Published on Jul 06, 2022 Updated 0 Hours ago

অস্ট্রেলিয়ার বিদেশনীতি কি নতুন নেতৃত্বের অধীনে এক পরিবর্তনের ধারা লক্ষ করবে?

ওয়ং-এর নেতৃত্বে সশক্তিকরণ: অস্ট্রেলিয়ার বিদেশনীতির দায়িত্ব গ্রহণ

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে পেনি ওয়ং অস্ট্রেলিয়ার বিদেশমন্ত্রী পদে আসীন হলেন। দীর্ঘ ২০ বছর পার্লামেন্টের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টির এক জন বরিষ্ঠ সদস্য হওয়ার পাশাপাশি ওয়ং বিগত চার বছর যাবৎ বিদেশ বিষয়ে বিরোধী দলের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তিনি অতি পরিচিত মুখ। ওয়ং এবং নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানিজ উভয়েই গভর্নর জেনারেলের কাছে শপথ গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোয়াড শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে টোকিও রওনা হন। শেষ পর্যন্ত ওয়ং নিজের যোগ্য পদে বহাল হয়েছেন।

অস্ট্রেলিয়ায় সাম্প্রতিক নির্বাচন উভয় পক্ষের জন্যই সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন সরকারগুলির তুলনায় এক বৈচিত্র্যময় পার্লামেন্টের সূচনা করেছে। এক দিকে বিরোধী লেবার পার্টি যখন শুধু মাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসনেই জয়লাভ করতে সমর্থ হয়েছে, তখন অন্য দিকে ‘টিল’ জলবায়ু পরিবর্তনপন্থী নির্দল প্রার্থী, অন্য নির্দল  প্রার্থী এবং অস্ট্রেলিয়ান গ্রিনস-এর এক আন্দোলন লক্ষ করা গিয়েছে এবং তারা দীর্ঘ সময় ব্যাপী প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির দখলে থাকা আসনগুলি ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার (অধুনা প্রাক্তন) কোষাধ্যক্ষ জশ ফ্রেডেনবার্গের আসনটি উল্লেখযোগ্য। এই ক্রমবর্ধমান বৈচিত্র্যময় পার্লামেন্টের পাশাপাশি লেবার পার্টির এক দশকেরও বেশি সরকারি ক্ষমতায় না থাকার ঘটনা জল্পনাকে উস্কে দিয়েছে এবং বামপন্থী প্রশাসনের অধীনে অস্ট্রেলিয়ার বিদেশ নীতির সম্ভাব্য পরিবর্তন সম্পর্কে গুঞ্জন জোরালো হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার বিদেশনীতি নিয়ে সে দেশে রাজনীতিকরণ না হওয়া শুধু মাত্র অস্ট্রেলিয়ার জন্যই ভাল নয়, বরং তা ইন্দো-প্যাসিফিক ও অন্যান্য অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার অংশীদার দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখেও ইতিবাচক এক ঘটনা।

অস্ট্রেলিয়ার বিদেশনীতি সম্পর্কে যে কথাটি সকলের আগে বোঝা প্রয়োজন, সেটি হল যে, অস্ট্রেলিয়ার বিদেশনীতি প্রধানত দ্বিদলীয়। ওয়ং এবং মারিস পেইন-এর (মরিসন সরকারের অধুনা প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী) মধ্যে একটি নির্বাচনী বিতর্ক চলাকালীন এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায়। দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই শান্ত ভাবে রাষ্ট্রের কর্মক্ষমতা, বাজেট এবং নেতৃত্ব সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করেন। চিনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া কী ভাবে তার সম্পর্ক বজায় রেখেছে… এ হেন বিতর্কিত বিষয়গুলি নিয়ে তাঁরা বিতর্কে অংশগ্রহণ করলেও তাঁদের মধ্যে কখনওই সৌজন্যের অভাব দেখা যায়নি। অস্ট্রেলিয়ার বিদেশনীতি নিয়ে সে দেশে রাজনীতিকরণ না হওয়া শুধু মাত্র অস্ট্রেলিয়ার জন্যই ভাল নয়, বরং তা ইন্দো-প্যাসিফিক ও অন্যান্য অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার অংশীদার দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখেও ইতিবাচক এক ঘটনা। এটিকে চাইলে অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থার এক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

অন্য দিকে অস্ট্রেলিয়ার বিদেশনীতির প্রধান সমস্যাগুলি অপরিবর্তিত থেকেছে। যে সকল অনুমানকারী ও সাংবাদিকরা চিনের ক্ষমতা খর্ব করার দিকে চেয়ে রয়েছেন, তাঁদের নজরে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান পরিবর্তিত হবে না। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজের প্রভাব বিস্তারকারী আগ্রাসী চিনের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া তার উদ্বেগ প্রকাশ করা থামাবে না। আমরা দক্ষিণ চিন সাগরের সামরিকীকরণ, সলোমন দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে চিনের নিরাপত্তা চুক্তি এবং সাইবার নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির মতো বিষয়গুলি সম্পর্কেও জানতে পারব। আমরা আশা করতে পারি যে, শুধু বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই নয়, কোয়াড এবং জি ২০-র মতো বহুপাক্ষিক মঞ্চগুলিতেও ভারতের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সুদৃঢ়করণ বজায় থাকবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র জোটসঙ্গী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপরে অস্ট্রেলিয়াকে গুরুত্ব দিতে দেখবে।

কিন্তু এ সব কিছু সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়ার বিদেশনীতি নির্ধারণ এবং কূটনীতির ভূমিকা সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আশা করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নতুন আলবানিজ সরকারের নিউজিল্যান্ডের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির তুলনা করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী আর্ডার্নের স্বতন্ত্র প্রগতিশীল রাজনীতি আন্তর্জাতিক স্তরে নিউজিল্যান্ডের প্রথম মহিলা আদিবাসী বিদেশমন্ত্রী নানাইয়া মাহুতা দ্বারা সম্পন্ন হয়ে থাকে। বিষয়গত দিক থেকে আর্ডার্ন জলবায়ু পরিবর্তনকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্যতম প্রধান সমস্যা রূপে বিবেচনা করেছেন এবং এটি তাঁর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও প্রতিফলিত হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশগুলির প্রতি আর্ডার্নের মনোভাবের সূক্ষ্ম তারতম্য লক্ষ্যণীয়। আর্ডার্ন দৃঢ় ভাবে মার্কিনপন্থী হলেও তিনি চিন-বিরোধীও নন। এই আর্ডার্ন- ঘরানার বিদেশনীতি আলবানিজ প্রশাসনের কাছেও আশা করা যেতে পারে।

এটি শুধু মাত্র অস্ট্রেলিয়ার বহুসাংস্কৃতিকতাবাদ উদযাপনের সূচনা নয়, বরং তাকে সকলের সামনে তুলে ধরবে। বিশ্বের একাধিক দেশ অস্ট্রেলিয়াকে এক নতুন আঙ্গিকে দেখতে শুরু করবে যেখানে দেশটি তার অ্যাংলো-ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হবে।

প্রথমত আলবানিজ দ্বারা মালয়েশিয়ায় জন্মানো পেনি ওয়ংকে বিদেশমন্ত্রকের দায়িত্বভার দেওয়া এক সঠিক সিদ্ধান্ত। কারণ ৫০ শতাংশেরও বেশি অস্ট্রেলীয়দের বাবা-মায়ের মধ্যে যে কোনও এক জন অস্ট্রেলিয়ার বাইরে জন্মগ্রহণ করেছেন। অস্ট্রেলিয়া একটি ফার্স্ট নেশনস ফরেন পলিসি রূপায়ণ করবে, যা পৃথিবীর প্রাচীনতম সচল সভ্যতার প্রতি ওয়ং-এর অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরে। ফার্স্ট নেশনসের জন্য এক জন রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ বিশ্বের দরবারে নিজেদের অনুশীলন, কণ্ঠস্বর এবং ঐতিহ্য উপস্থাপনের সুযোগ পাবেন। এটি শুধু মাত্র অস্ট্রেলিয়ার বহুসাংস্কৃতিকতাবাদ উদযাপনের সূচনা নয়, বরং তাকে সকলের সামনে তুলে ধরবে। বিশ্বের একাধিক দেশ অস্ট্রেলিয়াকে এক নতুন আঙ্গিকে দেখতে শুরু করবে যেখানে দেশটি তার অ্যাংলো-ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হবে।

দ্বিতীয়ত, ওয়ং-এর নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার বিদেশনীতিও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিগুলির সম্মুখীন হবে। এমনটা ইতিমধ্যেই কোয়াড শীর্ষ নেতৃত্বের সম্মেলনে দেখা যেতে পারে যেখানে আলবানিজ জলবায়ু পরিবর্তনকে ইন্দো-প্যাসিফিকের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ রূপে চিহ্নিত করেছেন। গত কয়েক মাসে ভারতের চরম আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’ হিসেবে চিহ্নিতকরণের সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী মোদী দ্বারা সমাদৃত হয়েছে।

তৃতীয়ত, অস্ট্রেলিয়ার কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও বদল আসতে চলেছে। ওয়ং টোকিওগামী বিমান ধরার আগে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে একটি ভিডিয়ো বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সেই ভিডিয়োয় ওয়ং নিজেকে একটি ‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় পরিবার’-এর অংশ হওয়ার কথা বলেন এবং এ-ও বলেন যে, অস্ট্রেলিয়া ‘(দ্বীপপুঞ্জের) সমস্যাগুলি শুনবে। কারণ আমরা প্রশান্ত মহাসাগরীয়দের বক্তব্য শোনার জন্য আগ্রহী।’ এই অপর পক্ষের কথা প্রথমে শোনার কূটনীতি প্রশান্ত মহাসাগরের সীমা অতিক্রম করে প্রসারিত হবে। এবং আমরা সম্পর্কের প্রতি এ হেন মনোভাব দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশের ক্ষেত্রেও আশা করতে পারি। ওয়ং ইতিমধ্যেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার উপরে সরকারের মনোযোগ বৃদ্ধির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর পাশাপাশি তিনি এ-ও স্পষ্ট করেছেন যে, দ্বিপাক্ষিক মুখ্য শক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতার উপরে মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে অস্ট্রেলিয়ার প্রচেষ্টার সীমানা আরও প্রসারিত করার উপরে জোর দেবেন।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নতুন আলবানিজ সরকারের কাছ থেকে অনেক কিছুই প্রত্যাশা করতে পারে। মৌলিক ভাবে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান পরিবর্তন হবে না। কিন্তু এই ঘটনা প্রবাহের ফলে আমরা দেখব, অঞ্চলটিকে এক নতুন আঙ্গিকে দেখা হচ্ছে। ইন্দো-প্যাসিফিক এবং অস্ট্রেলিয়ার অংশীদাররা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে যে রাজনীতির ধরন যেমনই হোক না কেন, ওয়ং আসলে এমন এক মানুষ, যাঁর দৃঢ় মনোভাবের উপর নির্ভর করা যেতে পারে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.