Author : Harsh V. Pant

Published on Jul 09, 2022 Updated 0 Hours ago

সূচনার প্রথম দিন থেকেই ব্রিকস জটিলতাপূর্ণ। ভারতের উচিত নিজের অগ্রাধিকারগুলির উপরে জোর দেওয়া।

সমন্বয় না কি জট? ব্রিকস সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ

গত মাসে চিনের সভাপতিত্বে ব্রিকস বিদেশমন্ত্রীদের ভার্চুয়াল সমাবেশে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জোর দিয়ে বলেন যে, ‘ব্রিকস বরাবর সার্বভৌম সাম্য, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছে’ এবং মঞ্চটিকে অবশ্যই ‘তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে।’ এক কথায় বলতে গেলে এই মাসের শেষে ১৪ তম শীর্ষ নেতৃত্বের সমাবেশ আয়োজন করতে চলা ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার (ব্রিকস) সামনে এটিই অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। ভারতের সঙ্গে সাধারণ সীমান্ত বরাবর আগ্রাসন-সহ এক দিকে চিন যখন তার পরিধির চারপাশের স্থিতাবস্থাকে টানাপড়েনের মুখে ফেলেছে এবং অন্য দিকে যখন রাশিয়া ইউক্রেনের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব দেখাচ্ছে, তখন যৌথ মঞ্চটির ভিত্তিমূলক আদর্শগুলি মেনে চলা সদস্য দেশগুলির জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। পাশ্চাত্যচালিত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দৃষ্টান্তের বিকল্প রূপে যে যৌথ মঞ্চ গঠিত হয়েছিল, সেই জোটেরই দুই সদস্য দেশের দুর্বলতর দেশগুলির সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে পদপিষ্ট করার ঘটনা ধীর লয়ে হলেও নিশ্চিত ভাবেই এই নবজাতক জোটটিকে অকার্যকর করে তুলবে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সূচনার মুহূর্ত থেকেই ব্রিকস একটি জটিল উদ্যোগ রূপে প্রমাণিত হয়েছে। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং বা বিনিয়োগ সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞাপনী স্লোগান, যা আস্তে আস্তে একটি ভূ-রাজনৈতিক জোটে বিবর্তিত হয় এবং উদ্যোগটির প্রথম দিন থেকেই বলপূর্বক পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারটি স্পষ্ট। রাশিয়া-ভারত-চিন ত্রিপাক্ষিক জোটটি ১৯৯০-এর দশকের গোড়া থেকেই কার্যকর ছিল এবং তার প্রধান লক্ষ্য ছিল আমেরিকার বিদেশনীতির একক মেরুকরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আমেরিকার আধিপত্যের বিরোধিতা এবং এক ন্যায়সঙ্গত বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই দেশগুলি জোটবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু ২০০০-এর দশকে চিন, ভারত এবং রাশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশগুলির ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই সময়ে ব্রাজিলকেও এক উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। সেই সূত্রেই ব্রাজিল জোটটির অংশ হয়ে ওঠে। মঞ্চটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাঁচটি সদস্য দেশের মধ্যে ব্যাপক অসমতা এবং দ্বিপাক্ষিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক প্রশাসনের কয়েকটি অভিন্ন আদর্শের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা দেশগুলিকে একজোট থাকতে সাহায্য করেছিল।

ভারতের সঙ্গে সাধারণ সীমান্ত বরাবর আগ্রাসন-সহ এক দিকে চিন যখন তার পরিধির চারপাশের স্থিতাবস্থাকে টানাপড়েনের মুখে ফেলেছে এবং অন্য দিকে যখন রাশিয়া ইউক্রেনের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব দেখাচ্ছে, তখন যৌথ মঞ্চটির ভিত্তিমূলক আদর্শগুলি মেনে চলা সদস্য দেশগুলির জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।

বর্তমানে ব্রিকস-এর দুই সদস্য দেশের কার্যকলাপের ফলে এই আদর্শগুলি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। তাই নয়াদিল্লির উচিত বাকি সদস্য দেশগুলিকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, মঞ্চটির প্রধান আদর্শগুলির প্রতি আনুগত্যই মঞ্চটির সাবলীল কার্যকারিতার প্রধান চাবিকাঠি। এই আদর্শগুলি লঙ্ঘিত হলে ব্রিকস-এর সম্মুখে উপস্থিত চ্যালেঞ্জগুলি তীব্র আকার ধারণ করবে।

গত মাসে তাঁর বক্তব্য রাখার সময়ে জয়শঙ্কর স্পষ্ট ভাবে এই সমস্যাগুলির কথা তুলে ধরেন। তাঁর এ হেন মন্তব্য যে, ব্রিকস সদস্য দেশগুলির ‘শুধু মাত্র কোভিড অতিমারির প্রভাব থেকে আর্থ-সামাজিক পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালানোই নয়, স্থিতিস্থাপক এবং নির্ভরযোগ্য সরবরাহ শৃঙ্খল গড়ে তোলাও উচিত’ বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক সঙ্কটকেই প্রতিফলিত করে। বিশ্ব সরবরাহ শৃঙ্খলে চিনের আধিপত্য এক ভারসাম্যহীন এবং একমুখী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে ভারত-সহ অন্যান্য অনেক দেশই একটি নির্দিষ্ট দেশের উপরে অতি নির্ভরতা কমাতে এই সরবরাহ শৃঙ্খলগুলির পুনর্বিন্যাসে তৎপর হয়েছে। কোভিড অতিমারি যদি ভারতকে অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানির জন্য চিনের উপরে অতিরিক্ত নির্ভরতার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে থাকে, তা হলে ইউক্রেন সঙ্কট প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে রাশিয়ার উপরে অতিরিক্ত নির্ভরতা ভারতের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করেছে।

ইউক্রেন সঙ্কটের ফলে জ্বালানি, খাদ্য এবং অন্যান্য পণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টির উপরেও জয়শঙ্কর জোর দিয়েছেন। ব্রিকস-এর মতো একটি মঞ্চের জন্য এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ব্রিকস গঠনের প্রধান লক্ষ্যই ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলির কথা তুলে ধরা। অরক্ষিত দেশগুলির অধিকাংশই রুশ আগ্রাসনের প্রভাবে জর্জরিত। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সঙ্কট এবং ইউক্রেনের বন্দরে সরবরাহকৃত শস্যের আটকে পড়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রধান ম্যাকি সল সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উদ্দেশে বলেন, তাঁকে ‘এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে যে, আমাদের দেশগুলি যুদ্ধের মঞ্চ থেকে অনেকটা দূরে অবস্থিত হলেও যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক স্তরে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।’ সদস্য দেশগুলির একজন এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী হলেও ব্রিকসকে বিষয়টি সম্পর্ক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

শুরুর দিন থেকেই ব্রিকস কর্মসূচির একটি বড় অংশ ছিল আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার সংশোধন সংক্রান্ত। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই প্রচেষ্টা পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে। জয়শঙ্কর মঞ্চটির সঙ্গে যুক্ত সকলকে মনে করিয়ে দেন যে, ব্রিকস-এর উচিত বিশেষ ভাবে এবং সর্বসম্মত ভাবে ইউনাইটেড নেশনস সিকিউরিটি কাউন্সিলের (ইউ এন এস সি) সংস্কারকে সমর্থন করা। ভারতের জন্য এটি তার বিদেশনীতির অগ্রাধিকারকে দর্শালেও চিন ও রাশিয়ার জন্য এটি আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কি না, তা স্পষ্ট নয়। বিশেষত চিন ইউ এন এস সি-তে ভারতের প্রবেশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করার পুরোভাগে রয়েছে। চিন আন্তর্জাতিক স্তরে সংশোধনবাদী শক্তি রূপে নিজেকে তুলে ধরলেও ইউ এন এস সি-র ক্ষেত্রে সে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে। এমনটা করার মাধ্যমে সে ইউ এন এস সি-তে ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতাসম্পন্ন এক মাত্র এশীয় শক্তি রূপে নিজের অবস্থান বজায় রাখতে চায়। ইউ এন বা রাষ্ট্রপুঞ্জে সংস্কারের অভাব নিয়ে নয়াদিল্লি ক্রমশ অধৈর্য হয়ে পড়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কোনও প্রামাণিক সংস্কারের কাজ না হওয়ার বিষয়টি দর্শিয়ে ভারত ইউ এন-এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কী ভাবে ব্রিকস একটি মঞ্চ হিসেবে এই টালমাটাল পরিস্থিতি সামলাবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

চিন আন্তর্জাতিক স্তরে সংশোধনবাদী শক্তি রূপে নিজেকে তুলে ধরলেও ইউ এন এস সি-র ক্ষেত্রে সে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে। এমনটা করার মাধ্যমে সে ইউ এন এস সি-তে ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতাসম্পন্ন এক মাত্র এশীয় শক্তি রূপে নিজের অবস্থান বজায় রাখতে চায়।

ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্রিকস মঞ্চে অংশগ্রহণ করা তাকে আন্তর্জাতিক প্রশাসনিক স্তরে আলোচনাকে আকার দিতে সাহায্য করবে এবং একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও নয়াদিল্লি তার স্বাধীনতা বজায় রাখতে সমর্থ হবে। তবুও আন্তঃব্রিকস ঐকমত্যের সীমাবদ্ধতা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ইউক্রেন সংঘাতের পর রাশিয়ার সঙ্গে চিনের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা মঞ্চটিতে ভারতের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণের পরিসরকে আরও সঙ্কুচিত করবে। চিন-ভারত সম্পর্কে উন্নতির কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। চিনকে লক্ষ্য করে জয়শঙ্কর সম্প্রতি এ কথা বলেন যে, ‘আমাদের (ভারতের) সীমান্তগুলিরও সুরক্ষা প্রয়োজন এবং আমরা কখনওই স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের কোনও একপাক্ষিক চেষ্টাকে বরদাস্ত করব না।’তিনি বেজিংকে সরাসরি একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন এই বলে যে, ‘প্রতিষ্ঠিত বোঝাপড়া থেকে সরে যাওয়া যে কোনও দৃষ্টিভঙ্গিই কিন্তু তার নিজস্ব প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে।’

চিন ইতিমধ্যেই মঞ্চটিকে একটি ব্রিকস প্লাস সংস্করণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং আর্জেন্টিনা, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্থান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, নাইজেরিয়া, সেনেগাল এবং তাইল্যান্ড এই প্রসারণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। মঞ্চটির চিন-ভারত কেন্দ্রস্থলটির অবক্ষয় এবং মঞ্চটিতে নতুন সদস্য দেশের যোগদান ব্রিকসকে এক অজানা পথে চালিত করেছে। সামনে চলার পথে ব্রিকস-এর সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জটি হল কার্যকর আন্তঃসহযোগিতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালানোর মাঝে সদস্য দেশগুলির পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সামাল দেওয়া। এটি একটি কঠিন কাজ এবং এমনটা করার জন্য নয়াদিল্লিকে তৎপর ও বাকপটু হতে হবে। এই মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হতে চলা শীর্ষ নেতৃত্বের সমাবেশ আগামী দিনে ভারতের অগ্রাধিকারের এক গুরুত্বপূর্ণ সূচক হতে চলেছে।


এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ‘ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস’-এ।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.