Published on Mar 06, 2024 Updated 0 Hours ago

রায়েল এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতে ইইউ-এর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে।

ইজরায়েলের সমসাময়িক রাজনীতিতে মধ্য-ইউরোপীয় সংযোগ

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) তরফে হামাসের আক্রমণের সরাসরি নিন্দার সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়াটিজরায়েল সম্পর্কে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ঐকমত্য সংক্রান্ত প্রথম সিদ্ধান্তগুলির অন্যতম। অতীতে ইইউ-তে ইরায়েলের প্রতি সমর্থন সময় ও স্থানভেদে অভিন্ন ছিল না। দুই দশক আগে একটি  সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ৫৯ শতাংশ ইউরোপীয়ই এ বিষয়ে একমত যে,জরায়েল বিশ্ব শান্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। ইইউ অতীতে অবৈধ  জরায়েলি বসতি স্থাপন ও হামলার নিন্দা করেছে। ইরায়েলের প্রসঙ্গে ইইউ-তে মিশ্র নীতি দেখা গেছে। যাই হোক, ইইউ-এর মধ্যে অন্য চরিত্রের কিছু দেশও রয়েছে অস্ট্রিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া এবং স্লোভাকিয়ার মতো মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে রায়েলের সম্পর্ক অনেক বেশি উষ্ণ এবং সেই ঘনিষ্ঠতা এতটাই বেশি যে, এই দেশগুলি প্রায়শই ইইউ-  অবস্থান মেনে চলে না। গত বছর অক্টোবর মাসে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র এবং ক্রোয়েশিয়ার মতো চারটি ইইউ দেশ গাজা উপত্যকায় একটি মানবিক যুদ্ধবিরতির জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। অতএব, স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্ন উঠেছে, কেন কিছু ইইউ দেশ অন্যদের তুলনায় ইরায়েলকে বেশি সমর্থন করে এবং কেন তেল আভিভের পক্ষে থাকা বেশির ভাগ দেশ মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত?

 

অভিন্ন সাধারণ ইতিহাস

ঐতিহাসিক ভাবে দেখতে গেলে, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির তরফেরায়েলকে সমর্থন করার নেপথ্যে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। ১৮৮২ সালের আগে বিশ্বব্যাপী ইহুদি জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অনুপাত অর্থাৎ প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ জারতান্ত্রিক রুশ সাম্রাজ্য এবং হ্যাপসবার্গ অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যে বসবাস করতেন। এই সাম্রাজ্যগুলি পোলিশ লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ থেকে আলাদা হওয়ার পরে উত্তরাধিকারসূত্রে বেশির ভাগ ইহুদি জনসংখ্যাবিশিষ্ট হয়ে ওঠে, যা পোলিশ ক্রাউন ল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, বেলারুশিয়া (বর্তমান বেলারুশ) এবং ইউক্রেনকে অন্তর্ভুক্ত করে। উপরন্তু, মোরাভিয়া, বোহেমিয়া, হাঙ্গেরি এবং স্লোভাকিয়ার ইহুদি সম্প্রদায়গুলি হ্যাপসবার্গ শাসনের অধীনে ছিল। সেই সময়ে এই অঞ্চলের ইহুদি জনসংখ্যা পূর্ব এবং মধ্য ইউরোপের ফল্ট লাইন বা বিতর্কিত অঞ্চলে বাস করত এবং ইহুদি ধর্ম আধুনিকতার সংমেলের দরুন ইহুদি ধর্মের মধ্যে রূপান্তর ঘটে এর ফলে সাহিত্যের মাধ্যম হিসেবে হিব্রু ভাষার পুনরুজ্জীবন হয়। সেজন্যই রায়েলের সাংস্কৃতিক প্রতীকগুলির উৎস এই রূপান্তরকালীন সময়ে পূর্ব এবং মধ্য ইউরোপের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।

এমনকি ইজরায়েলি দক্ষিণ ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির মতাদর্শগত ভিত্তি পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে: ডেভিড বেন গুরিয়নের মতো ইরায়েলি লেবার নেতারা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট এবং নারদোনিকদের মধ্যে বিতর্কে ডুবে ছিলেন। আবার ডভ দের বোরোচেভের মতো বেশ কয়েক জন নেতা ইহুদিবাদকে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লেষিত করেনতিনি কখনও ইরায়েলে চলে না গেলেও তাঁর ধারণাগুলি ইরায়েলি বাম রাজনীতিতে সত্তাতাত্ত্বিক ভাবে প্রাসঙ্গিক। ইরায়েলি অধিকারের ক্ষেত্রে, অন্তর্বর্তীকালীন যুদ্ধপর্যায়ে পোল্যান্ড যে অস্থিরতা জাতিগত বিভাজনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী নেতারা সেগুলি দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। মেনাহেম বেগিনের ইরগুন জাভাই লিউমি পিলসুডস্কির ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। তাই শ্লোমো অ্যাভিনেরি যথার্থই বলেছেন, জরায়েলের ভৌগোলিক অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যে হলেও তার রাজনীতি প্রায়শই পূর্ব ইউরোপীয়।
বর্তমানে ইরায়েল এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে সম্পর্ক শুধু অভিন্ন সাধারণ ইতিহাস দ্বারা প্রভাবিত নয়। এই দেশগুলির একই রকম রক্ষণশীল মূল্যবোধ রয়েছে এবং তাদের কর্তৃত্ববাদী কাঠামো জনবাদী নেতা রয়েছে (চেক প্রজাতন্ত্র ব্যতীত) এবং গণতান্ত্রিক ঐকমত্যের অভাব রয়েছে, যা দেশগুলিকে ইজরায়েলেসঙ্গে অনুকূল সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম করে। ভিসগ্রাড ৪ দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে ইইউ-র অবস্থানের সঙ্গে সহমত। যাই হোক, এই দেশগুলি অভিবাসন, নিরাপত্তা হুমকির ধারণার মতো বিষয়গুলিতে ইরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে, যাব ক’টিই ইইউ-তে বিতর্কিত। ২০১১ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে অভিন্ন সাধারণ স্বার্থগুলি বিবর্তিত হয়েছে। সেই সময়ে আরব বসন্ত এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা শুরু হয়েছিল, যার ফলে বহু সংখ্যক অভিবাসী ও শরণার্থী ইইউ-এর সীমান্ত বরাবর এসে ভিড় করে। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলি নিজেদের দেশে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল। এই দেশগুলির আসলে আরব দেশগুলির প্রতি অভিবাসন সংক্রান্ত বিদ্বেষ রয়েছে এবং তারা একই রকম রক্ষণশীল বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে ইরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাই ইরায়েল ব্রাসেলস থেকে আসা চাপকে নরম করার জন্য এই দেশগুলিকে ব্যবহার করে। ২০১৮ সালে চেক প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়া এবং হাঙ্গেরি জেরুজালেমে তার দূতাবাস সরানোর পরিকল্পনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে একটি ইইউ বিবৃতি-র বিরোধিতা করে। হাঙ্গেরি তার দূতাবাস  জেরুজালেমে স্থানান্তরের কথা বিবেচনা করার খবর সত্ত্বেও হাঙ্গেরির বিদেশমন্ত্র তা অস্বীকার করে। সম্প্রতি, চেক প্রধানমন্ত্রী পেত্র ফিয়ালা বলেছেন যে, চেক প্রজাতন্ত্র কয়েক মাসের মধ্যে তার দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করতে পারে। সুতরাং, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যখন প্রেসিডেন্ট অরবানকে ‘ইরায়েলের প্রকৃত বন্ধু’ বলে অভিবাদন জানিয়েছিলেন, তখন তাতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।

 

মার্কিন দৃষ্টিকোণ

 

রায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বৈধতা প্রাপ্তির বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হয়ে ওঠে।

 

রায়েল এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্র উভয়ের জন্যই এটি একটি দ্বিমুখী জয়ের পরিস্থিতি কারণ মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলি ইরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য করে লাভবান হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও বৈধতা লাভ করে মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির জন্য হোয়াইট হাউস থেকে আমন্ত্রণ পাওয়ার একমাত্র উপায় হল প্রচুর পরিমাণে মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করা অথবা প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর এই সফরের জন্য সচেষ্ট হওয়া। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় জনবাদী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। যাই হোক, বাইডেন প্রশাসন - যা গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণকে উলটে দেওয়ার আশা রাখে - মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, হাঙ্গেরি ইউএস ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের তদন্তের আওতায় এসেছিল কারণ অফিস অব ফরেন অ্যাসেট কন্ট্রোল (ওএফএসি) রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক-এ (আইআইবি) অংশগ্রহণের জন্য হাঙ্গেরির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, পরে অবশ্য তা তুলে নেওয়া হয়। এই কারণেই নিজের জাতীয় স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে ইরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বৈধতা প্রাপ্তির বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হয়ে ওঠে। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির তরফেরায়েলি কর্মকাণ্ডের নিন্দা না করার নেপথ্যের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম

 

রায়েল এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্র উভয়ের জন্যই এটি একটি দ্বিমুখী জয়ের পরিস্থিতি কারণ মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলি ইরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য করে লাভবান হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও বৈধতা লাভ করে

 

বাড়ছে কূটনৈতিক চাপানউতোর

এক দিকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের লেভানটাইন অববাহিকায় প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কারের সাম্প্রতিক ঘটনা এবং উত্তর সাইপ্রাসের সামুদ্রিক সীমানা প্রসারিত করে সেখান থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের জন্য তুর্কিয়ের দাবির বিরুদ্ধে গ্রিস, সাইপ্রাস এবং মিশরের প্রতি ইরায়েলের সমর্থন; এবং অন্য দিকে ইউরো-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইজরায়েলের সক্রিয় অবস্থান এবং আব্রাহাম অ্যাকর্ডস স্বাক্ষরের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে সম্পর্ক সহজ করারায়েলের কূটনৈতিক প্রয়াস আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় দর কষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। এ ভাবে, মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলি ইরায়েলের উপর বাজি ধরতে প্রস্তুত, যা জরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতকে কেন্দ্র করে ইইউ-র বিভাজনকে আরও প্রকাশ্যে এনেছে।

 


রাজোলি সিদ্ধার্থ জয়প্রকাশ অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের রিসার্চ ইন্টার্ন।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.