ভব, যদি আফগানিস্তানে তাদের ২০ বছরের সামরিক উপস্থিতির দুঃখজনক ফলাফলের - যা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পরিণত হয়েছে – দায়ভারকে ন্যাটো দেশগুলি সম্পূর্ণ রূপে স্বীকৃতি দেয়।’ মস্কোর জন্য আর একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হল, আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটোর সামরিক অবকাঠামোগত সুবিধার প্রত্যাবর্তন ‘যে কোনও পরিস্থিতিতেই অগ্রহণযোগ্য’। একই ভাবে প্রণয়নকৃত বিষয়গুলি কাজান ডিক্লেয়ারেশন অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এর অর্থ এই নয় যে রাশিয়া এবং তার আঞ্চলিক অংশীদাররা বিষয়টি সম্পর্কে সহমত। চিন এবং ইরান ব্যতীত - যাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজস্ব চাপানউতোর রয়েছে - অন্যান্য অংশগ্রহণকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ভূমিকা সংক্রান্ত তীব্র বাদানুবাদকে সমর্থন করে না। আসলে অনেক আঞ্চলিক অংশীদারই আফগান বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা বজায় রেখে চলেছে। সম্প্রতি নিউইয়র্কে সি৫+১ ফরম্যাটের বৈঠকে এবং উজবেকিস্তানের তাসখন্দে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ক সম্মেলনে - যেখানে উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, পাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান,
কিরঘিজস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফ চিফ ও মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের কমান্ডার অংশ নেন - উভয় ক্ষেত্রেই এই সমস্যাটি স্পষ্টতই আলোচনায় উঠে এসেছে। এবং তালিবানরা নিজেরাই সম্প্রতি মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, ব্যাঙ্কের অর্থভাণ্ডার মুক্ত করা, আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং মাদক ও মানবাধিকার বিষয়ক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছে।
তালিবান শাসনের অধীনে আফগানিস্তানের মানবিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ভাগ করে নেওয়ার সময়, ভারত কোনও রকম মার্কিন বিরোধী মনোভাব পোষণ করেনি এবং এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতার জন্য তালিবানের অবদানের দাবিকে সমর্থন করেনি।
তা হলে ভারতের অবস্থান কী? নয়াদিল্লি আফগানিস্তানে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পৃক্ত, বিশেষ করে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের মধ্যে। তালিবান শাসনের অধীনে আফগানিস্তানের মানবিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ভাগ করে নেওয়ার সময়, ভারত কোনও রকম মার্কিন বিরোধী মনোভাব পোষণ করেনি এবং এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতার জন্য তালিবানের অবদানের দাবিকে সমর্থন করেনি। এ কথা মাথায় রেখে মস্কো এখনও তার আঞ্চলিক উদ্যোগগুলির প্রতি ভারতের সমর্থনের উপর নির্ভর করতে পারে, যদি এগুলি সত্যিকার অর্থে আফগান জনগণের দুর্ভোগ লাঘব করতে সক্ষম হয় এবং তাতে কোনও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ লুকিয়ে না থাকে।
ডক্টর আলেক্সেই জাখারভ নিউ দিল্লির অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ভিজিটিং ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.