২০২২ সালে ইতালির প্রাইম মিনিস্টার হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকে জর্জিও মেলোনির বিদেশনীতিকে ইউক্রেনের প্রতি অটল সমর্থন, ইতালির আটলান্টিক ও ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে নিজেকে সাযুজ্যপূর্ণ করে তোলা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নীতিনির্ধারণে ব্রাসেলসের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতার মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। প্রাইম মিনিস্টার মেলোনির বিদেশনীতির আর একটি কেন্দ্রীয় নীতি হল আফ্রিকা, বিশেষ করে ইইউ-এর দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিবেশী মাগরেবে পৌঁছনো। প্রাইম মিনিস্টার হওয়ার পর থেকে দু’বছরে মেলোনি আলজেরিয়া, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, মিশর, মরক্কো ও মরিতানিয়ায় সম্মিলিত ভাবে ন’টি সফর করেছেন এবং সাধারণ ভাবে ভূমধ্যসাগরের কেন্দ্রিকতা ও বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকাকে তাঁর বিদেশনীতিতে তুলে ধরেছেন।
উত্তর আফ্রিকার প্রতি রোমের নতুন করে আগ্রহ একটি অবনতিশীল অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কাঠামো থেকে উদ্ভূত, যা সামগ্রিক ভাবে ইইউ-এর অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রতীক। ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান, চিনের সঙ্গে ভূ-অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং গাজার যুদ্ধ জ্বালানি নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির অনুমানকে ক্ষুণ্ণ করেছে, যার ভিত্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিনির্ধারকরা নিজেদের নীতি তৈরি করেছিলেন। আফ্রিকায় প্রাইম মিনিস্টার মেলোনির অর্থনৈতিক প্রসার আফ্রিকায় পুরনো ও নতুন জ্বালানি বিনিয়োগের মাধ্যমে ইতালির শক্তি সরবরাহের শৃঙ্খলকে বৈচিত্র্যময় ও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে তৈরি এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ মূল্যের শৃঙ্খলগুলি সুরক্ষিত করতে আফ্রিকান অংশীদারদের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দক্ষিণে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জোরদার করতে আগ্রহী।
উত্তর আফ্রিকার প্রতি রোমের নতুন করে আগ্রহ একটি অবনতিশীল অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কাঠামো থেকে উদ্ভূত, যা সামগ্রিক ভাবে ইইউ-এর অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রতীক।
এই নিবন্ধটি আফ্রিকায় ইতালির উপস্থিতি এবং সম্প্রতি চালু হওয়া মাত্তেই প্ল্যান ফর আফ্রিকার (এমপিএ) সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণ করে এবং আফ্রিকা জুড়ে ইতালির ফ্ল্যাগশিপ ও পাইলট প্রকল্পগুলির মূল্যায়ন করে। এর পাশাপাশি নিবন্ধটিতে আফ্রিকার বিদ্যমান পরিপূরক এবং প্রতিযোগী সংযোগ বিকল্পগুলি বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে কী ভাবে এমপিএ সেগুলির সঙ্গে পরিপূরক হয়ে উঠেছে।
আফ্রিকায় ইতালির অর্থনৈতিক প্রসার
২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ আফ্রিকা-ইতালি শীর্ষ সম্মেলনের সময় প্রাইম মিনিস্টার মেলোনি ২১টি আফ্রিকান সরকার-প্রধান, আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি, বিশ্বব্যাঙ্কের প্রধান এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি বক্তৃতায় এমপিএ-র উন্মোচন করেছিলেন। এমপিএ-টির নামকরণ করা হয়েছে এনরিকো মাত্তেই-এর নামে, যিনি ইতালীয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রধান তেল সংস্থা ন্যাশনাল হাইড্রোকার্বন এজেন্সির (ইএনআই বা এনি) প্রতিষ্ঠাতা, যেটি এমপিএ-র অধীনে একটি প্রধান অংশীদারও। এই পরিকল্পনার অধীনে ইতালীয় সরকার আলজেরিয়া, মিশর, ইথিওপিয়া, আইভরি কোস্ট, কেনিয়া, মরক্কো, মোজাম্বিক, তিউনিসিয়া, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোয় (ডিআরসি) পাঁচটি নীতি খাত অর্থাৎ শক্তি, শিক্ষা, জল, সক্ষমতা-নির্মাণ এবং কৃষিতে ঋণ, বিনিয়োগ ও ইক্যুইটির মাধ্যমে ৮.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উন্নয়ন অর্থ প্রদান করবে।
জাতীয় জলবায়ু তহবিল এবং ইতালীয় উন্নয়ন সহযোগিতা বাজেট এমপিএ-র অর্থায়ন করে। পরিকল্পনাটি ১৯৬০-এর দশকে মাত্তেই-এর কাজের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে এনরিকো মাত্তেই এনির প্রধান হিসাবে পশ্চিম এশিয়ার তেল সমৃদ্ধ দেশগুলির পক্ষে ব্যাপক ভাবে চুক্তি করেছেন। পরিবর্তে, ইতালি ইউরোপের বাকি অংশে একটি গৌণ সরবরাহকারী হয়ে ওঠে। তার পর থেকে এই নীল নকশা ব্যবহার করে এনি মাগরেবে শক্তি সরবরাহের জন্য কৌশলগত সহযোগিতা বাড়িয়েছেন, রাজনৈতিক ভাবে ভঙ্গুর সেই দেশগুলিতে উদ্যোগী হয়েছেন, যেখানে বেশির ভাগ পশ্চিমী তেল সংস্থাগুলি বিনিয়োগ করতে দ্বিধা করেছে।
এনি-এর অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনাটিতে একটি টপ-ডাউন, দাতা-গ্রহীতা পদ্ধতির পরিবর্তে দ্বিপাক্ষিক উন্নয়নের জন্য একটি সমন্বিত পদ্ধতির কল্পনা করা হয়েছে, যেখানে আফ্রিকার অংশীদারদের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শ করা হবে।
এনি-র অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনাটিতে একটি টপ-ডাউন, দাতা-গ্রহীতা পদ্ধতির পরিবর্তে দ্বিপাক্ষিক উন্নয়নের জন্য একটি সমন্বিত পদ্ধতির কল্পনা করা হয়েছে, যেখানে আফ্রিকার অংশীদারদের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শ করা হবে। পুনরাবৃত্তি এড়াতে আফ্রিকার অবকাঠামো এবং শক্তি খাতে বিদ্যমান কৌশলগত ইতালীয় বিনিয়োগের মানচিত্রও তৈরি করা হবে। ইতিমধ্যে ঘোষিত প্রধান প্রকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে তিউনিসিয়ার একটি সবুজ হাইড্রোজেন পাইপলাইন, যা ইতালির সঙ্গে সংযুক্ত; মরক্কো এবং ইতালির মধ্যে একটি আন্তঃসংযুক্ত বিদ্যুৎ গ্রিড এবং অ্যাঙ্গোলা, ডিআরসি ও আইভরি কোস্টে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি প্রকল্প।
তা সত্ত্বেও পরিকল্পনার নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। আফ্রিকার অবকাঠামো উন্নয়নের শূন্যতা পূরণ করতে বার্ষিক ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি প্রয়োজন এবং ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি প্রভাব ফেলবে না। তদুপরি, এমপিএ এবং এর অধীনে থাকা প্রকল্পগুলির বেশির ভাগই রহস্যে আবৃত। ইতালীয় সরকার ২০২২ সালে প্রথম পরিকল্পনাটি ঘোষণা করেছিল এবং আফ্রিকান অংশীদারদের সঙ্গে সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন ও পরামর্শের পাশাপাশি তখন থেকে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। সফল হওয়ার উদ্দেশ্যে মাত্তেই পরিকল্পনার জন্য আফ্রিকার এবং বেসরকারি অংশীদারদের সঙ্গে বিস্তৃত পরামর্শ প্রয়োজন এবং একটি উন্নয়নমূলক ফলাফলের জন্য এর অর্থায়ন প্রসারিত করা দরকার, যা মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদে আফ্রিকার সঙ্গে ইতালির সম্পর্ককে ইতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করবে।
দক্ষিণের প্রতিবেশে চিন ও রাশিয়ার মোকাবিলা
মাগরেব এবং আফ্রিকায় ইতালির উপস্থিতি একটি মূল ভূ-রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে সাধারণ ভাবে সমগ্র মহাদেশ জুড়ে চিনা এবং রুশ প্রভাবকে খর্ব করতে পারে। আফ্রিকায় উপস্থিতির জন্য চিনের প্রধান হাতিয়ার হল এর বিশেষ সংযোগ উদ্যোগ - বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। এর অধীনে চিন ১৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি ঋণ দিয়েছে এবং গ্যাস, তেল, নবায়নযোগ্য শক্তি, পরিবহণ, বন্দর অবকাঠামো, কয়লা, বিদ্যুৎ, বিদ্যুৎ গ্রিড, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সড়ক, রেলওয়ে এবং সামাজিক অবকাঠামোর মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতে প্রায় ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। চিনের ১২টি আফ্রিকান দেশের সঙ্গে বিস্তৃত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে এবং চিন আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। আফ্রিকা তার শক্তি নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক মূল্য শৃঙ্খলের জন্য বেজিংয়ের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। বেজিং আফ্রিকার মাধ্যমে তার তেল ও গ্যাস সরবরাহের প্রায় এক তৃতীয়াংশ আমদানি করে এবং আফ্রিকার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ খনিতে চিনের অংশীদারিত্ব রয়েছে, যা দূষণহীন রূপান্তর এবং ইভি সরবরাহ শৃঙ্খলের জন্য প্রয়োজনীয়। চিন মহাদেশে তার প্রথম প্রবর্তক সুবিধার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অ-হস্তক্ষেপ, সংস্কারবিহীন সাহায্য এবং দ্রুত অর্থ বিতরণ নীতির কারণে পশ্চিমের চেয়ে খানিক এগিয়েই রয়েছে।
মাগরেব এবং আফ্রিকায় ইতালির উপস্থিতি একটি মূল ভূ-রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে সাধারণ ভাবে সমগ্র মহাদেশ জুড়ে চিনা এবং রুশ প্রভাবকে খর্ব করতে পারে।
একই ভাবে, মস্কো নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক সুসংহত করছে। রাশিয়া প্রাকৃতিক সম্পদের লভ্যতা এবং অবকাঠামো উন্নয়ন চুক্তির বিনিময়ে এই দেশগুলিকে শাসন স্থিতিশীলকরণ প্যাকেজ এবং অস্ত্র বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে। মস্কো সার, গম এবং শস্যদানা সরবরাহের মাধ্যমে কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতে একটি বহির্মুখী ভূমিকা পালন করে। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে আফ্রিকার সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যও ৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে: মিশরের সঙ্গে বাণিজ্য ২০২২ সালে ১৮.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২৩ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ২৮.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে, যা মোট বাণিজ্যের এক চতুর্থাংশেরও বেশি। আফ্রিকায় রাশিয়ার অভিযানের লক্ষ্য হল ইউক্রেনে তার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’-এর জন্য সমর্থন আদায় করা। আফ্রিকা রাষ্ট্রপুঞ্জের বৃহত্তম ভোটিং ব্লক এবং ১৬৯টি আসনের মধ্যে ৫১টি আসনে ভোট দেয় ও বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক মঞ্চেও ভোট প্রদান করে। বেশির ভাগ আফ্রিকান দেশ রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ রেজোলিউশনের সময় ভোটদান থেকে বিরত থাকে। যেমন রাশিয়া থেকে যুদ্ধের ক্ষতির পরিশোধ এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে তাকে বরখাস্ত করার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে হয়েছে।
উপসংহার
চিনা ও রুশ প্রভাব মোকাবিলা করতে, তার শক্তি নিরাপত্তা জোরদার করতে, অবৈধ অভিবাসন রোধ করতে এবং তার আশপাশে উন্নয়ন সহায়তা প্রদানের জন্য রোম ২০২৪ সালে এমপিএ চালু করেছিল। কিছু ফাঁক পূরণ করতে এটি ইইউ-র গ্লোবাল গেটওয়ে ও জি৭ পার্টনারশিপ ফর গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার (পিজিআইআই) এবং ইতালির জি৭ সভাপতিত্বের সময় আপুলিয়ায় সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলনে বিনিয়োগের জন্য অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে। ইতালির উন্নয়ন সহায়তা বেশির ভাগ উত্তর আফ্রিকা, এর নিকটবর্তী প্রতিবেশী এবং এর অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলকে লক্ষ্য করে এগিয়েছে। যতক্ষণ প্রাইম মিনিস্টার মেলোনি ইতালিয়া-আফ্রিকা সামিট ২০২৪-এ দেওয়া প্রতিশ্রুতি মেনে কাজ করবেন এবং পিজিআইআই-এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে উন্নয়নকাজ চালিয়ে যাবেন, ততক্ষণ রোমও মাগরেব এবং আফ্রিকায় তার কৌশলগত ও ভূ-অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যগুলি অর্জন করতে পারবে।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.