পৃথিবীর সকল মানুষের উপর প্রভাব বিস্তারকারী জলবায়ু সঙ্কট একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুতর আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলির অন্যতম হয়ে উঠেছে৷ গ্রহের উষ্ণতা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা এবং চরম তাপমাত্রা প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপুনিকতা এবং তীব্রতা বৃদ্ধির পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে।
জাতিগত এবং সম্প্রদায়গত সংখ্যালঘুদের মতো প্রান্তিক গোষ্ঠী এবং নিম্ন আর্থ-সামাজিক পটভূমির অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলি আরও তীব্র ভাবে অনুভব করেন। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনশীলতা এবং বিদ্যমান পরিবর্তনের চাপের সময়ে এই মানুষদের জলবায়ু-অভিযোজন সংক্রান্ত কৌশলগুলির অগ্রভাগে রাখা জরুরি।
কিন্তু এই প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে তাঁরাই জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিকারক এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব অনুভব করেন। পুরুষদের তুলনায় প্রধানত মহিলাদের দারিদ্র্যের সীমারেখার নীচে থাকার সম্ভাবনা বেশি। তাঁরা নাগরিক অধিকার এবং গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সীমিত সুবিধা পান এবং সেই সকল প্রক্রিয়াগত হিংসার সম্মুখীন হন, যা প্রায়শই অস্থিরতার সময় বৃদ্ধি পায়।
জলবায়ু পরিবর্তন হল একটি ‘ঝুঁকিবৃদ্ধিকারী গুণক’, যা আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক উত্তেজনাকে তীব্রতর করে তোলে ও বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলার মাধ্যমে নারীদের স্বাস্থ্য, জীবিকা এবং নিরাপত্তার নিরিখে অনন্য আশংকার সৃষ্টি করে৷ অতএব, জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি অন্তর্বিভাগীয় নারীবাদী সমস্যা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে এবং একই সঙ্গে জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান খুঁজতে আরও বেশি সংখ্যক নারীকে প্রতিনিধিত্বের ভূমিকায় আনা জরুরি।
জলবায়ু পরিবর্তন হল একটি ‘ঝুঁকিবৃদ্ধিকারী গুণক’, যা আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক উত্তেজনাকে তীব্রতর করে তোলে ও বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলার মাধ্যমে নারীদের স্বাস্থ্য, জীবিকা এবং নিরাপত্তার নিরিখে অনন্য আশংকার সৃষ্টি করে৷
বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নারীরা প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর বেশি নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের কাছে সেগুলির লভ্যতা সীমিত। বিশেষ করে গ্রামীণ সম্প্রদায়ের নারী এবং মেয়েরা খাদ্য, জল, জ্বালানি এবং অন্যান্য গৃহস্থালি সংক্রান্ত শক্তি সংস্থানগুলি সুরক্ষিত করার জন্য অতিরিক্ত দায়িত্ব বহন করেন। কিন্তু খরার অবস্থা গুরুতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, বৃষ্টিপাত ক্রমশ আরও অনিয়মিত হয়ে পড়ে, যার ফলে নারীরা দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করতে এবং জীবিকার সংস্থানগুলি সুরক্ষিত করার জন্য অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে বাধ্য হন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যখন তাপ, খরা এবং চরম তাপমাত্রার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে জলের উত্সগুলি শুকিয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক জলের প্রাপ্যতাকে প্রভাবিত করে, তখন নারী এবং মেয়েরা রান্না, স্নান, ধোয়ার কাজ ইত্যাদির জন্য জলের সন্ধানে মাইলের পর মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে বাধ্য হন। যার ফলস্বরূপ তাঁদের স্ব-পুনরুজ্জীবন কার্যক্রম এবং অন্যান্য গৃহস্থালির কাজ করার জন্য খুব অল্প সময় অবশিষ্ট থাকে।
এ ভাবে দ্রুত পরিবর্তনশীল জলবায়ু শুধু মাত্র নারীদের জন্য ধোয়া, রান্না করা, সম্পদ সংগ্রহ করার মতো ঘরোয়া দায়িত্ব এবং বয়স্কদের পাশাপাশি শিশুদের যত্ন নেওয়ার কাজকেও কঠিনতর করে তুলেছে।
এবং আমরা যেন ভুলে না যাই, নিম্ন ও নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলির নারীদের জন্য কৃষি ক্ষেত্র হল কর্মসংস্থানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এর ফল স্বরূপ খরা, ঝড়, হারিকেন, বন্যা ইত্যাদির মতো চরম আবহাওয়ার সময় নারীরাই কৃষি শ্রমিক এবং প্রাথমিক কর্মী বা সংগ্রহকারী হিসাবে উপার্জন, জীবিকা এবং শিশু ও তাদে্র পরিবারের জন্য অন্য প্রয়োজনীয় সম্পদগুলির সুরক্ষার কাজে পুরুষ সহযোগীদের তুলনায় অধিকতর কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হন। এটি অল্পবয়সী মেয়েদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যারা বিদ্যমান বিপর্যয় এবং আর্থিক অভাবের দরুন প্রায়ই স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এবং মায়েদের কাজের বোঝা ভাগ করে নেয়।
উপরন্তু, জলবায়ু সঙ্কট পরিবারগুলির উপর অর্থনৈতিক বোঝা চাপিয়ে দেয়, যার ফলে তাঁদের বাড়িঘর, জীবিকা, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে বসতজমিও হারায়। এর ফলে পরিবারের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার উপর প্রভাব পড়ে, যা বাল্যবিবাহ – যেখানে বাড়ির মেয়েদের উপযুক্ত বয়সের আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় – সহজ বিকল্প হয়ে ওঠে। নানাবিধ প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে যে, মালাউইতে জলবায়ু-প্ররোচিত ধ্বংসাত্মকতা এবং দুর্বলতার ফলে প্রকৃতপক্ষে আসন্ন বছরগুলিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক কনের সংখ্যা আরও ১.৫ মিলিয়ন বৃদ্ধি পাবে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের (ইউএন) মতে, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার ফলে সৃষ্ট সঙ্কটের কারণে ইতিমধ্যে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষদের মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী।
এ ছাড়াও সাম্প্রতিক দশকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বাস্তুচ্যুতি — আন্তর্জাতিক সীমানার মধ্যে এবং সীমানার বাইরে — বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মধ্যে অর্থাৎ যাঁরা নিরুপায় হয়ে নিজেদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নারী এবং অল্পবয়সী মেয়ে। এই বাস্তবতা তাঁদের আরও বেশি করে পাচার, যৌন হিংসা, যৌন শোষণ-সহ অন্যান্য হিংসার বৃহত্তর ঝুঁকির মুখে ফেলে। রাষ্ট্রপুঞ্জের (ইউএন) মতে, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার ফলে সৃষ্ট সঙ্কটের কারণে ইতিমধ্যে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষদের মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চিরাচরিত ভাবে প্রধানত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিষেবার অভাবে নারী ও মেয়েদের স্বাস্থ্যও উল্লেখযোগ্য ভাবে বিপন্ন। এটি বিশেষ করে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ঝুঁকির পরিমাণ আরও বাড়িয়ে তোলে। বাস্তব প্রমাণ চরম তাপ এবং মৃত প্রসবের সম্ভাবনা বৃদ্ধির মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করে। জলবায়ুর পরিবর্তনগুলি ডেঙ্গু, জ্বর, জিকা ভাইরাস এবং ম্যালেরিয়ার মতো ভেক্টর-বাহিত রোগের বিস্তারকেও যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িয়ে তোলে, যা মাতৃত্বের পাশাপাশি নবজাতকের স্বাস্থ্যকেও আশঙ্কার মুখে ফেলে।
যাই হোক, তাঁদের দুর্বলতা এবং ক্রমাগত প্রান্তিকীকরণ সত্ত্বেও নারীদের কেবল মাত্র জলবায়ু সঙ্কটের শিকার হিসাবে দেখা উচিত নয়। এর পরিবর্তে সক্রিয় এবং কার্যকর ব্যক্তি হিসাবে তাঁদের প্রশংসা করা দরকার, যাঁরা বাস্তবায়ন, পরিকল্পনার পাশাপাশি জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন পদ্ধতিগুলির প্রচার চালানোর সহজাত ক্ষমতার অধিকারী এবং যা বিপর্যয় মোকাবিলায় যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে।
নারীরা চিরাচরিত ভাবে খাদ্য সংরক্ষণ ও রেশনিং, জল সংগ্রহ ও সঞ্চয়-সহ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞান এবং দক্ষতা বিকাশের কাজ করে এসেছেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আফ্রিকায় নারীরা প্রায়শই চিরাচরিত দক্ষতা এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত স্থানীয় জ্ঞানের ভাণ্ডারের প্রতিভূর ভূমিকা পালন করেন, যা দুর্যোগের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কার্যকর প্রশমন-সহ প্রাথমিক সতর্কতার সঙ্কেতগুলি বুঝতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও, বিশ্ব জুড়ে নারীরা জলবায়ু সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং স্থিতিশীলতা, সংরক্ষণের পাশাপাশি সহযোগিতার উপর মনোনিবেশ করে বিকল্প সম্প্রদায়ের মডেলগুলির উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছেন।
জলবায়ুর পরিবর্তনগুলি ডেঙ্গু, জ্বর, জিকা ভাইরাস এবং ম্যালেরিয়ার মতো ভেক্টর-বাহিত রোগের বিস্তারকেও যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িয়ে তোলে, যা মাতৃত্বের পাশাপাশি নবজাতকের স্বাস্থ্যকেও আশঙ্কার মুখে ফেলে।
তবুও, জলবায়ু মঞ্চ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলিতে নারীদের স্বল্প প্রতিনিধিত্ব আজও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব, অনন্য অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যাগুলিতে নারীদের পূর্ণ ও সমান অংশীদারিত্ব এবং নেতৃত্ব দেওয়ার অব্যবহিত প্রয়োজন রয়েছে। সর্বোপরি, নারীরা একাধিক বার প্রমাণ করেছেন যে, তাঁরা তাঁদের স্থানীয় জ্ঞান এবং নেতৃত্বের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। সুতরাং, গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে বিদ্যমান জলবায়ু সঙ্কট সমাধানের জন্য ক্ষমতার পরিসরে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এই মুহূর্তে অতি আবশ্যিক।
আকাঙ্ক্ষা খুল্লর ওআরএফ-এর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের ভিজিটিং ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.