Published on May 20, 2023 Updated 0 Hours ago

একটি নতুন সংস্কারকামী সরকার তাইল্যান্ডে ক্ষমতায় আসার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং দেশীয় আকাঙ্ক্ষার জটিলতা আগামী বছরগুলিতে সে দেশের রাজনৈতিক গতিপথকে রূপ দেবে

এক রূপান্তরমূলক কর্মসূচির পক্ষে তাইল্যান্ডের মতদান

২০২৩ সালে তাইল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক পরিসরে এক উল্লেখযোগ্য মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল, যেখানে ভোটাররা দেশের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেন। ব্যাঙ্ককের বর্তমান মেজাজ স্বাভাবিক ভাবেই দেশটির প্রত্যেক কোণের উৎসবকেই তুলে ধরে। প্রায় এক দশক পর নবীন এবং প্রবীণ সকলেই যুবশক্তি পরিচালিত দলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি (এমএফপি) সবচেয়ে বেশি আসন দখল করার পাশাপাশি ভোটের বৃহত্তম অংশ অর্জন করেছে।

এর ঠিক পরেই রয়েছে জনমুখী ফেউ তাই পার্টি, যারা নির্বাচনী আসনের মাত্র ২৩ শতাংশ দখল করতে পেরেছে। ১৫ মে ভোটগণনা প্রায় সম্পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে উল্লিখিত প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায় যে, এমএফপি সর্বমোট ১৪৭টি আসন পেয়ে লোয়ার হাউসে সর্বাধিক সংখ্যক আসন দখল করতে চলেছে। এই ১৪৭টি আসনের মধ্যে ১১২টি প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত আসন এবং বাকি ৩৫টি আসন দলগুলির জন্য আনুপাতিক ভাবে বরাদ্দকৃত ১০০টি আসন থেকে প্রাপ্ত। ফেউ তাই পার্টি  পার্লামেন্টে মোট ১৩৮টি আসন পেয়েছে, যার মধ্যে ১১২টি আসন প্রত্যক্ষ ভাবে নির্বাচনী এলাকার মাধ্যমে নির্বাচিত এবং দলটি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির মাধ্যমে অতিরিক্ত ২৭টি আসন পেয়েছে। এই উল্লেখযোগ্য আসন সংখ্যা রাজনৈতিক পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে ফেউ তাই পার্টির অবস্থানকে সশক্ত করেছে।

ভুমজাইতাই পার্টি রয়েছে তৃতীয় স্থানে, যারা তাইল্যান্ডে গাঁজা বৈধকরণের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের সদস্য হিসাবে ভুমজাইতাই পার্লামেন্টে প্রায় ৭০টি আসন অর্জন করতে পারে। ২০১৪ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুত চান-ও-চা-র নেতৃত্বে ইউনাইটেড তাই নেশন পার্টি ৩৬টি আসন লাভ করে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। প্রায়ুতের প্রাক্তন দল পালং প্রচারথ প্রায় ৪০টি আসনে জয়লাভ করে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।

বহু ভোটার প্রায়ুত চান-ও-চা প্রশাসনের প্রতি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং বৃহত্তর দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা এবং গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি সম্মান জানানোর দাবি করেছেন।

তাইল্যান্ডের জটিল রাজনৈতিক গতিশীলতা এবং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের আকাঙ্ক্ষার কারণে নির্বাচনটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই খুব নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষিত হয়েছে।

পরিবর্তনের চালিকাশক্তি

রাজনৈতিক সংস্কারের দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা নির্বাচনকে রূপদানকারী প্রধান কারণগুলির অন্যতম। বহু ভোটার প্রায়ুত চান-ও-চা প্রশাসনের প্রতি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং বৃহত্তর দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা এবং গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি সম্মান জানানোর দাবি করেছেন। তাঁরা সাংবিধানিক সংশোধনী, দুর্নীতি মোকাবিলা, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য মোকাবিলা এবং মানবাধিকার সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার মতো ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন।

প্রগতিশীল মুভ ফরওয়ার্ড পার্টি (এমএফপি) নির্বাচনে একটি বিশিষ্ট শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রাজনীতিবিদদের একটি তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে এমএফপি সাহসী সংস্কারের পক্ষে সমর্থন জানায়, যার মধ্যে রয়েছে রাজতন্ত্রের ভূমিকা পুনর্নির্ধারণ, সামরিক প্রভাব হ্রাস, সংবিধান পুনর্লিখন এবং বাধ্যতামূলক নিয়োগের অবসান। এই বিষয়গুলির উপর দলটির মনোনিবেশ তরুণ ভোটারদের মধ্যে দৃঢ়ভাবে অনুরণিত হয়, যাঁরা অধীর আগ্রহে পরিবর্তন এবং দেশের জন্য আরও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির অপেক্ষা করছেন।

এমএফপি-র নেতা পিটা লিমজারোয়েনরাতের মতে, একটি জোটেরও সম্ভাবনা রয়েছে। এই জোট পাঁচটি প্রাক্তন বিরোধী দল এবং একটি নবগঠিত দলকে একত্র করবে, যার ফলে তাদের সদস্যসংখ্যা হবে মোট ৩০৯ জন। সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পিটা একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রস্তুত। স্বচ্ছতা বাড়ানোর জন্য এবং তাদের নির্বাচনী প্রচারের সময়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট দলগুলি একটি সমঝোতাপত্র (মউ) তৈরি করতে চায়। এই চুক্তি শুধু মাত্র নিজেদের মধ্যে নয়, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য দায়বদ্ধতা এবং স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার জন্য একটি কাঠামো হিসেবে কাজ করবে।

সম্মুখে অনিশ্চয়তার পথ

তাইল্যান্ডের পার্লামেন্ট এবং সংবিধান তাইল্যান্ডে রাজনৈতিক পরিসর সংজ্ঞায়িত করতে এবং প্রশাসনিক গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০১৭ সালে গৃহীত বর্তমান সংবিধানটি তাই পার্লামেন্টের কাঠামো এবং গঠনে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। এই সংবিধানের অধীনে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস এবং সেনেটের সমন্বয়ে তাইল্যান্ড একটি দ্বিকক্ষ ব্যবস্থার অধীনে কাজ করে।

হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ৫০০টি আসন নিয়ে গঠিত, যেখানে সদস্যরা মিশ্র সদস্যের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এই আসনগুলির মধ্যে ৩৫০টি নির্বাচনকেন্দ্রভিত্তিক ভোটের মাধ্যমে বরাদ্দ করা হয়, বাকি ১৫০টি আসন দলীয় তালিকা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে বণ্টন করা হয়। হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস উল্লেখযোগ্য আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখে এবং তা আইন অনুমোদন ও সরকারি নীতিগুলির যাচাই-বাছাইয়ের জন্য দায়বদ্ধও।

স্বচ্ছতা বাড়ানোর জন্য এবং তাদের নির্বাচনী প্রচারের সময়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট দলগুলি একটি সমঝোতাপত্র (মউ) তৈরি করতে চায়।

তবে এত কিছু সত্ত্বেও তাই পার্লামেন্টে সেনেটের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কারণ এটি প্রতিনিধি পরিষদের ক্ষমতার উপর নজরদারি চালানোর কাজ করে। সেনেট ২৫০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত, যাঁরা সরাসরি জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হন না। তার পরিবর্তে তাঁরা সামরিক, বিচার বিভাগ এবং পেশাদার সংস্থা-সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা দ্বারা নিযুক্ত হন। এই গঠনব্যবস্থা বিতর্ক এবং সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। কারণ এটিকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার উপর সামরিক প্রভাব বিস্তারের একটি উপায় হিসাবে দেখা হয়েছে।

তাই পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বিশেষ করে সেনেটর নিয়োগের ক্ষেত্রে স্পষ্ট। সামরিক প্রশাসনের সময় খসড়া করা ২০১৭ সালের সংবিধান নিয়োগ প্রক্রিয়ার উপর সামরিক বাহিনীকে উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা প্রদান করে। হুনতা নিযুক্ত ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর পিস অ্যান্ড অর্ডার (এনসিপিও), যা ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের মধ্যে তাইল্যান্ড শাসন করেছিল, সেটি সেনেটরদের একটি অংশকে বেছে নিয়েছে। এটি নিয়োগ প্রক্রিয়ার ন্যায্যতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, এবং সমালোচকদের মতে, এটি প্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসনের গণতান্ত্রিক নীতিগুলিকে ক্ষুণ্ণ করে।

২০১৯ সালের জুলাই মাসে নতুন মন্ত্রিসভা উদ্বোধনের পরে এনসিপিও আনুষ্ঠানিক ভাবে ভেঙে দেওয়া হলেও এর নিজস্ব ক্ষমতা ইন্টারনাল সিকিউরিটি অপারেশনস কমান্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল, যা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর অধীনস্থ।

সংবিধান সংশোধন এবং সামরিক প্রভাব হ্রাস করার প্রচেষ্টা রক্ষণশীল শক্তির প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে, যার মধ্যে সামরিক সমর্থিত সংস্থাও রয়েছে। এই প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বিরোধী দল এবং গণতন্ত্রপন্থী কর্মীরা আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য সাংবিধানিক সংস্কারের পক্ষে সওয়াল করেছেন। নতুন জোট গঠন এই পরিবর্তনটি অর্জন করতে সক্ষম হবে কি না, তা অবশ্য সময়ই বলবে।

ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি

সেনেট দ্বারা গঠিত জোটের সম্ভাব্য প্রত্যাখ্যান সংক্রান্ত উদ্বেগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে – যে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য ৩৭৬টি ভোটের প্রয়োজন –  লিমজারোয়েনরাত আস্থা প্রকাশ করেন এবং এ হেন উদ্বেগকে সমূলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন যে, তাঁদের দল সেনেটের  বিরোধিতা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন যে তাঁরা জনগণের কাছ থেকে একটি স্পষ্ট জনমত অর্জন করেছেন। পিটার মতে, দলের আস্থা এই বিশ্বাস থেকেই উদ্ভূত হয় যে, সেনেট জনগণের ইচ্ছার সঙ্গে সম মনোভাব পোষণ করবে এবং তাদের জোট গঠনকে সমর্থন করবে।

সংবিধান সংশোধন এবং সামরিক প্রভাব হ্রাস করার প্রচেষ্টা রক্ষণশীল শক্তির প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে, যার মধ্যে সামরিক সমর্থিত সংস্থাও রয়েছে।

একই ভাবে লেসে-ম্যাজেস্তে নামে পরিচিত তাই ফৌজদারি বিধির সবচেয়ে বিতর্কিত ধারা ১১২ সংশোধন করার বিষয়ে – যার মধ্যে এই বিধান রয়েছে যে কেউ যদি রাজতন্ত্রের মানহানি বা অপমান করে, কিংবা হুমকি দেয়, তাহলে যথাযথ বিচার বা নোটিশ ছাড়াই তা্র ৩-১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে – পিটা বলেছেন যে এই নিয়ম সংশোধন করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।

বিদেশনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে একটি নতুন সরকারে পিটা ও স্রেথার মতো সুশিক্ষিত ও সম্মানিত নেতার অন্তর্ভুক্তি তাইল্যান্ডের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে। এই পরিবর্তনগুলি মানবাধিকার ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে পারে এবং তাইল্যান্ডের মধ্যে আন্তর্দেশীয় অপরাধী নেটওয়ার্কগুলির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে পারে৷ ফেউ তাই এবং এমএফপি উভয়েই তাইল্যান্ডের ৫জি অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করা, সরকারি খাতে ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত অভিযোজন এবং ডিজিটাল অর্থনীতির সুবিধাগুলিকে কাজে লাগানোর জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলিকে সমর্থন করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। তাইল্যান্ড এই বিষয়ে চিনের হুয়াই টেকনোলজির সঙ্গে সহযোগিতা করলেও নির্বাচনের ফলাফল এবং নেতৃত্বের সম্ভাব্য পরিবর্তন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তাইল্যান্ডের সঙ্গে সহযোগিতা করা এবং আঞ্চলিক ডিজিটাল পরিকাঠামো ও গুণমান গঠনে অবদান রাখার একটি নতুন সুযোগ প্রদান করে।

তবে এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, নবনির্বাচিত নেতাদের প্রতিশ্রুতি এবং উদ্দেশ্যগুলি সম্ভাব্য বিদেশনীতি পরিবর্তনের মঞ্চ তৈরি করলেও প্রকৃত বাস্তবায়ন এবং ফলাফল এখনও পরিলক্ষিত হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতা, কূটনৈতিক বিবেচনা এবং বিভিন্ন স্বার্থের ভারসাম্য আগামী বছরগুলিতে তাইল্যান্ডের বিদেশনীতির গতিপথকে রূপ দেবে।


শ্রীপর্ণা ব্যানার্জি অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের জুনিয়র ফেলো।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.