ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতের অভ্যন্তরে ও বাইরে যে গুঞ্জনটি দানা বাঁধছে, তা হল চিন-রাশিয়া অপ্রতিরোধ্য আঁতাত শেষ পর্যন্ত রাশিয়া-ভারতের চিরাচরিত বন্ধুত্বের পথ অবরুদ্ধ করবে এবং ভারতের জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করবে, যা ভারতকে চিনা হুমকির সামনে আরও অরক্ষিত করে তুলবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক চিন সফর নয়াদিল্লির বিপদের ঘণ্টা বাজিয়েছে। এই সফরের ফলে প্রতিপক্ষের আওয়াজ তীব্রতর হচ্ছে এবং তা ভারতকে রাশিয়া থেকে আরও দূরে সরিয়ে দেওয়ার দাবি করছে।
প্রচলিত ভাষ্যের বিপরীতে এই প্রতিবেদনে – যা চিনা প্রতিবেদন সংক্রান্ত গবেষণার উপর ভিত্তি করে লেখা – যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, চিন, রাশিয়া এবং ভারতের মধ্যে ত্রিভুজাকার সমীকরণে চিনের কাছে ভারত-রাশিয়ার গভীর সম্পর্ক মেনে নেওয়া বা (ক) ইন্দো-প্যাসিফিক ভূ-রাজনীতিতে রাশিয়াকে হারানো; অথবা (খ) ভারতকে আরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঘনিষ্ঠ হতে সাহায্য করার মতো ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়া ছাড়া তেমন বিকল্প নেই।
২০২৩ সালের জুন মাসে যখন চিন এবং অন্যান্য কিছু জি২০ সদস্য দেশ কাশ্মীরে ভারত দ্বারা আয়োজিত জি২০ পর্যটন শীর্ষ সম্মেলন বয়কট করেছিল, রাশিয়া সেই বয়কট উপেক্ষা করে এবং উচ্চ স্তরের প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেছিল। এই ঘটনা চিনের নজর আকর্ষণ করেছে এবং চিনে রুশ সমর্থনের ভিত্তিকে এক অস্বস্তির মুখে ফেলে দেয়। আবার ২০২৩ সালের অগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারত এবং চিন যখন তাদের সর্বশেষ দফার কম্যান্ডার পর্যায়ের আলোচনায় বসেছিল, তখন এ কথা প্রকাশ্যে আসে যে, রাশিয়া এস৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভারতকে হস্তান্তর করবে। এটি চিনে জনগণের ক্ষোভের কারণ হয়েছিল এবং চিন-রাশিয়ার ‘সীমাহীন বন্ধুত্ব’ এবং ‘পারস্পরিক কৌশলগত সমন্বয়’-এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল।
অনলাইনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এ হেন ক্ষোভ উগরে দেওয়া হয়েছে যে, দেশটি ভারতকে সামরিক সমর্থন বাড়িয়ে আদতে ‘চিনের পিঠে ছুরিকাঘাত’ করেছে। কারণ ভারতের সঙ্গে চিনের সক্রিয় সীমান্ত বিরোধ রয়েছে।
চিনা গণমাধ্যমের সমীক্ষায় রাশিয়া-ভারত সম্পর্ক নিয়ে চিনের গভীর ক্ষোভ প্রকাশ্যে এসেছে। অনলাইনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এ হেন ক্ষোভ উগরে দেওয়া হয়েছে যে, দেশটি ভারতকে সামরিক সমর্থন বাড়িয়ে আদতে ‘চিনের পিঠে ছুরিকাঘাত’ করেছে। কারণ ভারতের সঙ্গে চিনের সক্রিয় সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। রাশিয়ার উদ্দেশ্য প্রায়শই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কারণ রাশিয়া ভারতকে নানা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে… তা সে চতুর্থ প্রজন্মের ট্যাঙ্ক প্রযুক্তির প্রস্তাবের ক্ষেত্রেই হোক বা সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) থেকে ফার ইস্ট বা সুদূর পূর্ব পর্যন্ত চিন-রাশিয়ার প্রতিটি উদ্যোগে ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করাই হোক না কেন। কিছু চিনা পর্যবেক্ষক এমনটাও ভাবছেন যে, ভবিষ্যতে চিন ও ভারতের মধ্যে বড় আকারের যুদ্ধের ক্ষেত্রে রাশিয়া তা হলে কোন পক্ষ বেছে নেবে?
চিনা কৌশলগত সম্প্রদায়ের একাংশ ক্ষুব্ধ ভাবেই এ কথা স্বীকার করে নিয়েছে যে, চিন-রাশিয়া-ভারত কৌশলগত ত্রিভুজটি রাশিয়া-ভারত কৌশলগত সম্পর্কের পক্ষে কিছুটা তির্যক হতে পারে। রাশিয়া ও চিনের জন্য এটি সুবিধার সম্পর্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম থেকে উদ্ভূত অভিন্ন সাধারণ চ্যালেঞ্জের মুখে এক অস্থায়ী বোঝাপড়া। অন্য দিকে, ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে ‘কোনও সীমান্ত নেই, কোনও ঘৃণা নেই, কোনও ক্ষোভ নেই, কোনও বিরোধ নেই… তারা একে অপরের স্বাভাবিক মিত্র।’
তবে আর এক অংশ বিশ্বাস করেন যে, রাশিয়া এবং ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চিনের উপর একটি নির্দিষ্ট ভূ-রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা আরোপ করলেও এবং চিনা জনসাধারণের ভাবাবেগে আঘাত হানলেও চিনকে একাধিক কারণে এই মতপার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে।
প্রথমত, রাশিয়ার সঙ্গে একটি যৌথ ফ্রন্ট গুরুত্বপূর্ণ (চিনের জন্য) শুধুমাত্র চিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই নয়, ইন্দো-প্যাসিফিকের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের মাঝে বিচ্ছিন্নতা এড়ানোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ইন্দো-প্যাসিফিকের কৌশলগত সমীকরণে অংশগ্রহণের জন্য বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ভারত মহাসাগরের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত দ্বারা) প্রতি আকৃষ্ট হওয়ায় চিন উদ্বিগ্ন এবং দেশগুলি সক্রিয় ভাবে এই অঞ্চলে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে চাইছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে রাশিয়ার ভূমিকাকে পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে ভারতের আগ্রহ সম্পর্কে চিন ভাল মতোই অবগত। যাই হোক, চিনের জন্য বেশ কিছুটা স্বস্তি প্রদান করে ইউক্রেন যুদ্ধ আপাতত এই ধরনের সম্ভাবনাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছে। তার পরেও, ভারতের বৃহত্তম সামুদ্রিক মহড়া ‘মিলন’-এ রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের মতো ঘটনা বেজিংয়ে বিপদঘণ্টা বাজিয়েছে। এ কথা লক্ষ করা জরুরি, যখন বিশ্বব্যাপী আলোচনা চিন-রাশিয়া ‘সীমাহীন’ বন্ধুত্বের আলোড়ন তুলেছে, তখন চিনা কৌশলগত সম্প্রদায় দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়ার চিনের প্রতি ঘনিষ্ঠ হওয়ার স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, বিশেষ করে ইউক্রেন সংঘাতের সমাপ্তির পরে। এই পটভূমিতে চিন আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখতে চায় এবং বলপূর্বক রাশিয়া-ভারত সম্পর্ককে বিপন্ন করে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে চায় না। কারণ রাশিয়া ভারতকে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির নিরিখে তার সর্বশেষ অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক মিত্র বলে বিবেচনা করে।
চিন এ বিষয়ে অবগত যে, রাশিয়া-ভারত সম্পর্কে অবনতি ঘটলে এবং চিনের হস্তক্ষেপের কারণে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় কমিয়ে দিলে, দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য পশ্চিমা দেশের কাছ থেকে আরও বেশি পরিমাণ অস্ত্র ক্রয় করবে।
দ্বিতীয়ত, চিন এ বিষয়ে অবগত যে, রাশিয়া-ভারত সম্পর্কে অবনতি ঘটলে এবং চিনের হস্তক্ষেপের কারণে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় কমিয়ে দিলে, দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য পশ্চিমা দেশের কাছ থেকে আরও বেশি পরিমাণ অস্ত্র ক্রয় করবে। এটি ভারত এবং পশ্চিমকে আরও নিবিড় করে তুলবে, যা চিনের স্বার্থের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সর্বোপরি, চিনের জন্য তার সবচেয়ে বড় দুই প্রতিপক্ষ অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে শক্তিশালী জোটের চেয়ে ক্ষতিকর আর কী-ই বা হতে পারে? বর্তমানে ‘রাশিয়ার বিষয়টি’ কিছুটা হলেও মার্কিন-ভারত সম্পর্ককে ব্যাহত করছে। যার ফলস্বরূপ, ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়টি নিয়ে চিনের উপর তুলনামূলক ভাবে কম চাপ রয়েছে, যা চিনকে তাইওয়ান এবং দক্ষিণ চিন সাগরের সমস্যাগুলিকে কেন্দ্র করে ঘটনাপ্রবাহকে প্রভাবিত করার সুযোগ করে দিয়েছে।
এক কথায় বললে, রাশিয়া-ভারত সম্পর্কের উপর চিনের গভীর নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত রাশিয়ার উপর তার প্রভাব ব্যবহার করে রুশ-ভারত সম্পর্ককে চিনের স্বার্থের অনুকূল করে তোলার জন্য দেশটি মুখিয়ে রয়েছে। যাই হোক, চিন একই সময়ে ইন্দো-প্যাসিফিকের ভূ-রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি যৌথ ফ্রন্ট গঠনে রাশিয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং এই ভাবে ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে রাশিয়াকে নিজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় না। এমনটা হলে ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হওয়া থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে রাশিয়াকে এক উপযোগী দাবার বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করার চিনা স্বার্থ সফল হবে।
চিনকে কেন্দ্র করে ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের আসন্ন ফাটল সংক্রান্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করার আগে ভারত-রাশিয়া-চিন ত্রিভুজের জটিল সমীকরণে বৃহত্তর মনোযোগ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
অন্তরা ঘোষাল সিং অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.