ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের কথা মনে করিয়ে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাসে বিক্ষোভের আগুন জ্বলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশব্যাপী ছোট প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রমবর্ধমান ভাবে উদ্ভূত ছবি একটি গভীর মতাদর্শগত এবং রাজনৈতিক ব্যবধানকেই দর্শায়, যা মার্কিন সমাজের শিক্ষা, ব্যবসা, বাণিজ্য, রাজনৈতিক এবং এমনকি বিনোদনের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত। যাই হোক, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আলোড়ন ফেলা আবেগ এবং গাজা সংঘাতের বর্তমান প্রেক্ষাপটের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান। ভিয়েতনামের যুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চেয়েছিল, অন্য দিকে মধ্যপ্রাচ্যে বিদ্যমান সংঘাতের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে এবং যুদ্ধকে থামাতে নিজের আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রভাবকে ব্যবহার করতে চেয়েছে।
তর্কাতীত ভাবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল, মার্কিনদের মধ্যে প্রজন্মগত ব্যবধান; বিশেষ করে যাঁরা ১৯৬০-এর দশকে জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের থেকে তুলনামূলক ভাবে অল্পবয়সি মিলেনিয়ালস এবং জেন-জি প্রজন্মের মানুষের মধ্যে এই ব্যবধান। আজকের তরুণ মার্কিন জনগণ নিজের দেশকে ইজরায়েলের চ্যালেঞ্জের জটিলতা থেকে দূরে রাখতে আগ্রহী, প্রায়শই ইজরায়েলকে শুধু মাত্র ফিলিস্তিনি ভূমির ‘দখলকারী’ বলেই মনে করে। এর বিপরীতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সমর্থক- সহ পুরনো প্রজন্ম ইজরায়েল সম্পর্কে একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, যা নির্যাতিত ইহুদি জনগণের জন্য স্বদেশ রক্ষার স্বার্থে করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি দ্বারা আকার পেয়েছে। প্রবীণ প্রজন্ম ইজরায়েলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে প্রদত্ত এই মৌলিক আশ্বাস দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইহুদি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক অবিচারের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে দায়বদ্ধ। এই বৈপরীত্য ইজরায়েলের সঙ্গে জড়িত বিদ্যমান সংঘাতকে বিভিন্ন প্রজন্ম কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে এবং নিজেদেরকে সেই সমস্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে, তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই সব কিছুই বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তন ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকেই প্রতিফলিত করে।
আজকের তরুণ মার্কিন জনগণ নিজের দেশকে ইজরায়েলের চ্যালেঞ্জের জটিলতা থেকে দূরে রাখতে আগ্রহী, প্রায়শই ইজরায়েলকে শুধু মাত্র ফিলিস্তিনি ভূমির ‘দখলকারী’ বলেই মনে করে। এর বিপরীতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সমর্থক- সহ পুরনো প্রজন্ম ইজরায়েল সম্পর্কে একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, যা নির্যাতিত ইহুদি জনগণের জন্য স্বদেশ রক্ষার স্বার্থে করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি দ্বারা আকার পেয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়-সহ রাজনৈতিক ও আদর্শগত প্রবাহ দেশটির সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। মার্কিন নিউ লেফটের পুনরুত্থান হয়েছে, যার নেপথ্যে থেকেছে নতুন যুদ্ধ ও দেশটির জনতাত্ত্বিক পরিসরে পরিবর্তন। এই রূপান্তরটি এই শতাব্দীর শুরু থেকে অব্যাহত থাকা শরণার্থীদের জোয়ার দ্বারা ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত এবং বিগত দশকে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষ করা গিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসনের দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী থাকলেও গত এক দশকে অবৈধ অভিবাসনের অভূতপূর্ব বৃদ্ধি লক্ষ করা গিয়েছে, যা প্রাথমিক ভাবে সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার মতো বিষয়গুলির দ্বারা চালিত হয়েছে।
মার্কিন রাজনৈতিক পরিসরে উদ্ঘাটিত এই পরিবর্তনগুলির অন্তত দু’টি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। প্রথমটি হল রাজনৈতিক বিভাজন। বাইডেন প্রশাসন এবং বৃহত্তর ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অভিবাসনকে একটি সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ… দুই-ই বলে মনে করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাইডেন প্রশাসনের সময় আনুমানিক ৭.২ মিলিয়ন অবৈধ অভিবাসীর আগমনের কারণে চ্যালেঞ্জগুলির উপর একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ জোর দেওয়া হয়েছে। এটি অভিবাসন সমস্যায় ডেমোক্র্যাটদের উপর চাপ প্রয়োগ করার বিষয়ে রিপাবলিকানদের জন্য একটি সুযোগ উপস্থাপন করে, যারা ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে হতে চলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অভিবাসনকে সম্ভাব্য কেন্দ্রীয় বিষয় করে তুলেছে। রাজনৈতিক বলয়ের রক্ষণশীল প্রান্তের মানুষজন এই অভিবাসনকে বিশ্বব্যাপী ‘ন্যায্যদের উত্থান’-এর অনুঘটক বলে মনে করেছেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এর ব্যতিক্রম নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ হেন পরিবর্তনমূলক ঘটনাপ্রবাহ আসলে হিমশৈলের চূড়ামাত্র। প্রকৃতপক্ষে, প্রথমে পশ্চিমে অভিবাসন বিরোধী মনোভাব এবং তার পরে কোভিড-১৯ অতিমারি চলাকালীন অর্থনৈতিক মন্দা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রিপাবলিকান দলের স্থিতিশীল জনপ্রিয়তায় অবদান রেখেছে।
দ্বিতীয় সমস্যাটি ভূ-রাজনৈতিক প্রকৃতির এবং নেতানিয়াহু সরকারের নেতৃত্বে গাজার পালটা বিদ্যমান আক্রমণের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের হাত ইজরায়েলের দিকে এগিয়ে দেওয়া উচিত… এই সংক্রান্ত রাজনৈতিক সমর্থনের স্তরকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে এই সমস্যাটি। বাইডেন প্রশাসনের উপর চাপ বহুমুখী: সেগুলি হল ইজরায়েলকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান, গাজাকে সহায়তা প্রদান, রাফাহ আক্রমণে ইজরায়েলকে অগ্রসর হতে বাধা দেওয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বাক্স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করা এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হল গাজায় যুদ্ধবিরতি অর্জন করা।
দ্বিতীয় সমস্যাটি ভূ-রাজনৈতিক প্রকৃতির এবং নেতানিয়াহু সরকারের নেতৃত্বে গাজার পালটা বিদ্যমান আক্রমণের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের হাত ইজরায়েলের দিকে এগিয়ে দেওয়া উচিত… এই সংক্রান্ত রাজনৈতিক সমর্থনের স্তরকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে এই সমস্যাটি। বাইডেন প্রশাসনের উপর চাপ বহুমুখী: সেগুলি হল ইজরায়েলকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান, গাজাকে সহায়তা প্রদান, রাফাহ আক্রমণে ইজরায়েলকে অগ্রসর হতে বাধা দেওয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বাক্স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করা এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হল গাজায় যুদ্ধবিরতি অর্জন করা। এই সীমাবদ্ধতাগুলির মধ্যে কোনওটি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আওতার বাইরে চলে যায়, তবে তার প্রতিক্রিয়াগুলি বাইডেন প্রশাসনের রাজনৈতিক ভাগ্যকে উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রভাবিত করতে পারে। গাজায় টানেল নেটওয়ার্কের একটি সর্পিল গোলকধাঁধায় আটকা পড়ে ইজরায়েল এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই যুদ্ধ এখন ষষ্ঠতম মাসে পড়েছে এবং নাগরিকের মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বাইডেন তাঁর গাজা নীতি এবং ইজরায়েলের প্রতি সমর্থনের জন্য নিজের দলের সদস্যদের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন, বিশেষ করে প্রোগ্রেসিভ-পন্থী মানুষরা বিরোধিতা করেছেন।
ইজরায়েল সম্পর্কে বাইডেনের সংশয় বৃদ্ধি পেয়েছে, যার নেপথ্যে থেকেছে দেশের মধ্যে শান্তি আন্দোলন ও ইহুদি বিদ্বেষের মাঝে ক্রমবর্ধমান ঝাপসা হয়ে আসা বিভাজন রেখা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘বাক্ স্বাধীনতা’ সংক্রান্ত সাংবিধানিক প্রবিধান কখনও কখনও মধ্যপ্রাচ্যের জটিলতাগুলি সম্পূর্ণ রূপে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সরেজমিনে সেগুলিকে আঞ্চলিক বাস্তবতার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হয়েছে। অন্য দিকে সৌদি আরব এবং মিশরের মতো দেশগুলি নিজেরাই অভ্যন্তরীণ ভাবে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকে দমন করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনিবার্য ভাবে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে, যেখানে তার উদার নীতিগুলি একটি রক্ষণশীল জোটের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের বেশ কয়েকটি দেশকে সমন্বিত করেছে। মার্কিন সংবিধান থেকে উদ্ভূত গণতান্ত্রিক অধিকারের সম্প্রসারণ বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগের চেয়ে বেশি প্রতিনিধিত্বের সাক্ষী থেকেছে। ফলস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যের জটিল আঞ্চলিক রাজনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে দেশটির প্রতিক্রিয়া নিজেদের জায়গা করে নিতে সমর্থ হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনিবার্য ভাবে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে, যেখানে তার উদার নীতিগুলি একটি রক্ষণশীল জোটের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের বেশ কয়েকটি দেশকে সমন্বিত করেছে।
আন্তর্জাতিক ভাবে, এই উত্তেজনাগুলি ডেমোক্র্যাটিক বাইডেন প্রশাসনের রাজনৈতিক ভাবে রক্ষণশীল সরকারগুলিকে পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টায় স্পষ্ট, যাদের নীতিগুলি প্রায়শই ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে ভিন্ন। রাজনৈতিক ভাবে দক্ষিণপন্থীদের বিশ্বব্যাপী উত্থান বিশ্বব্যাপী সরকার এবং জনতাত্ত্বিকতায় প্রতিফলিত এবং তা বাইডেন প্রশাসনের জন্য ধারাবাহিক ভাবে চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করেছে, যে প্রশাসন রাজনৈতিক বলয়ের বিপরীতে অবস্থান করছে। অতি-রক্ষণশীল নেতানিয়াহু সরকারের নেতৃত্বে ইজরায়েলকে পরিচালনা করা বাইডেন প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হতে চলেছে। এই পরীক্ষায় বাইডেনকে দেশের অভ্যন্তরের প্রতিযোগী স্বার্থগুলির মাঝে পথ করে নিতে হবে, যে স্বার্থের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যের স্বার্থের সঙ্গে সমাপতিত হয়।
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের বলয় বিস্তৃত হয়েছে। যাই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আনুগত্য এবং গণতান্ত্রিক আদর্শ বাস্তবায়নে অবিচল থেকেছে, যা প্রায়শই অন্য গণতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে মতবিরোধের সৃষ্টি করেছে। মূলত মার্কিন সংবিধান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আদর্শের আদলে তৈরি কানাডা বর্তমানে নিজেকে সম্ভাব্য ভাবে বিপরীত মেরুতে খুঁজে পেয়েছে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী অসন্তোষের মঞ্চ হিসাবে কানাডার ভূমিকাকে তুলে ধরার ঝুঁকি নিয়েছে। ফলস্বরূপ, অভিজাত মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বর্তমান বৃহত্তর মার্কিন সমাজের অণুবিশ্ব বা ক্ষুদ্রবিশ্ব রূপে প্রতিভাত হচ্ছে। এমনটা হতে পারে যে, পরবর্তী দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার পরিবর্তনশীল পরিসর শুধুমাত্র ভোটারদের মধ্যেই নয়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও নিয়মের মধ্যেও বিভাজনকে গভীরতর করে তুলবে।
বিবেক মিশ্র অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.