Author : Sohini Bose

Published on Sep 12, 2024 Updated 0 Hours ago

বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশ এবং তাইল্যান্ডের জন্য তাদের অভিন্ন সাধারণ সামুদ্রিক পরিসরের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানোর একটি সুযোগ উপস্থাপন করেছে, যা চট্টগ্রাম-রানং সংযোগকে অত্যন্ত লাভজনক করে তুলেছে।

চট্টগ্রাম-রানং সংযোগ:  বঙ্গোপসাগরে সরাসরি নৌ-পরিবহণ

উপকূলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও তাইল্যান্ড তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য দক্ষ ও সুপ্রতিষ্ঠিত বন্দর সংযোগের উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের উত্তর দিকে অবস্থিত, আর অন্য দিকে তাইল্যান্ড সংলগ্ন আন্দামান সাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। তাই উভয় দেশেরই এই অভিন্ন সাধারণ সামুদ্রিক পরিসরের মাধ্যমে তাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ছয় দিনের ব্যাঙ্কক সফরের সময় এই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করার কথা ভাবা হয়েছে। দুই নেতার মধ্যে আলোচনায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর এবং তাইল্যান্ডের রানং বন্দরের মধ্যে একটি সরাসরি শিপিং লাইন বা জাহাজ চলাচলের পথ চালু করার উপর মনোযোগ দেওয়া হয়েছে২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে এই নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতাপত্র (এমওইউ) স্বাক্ষর করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরটি দেশের প্রধান বন্দর, যা দেশে৯০ শতাংশেরও বেশি সামুদ্রিক বাণিজ্য পরিচালনা করে। এটি বঙ্গোপসাগরের ব্যস্ততম বন্দর এবং বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি বন্দর সংক্রান্ত লয়েডের তালিকায় স্থান পাওয়া এই অঞ্চলের একমাত্র বন্দর। রানং বন্দর আন্দামান সাগর বরাবর তাইল্যান্ডের একমাত্র বন্দর, যার ফলে এটি বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। তাইল্যান্ড উপসাগরের অন্যান্য উপকূলের সঙ্গে, বিশেষ করে ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে সংযোগ উন্নত করতে রানং-এর উন্নয়ন করছে। তাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রফতানি বর্তমানে সিঙ্গাপুর বন্দর, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং এবং শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয় এবং এর ফলে ১০ দিন সময় লাগে। এই বন্দরগুলির মধ্যে সরাসরি শিপিং পরিবহণের সময়কে তিন দিনে কমাতে এবং আনুমানিক ৩০ শতাংশ শিপিং খরচ কমাতে সাহায্য করবে। স্থানীয় বেসরকারি সংস্থাগুলি এই পথে মিটার ড্রাফ্ট এবং ১০০০০ টন বা ২০ ফুট সমতুল্য ইউনিটের বাল্ক ক্যারিয়ার এবং কন্টেনার জাহাজ পরিচালনা করতে পারে।

 

সরাসরি শিপিং-এর সুবিধা

সরাসরি শিপিং সংযোগের ফলে বাংলাদেশ ও তাইল্যান্ডের মধ্যে বাণিজ্য ও পর্যটন বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ উভয় দেশই তাদের বাণিজ্যিক বিনিময় বাড়াতে আগ্রহী। এ প্রসঙ্গে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এপ্রিল মাসের সফরের সময় একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) জন্য আলোচনা শুরু করার অভিপ্রায়ে একটি চিঠি স্বাক্ষর করেন। এফটিএ বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে এমন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করবে। কারণ বাংলাদেশ তার রফতানির চেয়ে তাইল্যান্ড থেকে আমদানি করে অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে বাংলাদেশ তাইল্যান্ডে ৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করলেও দেশটি থেকে তাদের আমদানির পরিমাণ ছিল ১.১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

 

সরাসরি শিপিং সংযোগের ফলে বাংলাদেশ ও তাইল্যান্ডের মধ্যে বাণিজ্য ও পর্যটন বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ উভয় দেশই তাদের বাণিজ্যিক বিনিময় বাড়াতে আগ্রহী। এ প্রসঙ্গে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এপ্রিল মাসের সফরের সময় একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) জন্য আলোচনা শুরু করার অভিপ্রায়ে একটি চিঠি স্বাক্ষর করেন।

 

সরাসরি শিপিং সংযোগটিকে প্রাথমিক ভাবে এই বাণিজ্যের সুবিধার্থে ব্যবহার করা হলেও ভবিষ্যতে যাত্রী পরিষেবার জন্যও তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এটি পর্যটন ক্ষেত্রকে উপকৃত করবে, যা দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার একটি প্রধান ক্ষেত্র। তাইল্যান্ড প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পর্যটক আকর্ষণ করে এবং চিকিৎসা পর্যটনের জন্যও এটি একটি পছন্দের গন্তব্য। ২০১৯ সালে প্রায় ১৪০০০০ বাংলাদেশি পর্যটনের জন্য তাইল্যান্ডে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে ৪৩০০ জন চিকিৎসার কারণে সে দেশে ভ্রমণ করেছিলেন, যা তাইল্যান্ডের অর্থনীতিতে প্রায় ১৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অবদান রেখেছে। সেই অনুসারে, উভয় দেশই এই খাতে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় স্বাক্ষরিত তিনটি সমঝোতাপত্রের ব্যাখ্যা দেয়। সে সময়ে হাসিনা যে তিনটি মউ-তে স্বাক্ষর করেছিলেন, তার মধ্যে একটি ছিল পর্যটন সংক্রান্ত, একটি ছিল আনুষ্ঠানিক পাসপোর্ট ধারকদের জন্য ভিসা অব্যাহতি সংক্রান্ত এবং তৃতীয়টি ছিল শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগিতা ও পারস্পরিক সহায়তা সংক্রান্ত। ভবিষ্যতে বৌদ্ধ সার্কিটের প্রচারে যৌথ উদ্যোগে পর্যটনের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

 

কৌশলগত সুবিধা

বাণিজ্য এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি রানং এবং চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি নৌ-যোগাযোগ স্থাপন উভয় দেশের জন্য কৌশলগত সুবিধাও রাখে। চট্টগ্রামের সঙ্গে একটি শক্তিশালী সংযোগ তাইল্যান্ডকে নেপাল, ভুটান এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে উন্নত বাণিজ্যের সুযোগ প্রদান করে, যা বন্দরের অন্তঃস্থল গঠন করে। অন্য দিকে, ঢাকা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী এবং রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য মেকং-গঙ্গা কোঅপারেশন ফোরামে যোগদান এবং সহায়তার জন্য অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস-এর (আসিয়ান) সঙ্গে সেক্টরাল পার্টনারশিপ তকমা অর্জনের উদ্দেশ্যে তাইল্যান্ডের সমর্থনের উপর নির্ভর করছে।

 

বাণিজ্য এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি রানং এবং  চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি নৌ-যোগাযোগ স্থাপন উভয় দেশের জন্য কৌশলগত সুবিধাও রাখে। চট্টগ্রামের সঙ্গে একটি শক্তিশালী সংযোগ তাইল্যান্ডকে নেপাল, ভুটান এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে উন্নত বাণিজ্যের সুযোগ প্রদান করে, যা বন্দরের অন্তঃস্থল গঠন করে।

 

উপরন্তু, সরাসরি শিপিং রুট বাংলাদেশকে তাই প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাগশিপ ল্যান্ডব্রিজ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরে সম্ভাব্য প্রবেশাধিকার প্রদান করে, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল রানং বন্দর। ল্যান্ডব্রিজ উদ্যোগটি দক্ষিণ তাইল্যান্ডের ক্রা ইস্তমাস জুড়ে একটি খাল নির্মাণের পূর্বের ধারণাটিকে প্রতিস্থাপন করে যা হাইওয়ে এবং রেলপথের সমন্বয়ে একটি পরিবহণ করিডোর দিয়ে আন্দামান সাগরকে তাইল্যান্ডের উপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এই করিডোরটি ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে মালাক্কার যানজটপূর্ণ এবং কৌশলগত ভাবে সংবেদনশীল প্রণালী হয়ে যাতায়াত না করে পণ্য ও মানুষের চলাচল সহজতর করবে। এই সংযোগ চালু হলে ল্যান্ডব্রিজ বঙ্গোপসাগরের বাণিজ্যকে বৃদ্ধি করার পাশাপাশি রানং এবং চট্টগ্রামকে সরাসরি সংযোগ করবে। কারণ ভারত ও বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই একটি কোস্টাল শিপিং এগ্রিমেন্টে স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর সরাসরি কলকাতা ও চেন্নাই বন্দরের সঙ্গে বাণিজ্য করে এবং সংযোগের উপর বিমস্টেক মাস্টার প্ল্যান (২০২২) তাইল্যান্ডের রানং বন্দর এবং চেন্নাই এবং কলম্বো বন্দরগুলির মধ্যে সরাসরি শিপিং লিঙ্ক তৈরির বিষয়টির উপর নজর দেবে।  

 

কূটনৈতিক সতর্কতা

যাই হোক, সরাসরি শিপিং রুটের অনেক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এমন কূটনৈতিক সংবেদনশীলতা রয়েছে যা বাংলাদেশ এবং তাইল্যান্ড উভয়কেই এটি বাস্তবায়নে সমাধান করতে হবে। চট্টগ্রাম ও রানং-এর মাঝপথে অবস্থিত রাখাইনের উপকূলীয় প্রদেশে জাতিগত সম্প্রদায় এবং সামরিক হুন্তার মধ্যে সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট হওয়া মায়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়টি সরাসরি শিপিং লিঙ্কটি বাস্তবায়নে দীর্ঘ বিলম্বের অন্যতম কারণ যদিও ২০১৬ সালের প্রথম দিকে এটি শুরু করার জন্য আলোচনা শুরু হয়েছিল। সংযোগটিকে কার্যকর করার জন্য এই সমস্যার কূটনৈতিক সমাধান প্রয়োজন।

 

যাই হোক, সরাসরি শিপিং রুটের অনেক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এমন কূটনৈতিক সংবেদনশীলতা রয়েছে যা বাংলাদেশ এবং তাইল্যান্ড উভয়কেই এটি বাস্তবায়নে সমাধান করতে হবে।

 

অন্য চ্যালেঞ্জটি বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে চিনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাংলাদেশে চিনা বিনিয়োগ বেড়েছে এবং তাল্যান্ডব্রিজ প্রকল্পটি বেজিংয়ের মালাক্কা সমস্যা সমাধানের জন্য আদর্শ। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে, চিনে অবস্থিত এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক এই প্রকল্পের উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে চিনের বিনিয়োগ এবং ল্যান্ডব্রিজ নির্মাণে তার প্রচেষ্টা চট্টগ্রাম ও রানং-এর মধ্যে সরাসরি শিপিং সংযোগকে চিনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত করবে কারণ বাংলাদেশ ও তাইল্যান্ড উভয়ই বিআরআই-এর সদস্য। এটি উপসাগরে শক্তি সমীকরণের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আগ্রহী ভারত এবং অন্যান্য ইন্দো-প্যাসিফিক দেশের জন্য হতাশাজনক। কারণ এর ফলে সামুদ্রিক পরিসর চিনের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে। অতীতে ভারত ও চিন উভয়ের সঙ্গেই বাংলাদেশ ও তাইল্যান্ডের দৃঢ় সম্পর্ক ছিল। সরাসরি শিপিং সংযোগ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানোর কারণে তাদের কূটনৈতিক দক্ষতা আবারও পরীক্ষার মুখে পড়বে।

তা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ যেহেতু ২০২৬ সালের মধ্যে তার স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদার উপরে উঠতে এবং ২০৩১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার জন্য আরও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্য স্থির করেছে, এই শিপিং সংযোগটির বাণিজ্যিক মূল্য অপরিসীম হয়ে উঠবে। তাইল্যান্ডের জন্য, এই সংযোগটি দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে তার বাণিজ্য বাড়ানোর সুযোগ দেয়, বিশেষ করে যখন তাইল্যান্ড চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে তার বিকল্পের সন্ধান করছে। শিপিং লিঙ্কের সর্বোত্তম কার্যকারিতা বাস্তবায়িত করার মূল চাবিকাঠি নিহিত রয়েছে সংযোগটিকে বঙ্গোপসাগরের আঞ্চলিক বাণিজ্য শৃঙ্খলের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা এবং অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এবং কূটনৈতিক সংবেদনশীলতার ভারসাম্য বজায় রাখার মধ্যে।

 


সোহিনী বোস অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.