বিভিন্ন রাজ্যে আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে মোরবি দুর্ঘটনা আরও বেশি করে নজর কাড়ছে। বিশাল সংখ্যক শিশু-সহ ১০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হওয়ার ফলে এ দুর্ঘটনা আরও বেশি করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। জনসাধারণের আলোচনা এবং বিশ্লেষণ মূলত কাজের দায়িত্ব বণ্টনে সম্ভাব্য অনিয়ম, ত্রুটিপূর্ণ চুক্তি প্রক্রিয়া এবং ‘প্রকৃত’ অপরাধীদের বাঁচাতে তাদের সাহায্যকারী বন্ধুদের গ্রেফতারির বিষয়গুলির উপরেই কেন্দ্রীভূত হয়েছে। তবে যা দৃষ্টিগোচর হয়নি, তা হল এই দুর্ঘটনা কোনও পৌরসভার প্রথম পরিকাঠামোগত ব্যর্থতা ছিল না। সারা দেশ জুড়ে সমস্ত ধরনের শহরেই এমন দুর্ঘটনা আকছার ঘটছে।
প্রায় দুই লক্ষ জনসংখ্যা বিশিষ্ট গুজরাতের মোরবি শহরটি রাজকোট থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে মাছু নদীর তীরে অবস্থিত। সেই নদীর উপরে স্থানীয় ভাষায় পরিচিত ‘ঝুলতো পুল’ নামের ঝুলন্ত সেতুটি মেরামতের পর পুনরায় খুলে দেওয়ার ঠিক চার দিন পরেই ভেঙে পড়ে এবং এর ফলে পুরুষ, মহিলা ও শিশু-সহ ১৩৫ জনের মৃত্যু হয়। ২৩০ মিটার দীর্ঘ ও ১.২৫ মিটার প্রস্থের এই সেতু মাছু নদীর ১৫ মিটার উপরে অবস্থিত। ১৮৮০-র দশকে দুই প্রাসাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য নির্মিত হয়েছিল সেতুটি। এটি বর্তমানে স্থানীয় পৌর প্রশাসনিক পরিকাঠামোর আওতায় পড়ে এবং টোল ব্রিজের ভূমিকা পালন করে। ২০০৮ সাল থেকে ওরেভা কোম্পানি এই সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। সেতু ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটার পরে ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর গুজরাত হাইকোর্ট একটি স্বতঃপ্রণোদিত জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে এবং সরকার, পৌর কর্তৃপক্ষ ও রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের কাছে নোটিশ জারি করে জবাব চায়। হাইকোর্ট বিষয়টি হাতে তুলে নেওয়ার পরে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণগুলি এ বার প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে কলকাতায় একটি উড়ালপুলের নির্মীয়মাণ অংশ ভেঙে পড়ে ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ৮০ জন আহত হন।
এই প্রতিবেদনটির উদ্দেশ্য এ দিকেই আলোকপাত করা যে, পৌরসভার আওতায় মোরবিই প্রথম সেতু নয় যেটি ভেঙে পড়েছে। এই ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে এবং যদি শহরগুলির মঙ্গলের কথা না ভাবা হয় এবং সেগুলির মৌলিক দুর্বলতার প্রতি মনোযোগ না দেওয়া হয়, তা হলে ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। পরিকল্পনা, প্রশাসন এবং বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ।
প্রথমত, গত এক দশকে ঘটা সেতু দুর্ঘটনা এবং সেতু ভেঙে পড়ার একটি আংশিক তালিকা করা যেতে পারে। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে কলকাতায় একটি উড়ালপুলের নির্মীয়মাণ অংশ ভেঙে পড়ে ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ৮০ জন আহত হন। ২০১৬ সালের জুন মাসে চেন্নাইয়ের আইল্যান্ড গ্রাউন্ডের কাছে একটি কাঠের সেতু ভেঙে পড়ে প্রায় ৩০ জন মহিলা কুউম নদীতে পড়ে গিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে, তাঁদের উদ্ধার করা হয় এবং তাঁরা তেমন আহত হননি। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে মুম্বইয়ের আন্ধেরিতে একটি ওভারব্রিজ ভেঙে পড়ে দু’জন মানুষের মৃত্যু হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় আর একটি উড়ালপুলও ভেঙে পড়ে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে দক্ষিণ মুম্বইতে একটি ফুট ওভারব্রিজ ভেঙে পড়ে ছ’জন নিহত হন এবং ৩০ জন আহত হন। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে বিহারের সুলতানগঞ্জে গঙ্গার উপর নির্মীয়মাণ সেতুর একটি অংশ ধ্বসে পড়ে। ওই একই মাসে মধ্যপ্রদেশের নর্মদাপুরমে ব্রিটিশ আমলের একটি সেতু ভেঙে পড়ে যখন সেটির উপর দিয়ে একটি ট্রেলার ট্রাক অতিক্রম করছিল। এ প্রসঙ্গে আরও অনেক উদাহরণ দর্শানো যেতে পারে; তবে উপরোল্লিখিত উদাহরণগুলিই এ কথা প্রমাণ করতে যথেষ্ট যে, ভারতে নির্মিত অনেক সেতুই নিরাপদ নয় এবং নির্মীয়মাণ একাধিক সেতুর ক্ষেত্রে যথাযথ সতর্কতা ও যত্নের অভাব দেখা গিয়েছে।
সেতুগুলি শহরের পরিকাঠামোর খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল, জনসাধারণকে এমন এক ভূখণ্ডের বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করা, যা অন্যথায় অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হল নদী, সমুদ্র অথবা বর্জ্য নালার মতো জলাশয়। ব্যাপক যানজটসম্পন্ন অঞ্চলে এবং দ্রুতগামী যানবাহন চলাচলের মাঝে যে সকল জায়গা বিপজ্জনক, সেখানে সেতুগুলি পথচারীদের দ্রুত চলাচলের জন্য এক নিরাপদ সংযোগপথ প্রদান করে। এ কথা স্পষ্ট যে, এই ধরনের সেতুগুলি শহরের পরিবহণ এবং অর্থনীতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যাপক যানজটসম্পন্ন অঞ্চলে এবং দ্রুতগামী যানবাহন চলাচলের মাঝে যে সকল জায়গা বিপজ্জনক, সেখানে সেতুগুলি পথচারীদের দ্রুত চলাচলের জন্য এক নিরাপদ সংযোগপথ প্রদান করে।
ভারতে এই ধরনের দুর্ঘটনার নেপথ্যে অন্যতম কারণ হল, খুব বড় কোনও শহরের এই ধরনের পরিকাঠামোয় বিশাল সংখ্যক যানবাহন এবং মানুষ চলাচল করে। অনেক সময় সেতুতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট দেখা যায়। এর পাশাপাশি এই সেতুর উপর দিয়ে চলাচলকারী অধিকাংশ পণ্যবাহী যানই (ট্রাক এবং মাল্টি-এক্সেল যান) নির্ধারিত সীমার তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত ভার বহন করে। ওভারলোডিং সংক্রান্ত আদালতের রায় এবং ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের নিরিখে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, সে বিষয়ে স্পষ্ট প্রবিধান দেওয়া রয়েছে। যদিও এই সকল নিয়মের বাস্তবায়ন হয়নি এবং একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ওভারলোডিং-এর ঘটনা ব্যাপক হারে ঘটছে। ভার নেওয়ার ক্ষমতার ক্ষেত্রে সেতুগুলির উপর এর প্রভাব পড়েছে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, নির্মাণের সময় সেতুর ক্ষমতা নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে এই কারণগুলিও সর্বদা বিবেচনা করা প্রয়োজন।
সেতু পরিকাঠামো নির্মাণ এ ক্ষেত্রে মূল প্রক্রিয়ার একটি অংশ মাত্র। অন্যান্য পরিকাঠামোর মতো সেতুগুলিরও রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন। ভারতের বেশির ভাগ পৌরসভার একটি করে সড়ক বিভাগ রয়েছে এবং সেতুগুলি সাধারণত সেই বিভাগের সঙ্গেই সংযুক্ত। রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ হলে, সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ দ্বিগুণ গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। কোনও বেহাল রাস্তা শহরের পরিবহণ এবং অর্থনীতির পথে অন্তরায় হলেও সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনা দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিবহণ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দেয় এবং প্রাণহানিও ঘটে। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ সেতুগুলির আয়ু দীর্ঘায়িত করতে পারে এবং সেতুর স্বাস্থ্যের অবনতি রোধ করে, যা সময় ও খরচসাপেক্ষ মেরামতের হাত থেকে বাঁচায়।
বিভিন্ন শহরে একের পর এক সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনা সেতুর পরিকাঠামোগত ব্যর্থতাকেই তুলে ধরে। বিষয়টি নিয়ে তলিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে, এই ধরনের ঘটনার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। দ্রুত হারে বেড়ে চলা শহরগুলিতে পরিকাঠামোগত চাহিদাও বিপুল। যানবাহনের সংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির ফলে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়, যা আরও বেশি সংখ্যক সেতুর নির্মাণকে বাধ্যতামূলক করে তোলে। এর পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রেও ব্যাপক ঢিলেমি রয়েছে। কারণ রক্ষণাবেক্ষণের নিরিখে প্রতিটি নতুন পরিকাঠামোই অতিরিক্ত সংযোজন। নাগরিক পৌর প্রশাসনগুলি এই উভয় সমস্যা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ এবং সাধারণত রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টিতে নজর না দিয়ে নতুন পরিকাঠামো নির্মাণকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা, সম্পদ, জনবল এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার অভাবের মতো একাধিক কারণ ইউএলবি পরিকল্পনা, প্রশাসন ও অর্থের সঙ্গে যুক্ত।
নাগরিক পৌর প্রশাসনগুলি এই উভয় সমস্যা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ এবং সাধারণত রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টিতে নজর না দিয়ে নতুন পরিকাঠামো নির্মাণকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
বৃহন্মুম্বই মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন (বিএমসি) সেই গুটিকয়েক ইউএলবি-র মধ্যে পড়ে, যার একটি ব্রিজ ম্যানুয়াল বা সেতু সংক্রান্ত নির্দেশিকা রয়েছে। সেখানে এ কথাই বলা হয়েছে যে, বছরে দু’বার (এপ্রিল এবং অক্টোবর) প্রত্যেকটি সেতু পরিদর্শন করা উচিত। সেতু ভেঙে না পড়া পর্যন্ত এই নির্দেশিকা পালন করা হয়নি। মুম্বইয়ে সেতু ভেঙে পড়ার পর বিএমসি পর্যায়ক্রমে শহরের সেতুগুলির একটি সেতু অডিট করেছে। এই অডিটে মোট ২৯টি সেতুকে বিপজ্জনক ঘোষণা করা হয় এবং সেগুলি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। বিএমসি সেই অনুযায়ী আটটি সেতু ভেঙে ফেলে এবং বাকিগুলির ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। এর ফলে নির্দিষ্ট কিছু সড়কে অতিরিক্ত যানজট বাড়লেও প্রশাসনের তরফে হঠাৎ বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে এই সেতুগুলিকে চালু রাখার ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়। বেশিরভাগ শহরেই একটি নির্দেশিকা এবং সেতুর জন্য একটি সুপরিকল্পিত বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির অভাব রয়েছে।
সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার অভাবের পাশাপাশি কর্মী ঘাটতি এবং পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজের জন্য তাঁদের দক্ষতার অভাব সমস্যাকে জটিলতর করে তুলেছে। অভ্যন্তরীণ প্রকৌশলীরা কাজটিতে ব্যর্থ হলে বাইরের পরামর্শদাতাদের নিয়োগ করা যেতে পারে। বেশিরভাগ শহরে গুণমানসম্পন্ন পরামর্শদাতা নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। অপ্রতুল অর্থভাণ্ডার, গুণমানসম্পন্ন কর্মীর অভাব এবং একটি ধীর লয়ে চলা জটিল, পুরনো পৌর প্রশাসনিক ব্যবস্থার ফলে ইউএলবিগুলি শহরগুলিতে ক্রমবর্ধমান পরিকাঠামো চাহিদা এবং রক্ষণাবেক্ষণের চাপ সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ত্রুটি এবং অনিয়ম থাকলেও সমস্যার ব্যাপকতাকে অপূর্ণ মৌলিক ঘাটতির আলোকে দেখা দরকার। দুঃখজনক ভাবে সমস্যাটির প্রতিকার শুধু মাত্র শহরগুলির হাতে নেই। কারণ মূল চালিকাশক্তি রয়েছে রাজ্যগুলির হাতেই।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.