আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৯৭১ সালে গঠিত কাতার হল উপসাগরীয় অঞ্চলের এমন একটি ছোট দেশ, যা মধ্যপ্রাচ্যের (পশ্চিম এশিয়া) মধ্যে আঞ্চলিক সংঘাত ও সমস্যায় বৃহত্তর উপস্থিতির কারণে সকলের মনোযোগের কেন্দ্রে উঠে এসেছে। কাতারের বৈদেশিক নীতি বর্তমান রাজপরিবারের স্ব-সংরক্ষণ এবং সুরক্ষা থেকে উদ্ভূত হয় (অন্য উপসাগরীয় দেশগুলির মতোই)। স্বাধীনতার পরে কাতার সৌদি আরবের উপর আর মুখাপেক্ষী থাকে না। সৌদি আরবের উপর কাতার সুরক্ষার জন্য নির্ভর করে থাকলেও ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে তার মনোভাব পরিবর্তিত হয়। এই মনোভাবের পরিবর্তনকে চালিত করেছে দু’টি কারণ: প্রথমটি হল কুয়েতে ইরাকি আক্রমণ (১৯৯০ সাল), সৌদি আরব যেটির মোকাবিলা করার চেষ্টা করেনি। এই ঘটনা থেকেই কাতার ইঙ্গিত পেয়েছিল যে, দেশটি নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আর সৌদি আরবের উপর নির্ভর করতে পারবে না; এবং দ্বিতীয় কারণটি ছিল ১৯৯৫ সালে শেখ হামাদ বিন খলিফা ক্ষমতায় আসার পরে অবস্থার পরিবর্তন।
কাতারের বৈদেশিক নীতি বর্তমান রাজপরিবারের স্ব-সংরক্ষণ এবং সুরক্ষা থেকে উদ্ভূত হয় (অন্য উপসাগরীয় দেশগুলির মতোই)।
কাতারের স্বাধীনতার উপর জোর দিতে হামাদ এমন একটি সক্রিয় বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করতে শুরু করেন, যেটির লক্ষ্য ছিল একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধরত দুই প্রধান প্রতিবেশী দেশ ইরান এবং সৌদির মধ্যে স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখা। এই বৈদেশিক নীতি পরিবর্তনের অংশ হিসেবে কাতার কূটনৈতিক শক্তিতে বিনিয়োগ করে তার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। ১৯৯৬ সালে আল জাজিরা গঠন এই পদক্ষেপের একটি অংশ ছিল। একই ভাবে কাতার ১৯৯৬ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকারী প্রথম উপসাগরীয় দেশ হয়ে ওঠে। এর স্বল্প সময়ের মধ্যেই কাতার আল উদেইদ এয়ারবেসের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জন্য তার দরজা খুলে দেয়, যেটিকে ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৯/১১ হামলার পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানে আল-কায়েদাকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়।
ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী
কাতার তার বিদেশনীতিতে ভারসাম্যমূলক কাজ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংঘাতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০৬ সাল থেকে হামাস ও ফাতাহ-র (ফিলিস্তিনের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল) মধ্যে এবং ইয়েমেন, লেবানন, দক্ষিণ সুদান ও লিবিয়া জুড়ে গত দুই দশক ধরে এ হেন দ্বন্দ্বে সম্পৃক্ত হয়। সংঘাতে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে এবং ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় আরব রাষ্ট্র জুড়ে ঘটা বিপ্লবী আন্দোলনকে সমর্থনের দরুন কাতারের ভূমিকা দেশটিকে এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী উপস্থিতি অর্জনে সহায়তা করেছে। হামাস ও ইজরায়েলের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী রূপে দেশটির বর্তমান ভূমিকা এই আলোকে দেখা জরুরি।
হামাসের সঙ্গে কাতারের সম্পর্ক ২০০৬ সাল থেকে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যখন হামাস তখনকার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে গাজা উপত্যকা থেকে হঠাতে সাহায্য করে। এর পর থেকে কাতার বিভিন্ন শীর্ষ সম্মেলন ও বৈঠকে হামাস কর্মকর্তাদের আতিথেয়তা করে আসছে। ২০১৬ সাল থেকে হামাসের বর্তমান নেতা ইসমাইল হানিয়েও কাতারে অবস্থান করছেন। হামাসের সঙ্গে কিছু আদর্শগত নৈকট্য ছাড়াও কাতার এই গোষ্ঠীটিকে একমাত্র চ্যানেল হিসাবে মনে করে, যার দ্বারা গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের জীবন উন্নত করা যেতে পারে। এই বিশ্বাসের কারণে কাতার গত কয়েক দশক ধরে এই অঞ্চলটিতে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার করে ত্রাণ পাঠাচ্ছে।
সংঘাতে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে এবং ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় আরব রাষ্ট্র জুড়ে ঘটা বিপ্লবী আন্দোলনকে সমর্থনের দরুন কাতারের ভূমিকা দেশটিকে এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী উপস্থিতি অর্জনে সহায়তা করেছে।
এর বিপরীতে, কাতারও ১৯৯৬ সাল থেকে ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছে এবং ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশটির সঙ্গে একটি নামমাত্র সম্পর্ক বজায় রেখেছে, যখন গাজা উপত্যকায় ইজরায়েলের আক্রমণকে কেন্দ্র করে কাতার তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার একটি অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাতারের সম্পর্ক থেকেও উদ্ভূত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাতার দীর্ঘ সময় যাবৎ শক্তিশালী বাণিজ্য ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং এমনকি ইরান ও আফগানিস্তানের (বিশেষ করে তালিবান) সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মধ্যস্থতা করতে সহায়তা করেছে। এ ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার নিজস্ব স্পৃহা দেশটিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরেও ইজরায়েলি কর্মকর্তাদের সাথে ব্যাক-চ্যানেল কনট্যাক্ট বা ব্যক্তিগত স্তরে যোগাযোগ বজায় রাখতে বাধ্য করেছে।
বর্তমান মধ্যস্থতা ও দৃষ্টিভঙ্গি
বেশির ভাগ পর্যবেক্ষকই যেমন উল্লেখ করেছেন, উত্তেজনা কমাতে কাতারের আগ্রাসী প্রচেষ্টা ছাড়া হামাস ও ইজরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি সম্ভব হত না। আলোচনায় ইজরায়েলি এবং হামাস… দুই নেতাকেই সম্পৃক্ত করে কাতার একটি যুদ্ধবিরতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল, যার মেয়াদ অন্ততপক্ষে দু’বার বর্ধিত করা হয়। সামগ্রিক ভাবে, ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে সংঘাতে কাতারের ভূমিকার লক্ষ্য ছিল যুদ্ধের মীমাংসা হওয়ার পরে শান্তি ও পুনর্গঠনের কিছু প্রচেষ্টা সুনিশ্চিত করা।
যাই হোক, এই মধ্যস্থতাকারী প্রচেষ্টার মাধ্যমে কাতার মধ্যপ্রাচ্যে একটি মধ্যম শক্তি এবং রাজনৈতিক শক্তির মধ্যস্থতাকারী হিসাবে একটি বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে নিজের জন্য একটি বৃহত্তর মঞ্চ তৈরি করতে চায়। কাতার এ ভাবে পশ্চিমের জন্য একটি অপরিহার্য দেশ হিসাবে নিজেদের ভিত্তি মজবুত করতে আগ্রহী, যদি ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অন্যান্য আরব দেশ দ্বারা অবরোধের মতো কাতারের নিরাপত্তা সংক্রান্ত হুমকির মতো আরও কোনও সমস্যা না দেখা দেয়।
একদা সৌদি আরবের সুরক্ষাবলয় থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমানে এক আরও বেশি স্বাধীন নীতির দিকে মনোযোগ দিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাতারের বৈদেশিক নীতি পরিবর্তিত হয়েছে। এই প্রয়াসের লক্ষ্য হল নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করে বিদ্যমান সংঘাতের নিরিখে এক শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করা। যাই হোক, জয়ের সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসা চ্যালেঞ্জকেও অস্বীকার করা যায় না।
ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে সংঘাতে কাতারের ভূমিকার লক্ষ্য ছিল যুদ্ধের মীমাংসা হওয়ার পরে শান্তি ও পুনর্গঠনের কিছু প্রচেষ্টা সুনিশ্চিত করা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আরও শক্তিশালী নীতি গ্রহণের জন্য বেশির ভাগ আরব ও মুসলিম বিশ্ব কাতারকে ইতিবাচক আলোকে দেখছে। তবে ইজরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাতারের সম্পর্কও পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। মার্কিন নীতিনির্ধারকরা দাবি করেছেন যে, কাতার যেন ইজরায়েলের উপর হামলার কারণে হামাসের সব কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করে। এর পাশাপাশি, ইজরায়েল হামাসকে সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এমনটা ঘোষণা করার পর থেকে দেশটি নাগরিক অঞ্চলে নিরলস ভাবে বোমাবর্ষণ চালিয়ে গিয়েছে।
উভয় বিকল্পই কাতারের পক্ষে অনুকূল নয়। কারণ হামাসের অপসারণ (কাতার থেকে বা নিজেদের অস্তিত্ব থেকে) হলে কাতার তার এক বৃহত্তম সংযোগ হারাবে। যাই হোক হামাসের জন্য অব্যবহিত সমর্থন - বিশেষ করে যদি আরও হামলা চালানো হয় সে ক্ষেত্রে – কাতারের অবস্থান খর্ব করতে পারে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাতারের সম্পর্কে তা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। উভয় সঙ্কটের মাঝে পড়ে কাতারের একমাত্র আশা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেওয়া তার শক্তিশালী গ্যাস ও জ্বালানি সরবরাহ, মার্কিন সামরিক বাহিনীকে সমর্থন, অন্যান্য সংঘাতে নিজের শক্তিশালী কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে মধ্যস্থতা করার ক্ষমতা সঙ্কট-পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ককে বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
মোহাম্মদ সিনান সিয়েচ অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নন রেসিডেন্ট অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.