Author : Harsh V. Pant

Published on Dec 12, 2023 Updated 0 Hours ago
সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে কিসিঙ্গারের ছায়া

এ সম্ভবত অনিবার্য ছিল যে হেনরি কিসিঙ্গার তাঁর মৃত্যুতেও তাঁর জীবনকালের মতোই বিতর্কিত থেকে যাবেন। তাঁর সম্পর্কে মৃ্ত্যুউত্তর লেখাগুলিতেও সেই চরম আবেগের প্রতিফলন ছিল যেমনটা তিনি তৈরি করেছিলেন, তাঁর কাজ এবং তাঁর লেখাগুলি তৈরি করেছিল বিশ্বজুড়ে এবং বিভিন্ন মতামতের মানুষের মধ্যে। অ্যাকাডেমিয়া থেকে রাষ্ট্রনীতি জগতে, বুদ্ধিজীবী থেকে কূটনীতিক, সাংবাদিক থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বিষয়ে উৎসাহী প্রত্যেকেরই এই ব্যক্তিত্বকে নিয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত ছিল যিনি গত কয়েক দশক ধরে কূটনীতি ও রাষ্ট্রনীতির বিশ্বজুড়ে  এক স্তম্ভ ছিলেন। এই দিন এবং এই যুগে যখন প্রত্যেকেরই প্রতিটি বিষয়ে মতামত রয়েছে, তখন কিসিঙ্গারের বিষয়ে মত দেওয়া সম্ভবত সবচেয়ে সহজ বিষয়গুলির মধ্যে একটি। আর আমরা তা উপভোগ করছি এবং কীভাবেই না করছি।

হেনরি আলফ্রেড কিসিঙ্গারকে নিন্দিত করা হয়েছে এবং সমান পরিমাপে উদযাপন করা হয়েছে। তবে অস্বীকার করা যায় না যে তিনি সবচেয়ে প্রভাবশালী পশ্চিমী কূটনীতিকদের একজন, যিনি ঠান্ডাযুদ্ধের স্থাপত্যকে রূপ দিয়েছিলেন। তিনি যেভাবে এটিকে রূপ দিয়েছিলেন তা আজ অবধি বিশ্ব রাজনীতির কাঠামো অব্যাহত রেখেছে। গত জুলাই মাসে চিন এই শতবর্ষীয়কে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগের একটি পথ খোলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এর থেকে যেমন কিসিঙ্গার বিশ্ব রাজনীতিতে কতটা অস্বাভাবিক প্রভাব বজায় রেখেছিলেন তা বোঝা যায়, তেমনই বোঝা যায় বেজিংয়ের বিড়ম্বনাও, যে দেশটিকে কিনা আপাতদৃষ্টিতে তার ক্ষমতার উচ্চতম শিখরে পৌঁছেও নির্ভর করতে হচ্ছে এমন একজন কূটনীতিকের উপর যিনি ৪৬ বছর আগে অফিস ছেড়েছিলেন।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিসিঙ্গারের প্রভাব ছিল দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে। সব প্রশাসন তাঁর মতামত চেয়ে এসেছে, এবং তাঁর কথা সমস্ত শীর্ষ নেতা শুনতেন। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তাকে কতটা গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়েছিল তা সম্পূর্ণ অন্য বিষয়। কিন্তু এমনকি ১০০ বছর বয়সেও তাঁর তারকা শক্তি হ্রাস পায়নি, এবং তিনি তাঁর ওয়ানলাইনার ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ঝলসে ওঠার ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। তাঁর খবরে থাকার অস্বাভাবিক ক্ষমতা তাঁকে জীবনের চেয়ে বড় পরিমণ্ডল দিয়েছে, এবং তা তিনি শেষ অবধি ধরে রেখেছিলেন। জনসাধারণের মধ্যে তাঁর শেষ উপস্থিতিগুলির একটিতে তিনি তাঁর উত্তরসূরি হিলারি ক্লিনটন ও জেমস বেকারকে হালকাভাবে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কাকে তাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বশ্রেষ্ঠ বিদেশ সচিব বলে মনে করেন।

কিসিঙ্গারের জন্য ক্ষমতা ছিল ‘‌চূড়ান্ত উত্তেজ’‌ এবং তাঁর নিজের জন্য বা যে দেশে তিনি এসে উঠেছিলেন সেই দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষমতার সন্ধান তাঁকে কোনও কোনও সময়ে এমন দিকে নিয়ে গিয়েছিল যে মাঝে মাঝে তিনি নিজেই তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি সাজাতে হিমলিম খেতেন। কিন্তু আদর্শ বা নৈতিকতার সীমাবদ্ধতা সরিয়ে রেখে স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলার সন্ধানই সেই ভিত্তি থেকে গিয়েছিল যার চারপাশে তিনি তাঁর নিজস্ব কূটনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। যেমন তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘‌‘‌শক্তির ভারসাম্যের ব্যবস্থাপনা একটি স্থায়ী উদ্যোগ, এমন কোনও অনুশীলন নয় যার একটি পূর্বাভাসযোগ্য সমাপ্তি আছে।’‌’

 

ঠান্ডা যুদ্ধের সময় এই ব্যবস্থাপনা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দাতাঁত নীতিতে, চিনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্মোচনে, তাঁর শাটল ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে ১৯৭৩ সালের আরবইজরায়েল সংঘাতের অবসান এবং প্যারিস শান্তি চুক্তিতে, যা আমেরিকার ভিয়েতনামে দুঃসাহসিক ভ্রান্ত অভিযানের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিল। কিন্তু এর ফলে আমেরিকা বিভিন্ন সামরিক শাসনের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে অন্ধ হয়ে থেকেছিল, এবং প্রায়শই চিলি ও আর্জেন্টিনা থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন অংশে সামরিক শক্তিমানদের তোয়াজ করে চলত। অনেকেই এই ধরনের নীতি পছন্দের ক্ষেত্রে কিসিঙ্গারের জড়িত থাকার কারণে তাঁকে সম্ভবত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী বলে মনে করেন।

কিসিঙ্গারের বাস্তব রাজনৈতিক বিশ্বদৃষ্টি থেকে উদ্ভূত রাষ্ট্রীয় শিল্পকলা কখনও কখনও সেকেলে হয়ে গিয়েছে বলে মনে হতে পারে, তবে স্পষ্টভাবে স্বীকৃত না হলেও তা এখনও অনেক উপায়ে অবহিত নীতিসিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে চলেছে। বিসমার্ক ও মেটারনিশের ছাত্র হিসাবে কিসিঙ্গার স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে বিদেশনীতি কার্যকর হবে তখনই যখন তা ‘‌ভাবাবেগের উপর নয়, শক্তির মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে’‌ তৈরি হবে। বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলার জন্য শক্তির নিরন্তর বিকশিত ভারসাম্যের সঙ্গে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ সম্পৃক্ততা প্রয়োজন, একটি শূন্যতার মধ্যে আদর্শবাদের অনুসরণ নয়। তিনি স্পষ্ট ছিলেন যে "যে দেশ তার বিদেশনীতিতে নৈতিক পরিপূর্ণতা দাবি করবে, সে পরিপূর্ণতা বা নিরাপত্তা অর্জন করবে না।"

 

প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে কিসিঙ্গারের এই বাস্তববাদঅনুপ্রাণিত অংশীদারিত্বই ছিল জর্জ সি হেরিংএর মতে, "একটি বিদেনীতি যা কখনও সাহসী ও কল্পনাপ্রসূত, কখনও অশোধিত ও প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি, কখনও কার্যকর করার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল, কখনও অদক্ষ; একটি নীতি যা উৎসর্গীকৃত ‘‌শান্তির প্রজন্মের’‌ মহৎ লক্ষ্যে, কিন্তু প্রায়শই সামরিক শক্তি ব্যবহারে নির্মম ও স্বার্থান্বেষী।’‌’‌ সেই সময়ের বিশ্ব ব্যবস্থায় যে রূপান্তরমূলক পরিবর্তনগুলি শুরু হয়েছিল তা দিয়েই এখনও বিশ্ব রূপ নিচ্ছে।

কিসিঙ্গার চিনসোভিয়েত মৈত্রী ভাঙার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিলেন, এবং মূলত চিনের কাছে তাঁর পৌঁছে যাওয়াই আমেরিকার পক্ষে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দিয়ে ঠান্ডা যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করেছিল। ঠান্ডা যুদ্ধ হয়তো ১৯৯০এর দশকের গোড়ার দিকে শেষ হয়েছিল, কিন্তু কিসিঙ্গারই সেই শেষের বীজ বপন করেছিলেন ১৯৭০এর দশকে। আজকের মধ্যপ্রাচ্যও কিসিঙ্গারিয়ান কূটনৈতিক প্রয়াসের জন্যই তৈরি হয়েছে, কারণ তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সেখানকার আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য করে তুলতে কাজ করেছিলেন।

যখন শি জিনপিং বলেন ‘‌চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক চিরকাল ‘‌কিসিঙ্গার’‌ নামটির সঙ্গে যুক্ত থাকবে’‌, এবং যখন মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইজরায়েল সফরের সময় বলেন যে ‘‌হেনরি কিসিঙ্গারের চেয়ে ইতিহাসের ভাল ছাত্র ছিলেন অল্প কয়েকজনই, এবং আরও কম লোক ইতিহাসকে রূপ দিতে তাঁর থেকে বেশি কাজ করেছেন’‌, তখন তাঁরা শুধু যা প্রতীয়মান সেই কথাটাই বলেন। সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে কিসিঙ্গারের প্রভাব বিশাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্ব এখনও কিসিঙ্গারের সময় আমেরিকা যে সিদ্ধান্তগুলি করেছিল তার পরিণতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

অক্টোবরে সম্ভবত তাঁর শেষ প্রকাশ্য বক্তব্যে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন যে আজকের চ্যালেঞ্জগুলির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ‘‌‘‌আমরা কোথায় যাচ্ছি এবং কীভাবে আমরা দলীয় মতনির্বিশেষে এবং রাজনৈতিক মতপার্থক্যের মধ্য দিয়ে সেখানে পৌঁছতে চাই, তার একটি ধারণা তৈরি করতে হবে। সেটাই হল নেতৃত্বের কাছে থেকে চাহিদা।’‌’‌ এটি  কিছুটা অ্যাকাডেমিক শোনাতে পারে, কিন্তু কিসিঙ্গার আজ মার্কিন বিদেশনীতি প্রণয়ন কৌশলের একটি স্পষ্ট খামতির দিকে ইঙ্গিত করছেন বলে মনে হচ্ছে, যেখানে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত প্রবণতাগুলির সঙ্গে সম্পৃক্ততার পরিবর্তে কাজচালানো সাময়িক কৌশলগত নীতির প্রেসক্রিপশনের পথ নেওয়া হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

এবং শেষ পর্যন্ত এইটাই তাঁর সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার হতে পারে বিশ্বব্যবস্থা গঠনে এর সীমার প্রতি সতর্ক থেকে বাস্তব ফলাফল অর্জনের জন্য কার্যকরভাবে কূটনীতি ব্যবহার করা।



এই ভাষ্যটি প্রথমে 'এনডিটিভি'তে প্রকাশিত হয়েছিল।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.