Published on Feb 13, 2024 Updated 0 Hours ago
তাইওয়ানের রায় এবং দিল্লি-তাইপে সম্পৃক্ততা

২০২৪ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি) প্রার্থী লাই চিং-তে-র (উইলিয়াম লাই) বিজয় উল্লেখযোগ্য কারণ এর আগে কোনও দলই টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। তুলনামূলক ভাবে নতুন দল পিপলস পার্টি অব তাইওয়ান ময়দানে নেমে নির্বাচনকে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিণত করার কারণে এই বছরের লড়াই ছিল হাড্ডাহাড্ডি।

বিভিন্ন কারণের সমন্বয়ের দরুন নির্বাচনটি এশিয়ায় অন্যতম ফলপ্রসূও বটেপ্রথমত, চিন এই দ্বীপটিকে তার একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ বলে মনে করে যেটিকে প্রয়োজনে সামরিক শক্তি দ্বারা চিনের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। ক্ষমতায় আসার পরপরই প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছিলেন যে, সার্বভৌমত্বের উপর অচলাবস্থা চিরতরে স্থগিত রাখা যাবে নাএই উক্তির মধ্যে তাঁর জমানায় সাত দশকের অচলাবস্থার অবসান ঘটানোর ইঙ্গিত ছিল। দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আইনের অধীনে দ্বীপটিকে রক্ষা করা এবং এটিকে প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র সরবরাহ করার দায়িত্ব আছে। তাইওয়ান দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটন-বেজিং সমীকরণে এক কাঁটা হয়ে দাঁড়ালেও বর্তমানে দুটি শক্তির মধ্যে নতুন করে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে দ্বীপটি নতুন করে নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। কর্তৃত্ববাদী চিনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের আলোকে তাইওয়ানের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা দ্বীপটিকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে এক গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন অংশীদার করে তুলেছে। সর্বোপরি বছরের পর বছর ধরে দ্বীপের বেশির ভাগ মানুষ নিজেদেরকে চিনের থেকে আলাদা অর্থাৎ তাইওয়ানিজ বলে পরিচয় দেন। প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত লাই দৃপ্ত কণ্ঠে তাইওয়ানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছেন এবং ডিপিপি-র চার্টার একটি নতুন সংবিধান তৈরি করা ও তাইওয়ানকে প্রজাতন্ত্ররূপে ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

 

কর্তৃত্ববাদী চিনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের আলোকে তাইওয়ানের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা দ্বীপটিকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে এক গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন অংশীদার করে তুলেছে।

 

চিন সাম্প্রতিক সময়ে তাইওয়ানের দিকে অগ্রসর হয়ে একটি বিস্তৃত আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে। চিন ২০২২ সালের অগস্ট মাসে 'দ্য তাইওয়ান কোয়েশ্চেন অ্যান্ড চায়না’জ রিউনিফিকেশন ইন দি নিউ এরা’ (‘তাইওয়ান প্রসঙ্গ ও নতুন যুগে চিনের সঙ্গে দ্বীপটির পুনঃসংযুক্তিকরণ’) শীর্ষক একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে, যেখানে চিন ডিপিপি-র স্বাধীনতার অন্বেষণকে সঙ্কট বৃদ্ধির জন্য দায়ী করেছে এবং জোর দিয়েছে যে, চিন দ্বীপটিকে সংযুক্ত করার জন্য ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে। প্রতিক্রিয়া হিসাবে, তাইওয়ান সামরিক পরিষেবার সময়কাল বৃদ্ধি করেছে, তার এফ-১৬ ফাইটার ফ্লিটের উন্নতি সাধন করছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও বেশি পরিমাণে অস্ত্র সংগ্রহ করছে। ২০২২ সালের অগস্ট মাসে তৎকালীন মার্কিন হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর বেজিংকে ক্ষুব্ধ করেছিল এবং চিন দ্বীপের কাছাকাছি সামরিক মহড়া দিয়ে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। অনুশীলনের সময় ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলি জাপানের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবতরণ করে, যা এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন একটি সম্প্রসারিত হুমকিরও জন্ম দেয়।

২০২৪ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে শান্তি ও সমৃদ্ধি, সংঘাত ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে একটি বিকল্প বেছে নেওয়ার নির্বাচন বলে অভিহিত করলেও চিন লাই-এর জয়ে ক্ষুব্ধ। ডিপিপি তাইওয়ানের নির্বাচনেফলাফলে মূলধারার মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে নাএ হেন প্রতিক্রিয়া জানানোর মাধ্যমে চিন অবশ্যম্ভাবী ভবিতব্যকে অস্বীকার করতে চেয়েছে এবং ঘোষণা করেছে যে, ডিপিপি-র বিজয় সত্ত্বেও চিন সংযুক্তিকরণের জন্য দ্বীপদেশটিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে ইচ্ছুক।

বাস্তব অর্থেই, লাই-এর সামনে পথ কণ্টকাকীর্ণ হতে পারে। নির্বাচনের দৌড়ে চিন অর্থনৈতিক জবরদস্তিমূলক শক্তির ব্যবহার করেছে। জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে চিন কিছু পেট্রোকেমিক্যাল পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করেছে, যা আন্তঃপ্রণালী বাণিজ্যিক চুক্তি ইকোনমিক কোঅপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের আওতাভুক্ত। চিন আন্তঃপ্রণালী চুক্তিকে খারিজ করতে পারে বা সম্পূর্ণ ভাবে বাতিল করে দিতে পারে। চিন তাইওয়ানের বৃহত্তম রফতানি বাজার হয়ে ওঠায় তা অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। চিন অ্যাপলের সরবরাহকারী ফক্সকনের বিরুদ্ধে একটি কর-তদন্ত শুরু করেছেকারণ সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা টেরি গৌ তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়াই করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ভবিষ্যতে দ্বীপের অন্যান্য ব্যবসায়ীও বেজিংয়ের রোষের মুখে পড়তে পারে। বেজিং দ্বীপের উপর রহস্যময় বেলুন উড়িয়ে এবং ডিপিপি রাজনীতিবিদদের বিষয়ে মানহানিকর ভিডিয়ো ছড়িয়ে দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিল লাই এগুলিকে সবচেয়ে গুরুতরহস্তক্ষেপ বলে বর্ণনা করেছেন। চিন যে লাইকে যেনতেনপ্রকারেণ সমস্যায় ফেলতে চায়, সে কথা সহজেই অনুমেয়।

 

চিন কিছু পেট্রোকেমিক্যাল পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করেছে, যা আন্তঃপ্রণালী বাণিজ্যিক চুক্তি ইকোনমিক কোঅপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের আওতাভুক্ত। চিন আন্তঃপ্রণালী চুক্তিকে খারিজ করতে পারে বা সম্পূর্ণ ভাবে বাতিল করে দিতে পারে।

 

যেহেতু লাই চিনের বাজারে তাইওয়ানের নির্ভরতা কমাতে আগ্রহী, তাই তা ভারতের জন্য একটি সুযোগের দরজা খুলে দেবে। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি তাইওয়ানের প্রযুক্তিগত ভিত্তি, দ্বীপদেশটির সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাগত অংশকে আঞ্চলিক সমন্বিতকরণের উন্নতির জন্য ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন, যা নিউ সাউথবাউন্ড পলিসিবা নতুন দক্ষিণমুখী নীতিতেই প্রকাশ পেয়েছিল। এই পদ্ধতিরই পরিপূরক হল ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি

লাই-এর পরিভাষায়, ভারতকে অবশ্যই বিদ্যমান কাঠামোকে কাজে লাগাতে হবে। প্রাথমিক ভাবে মানুষে মানুষে আদান-প্রদানই হল মূল বিষয়। ভারত তাইওয়ানের যুবকদের আরও বেশি সংখ্যক বৃত্তি প্রদান করতে পারে, যাঁরা যোগব্যায়াম এবং আয়ুর্বেদ শিখতে আগ্রহী তাইওয়ানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ভারতীয় ছাত্রদের জন্য শিক্ষার গন্তব্য হিসাবে বিপুল সম্ভাবনাময়।

কয়েক শতাব্দী আগে কিংবদন্তি চিনা সন্ন্যাসী জুয়ানজাং বৌদ্ধ শিক্ষার সন্ধানের জন্য ভারতে ভ্রমণ করেছিলেন বর্তমানে তাঁস্মারক তাইওয়ানের সান মুন লেকের একটি মন্দিরে রাখা আছে। তাইওয়ান ও ভারত তাইওয়ানের জুয়ানজাং মন্দির ও বোধগয়ার মতো ভারতের তীর্থস্থানগুলিকে ঘিরে একটি বৌদ্ধ পর্যটনচক্র প্রচারের দিকে মনোযোগ দিতে পারে। তাইওয়ানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ভারতের জন্য সুবিধার হতে পারে কারণ তাইওয়ান নিজের মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতকে প্রভাবিত না করে অসমাপ্ত পণ্য ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভারতে রফতানি করতে আগ্রহী। প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে ভারত তাইওয়ানের সিনচু সায়েন্স পার্কের সঙ্গে সহযোগিতা করলে উপকৃত হবে, যেটি দ্বীপের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের আঁতুড়ঘর।

দীর্ঘকাল ধরে, নয়াদিল্লি চিনকে ক্ষুব্ধ না করতে তাইওয়ানকে দূরেই সরিয়ে রেখেছেকিন্তু চিন এর বিনিময়ে ভারতীয় স্বার্থের উপরে ধারাবাহিক ভাবে আঘাত হেনেছে। তাইওয়ানের সঙ্গে তাই আরও সাহসী সম্পর্ক স্থাপন করে এ বার ভারতের নিজস্ব ঐতিহাসিক দ্বিধাঝেড়ে ফেলার সময় এসেছে।


এই প্রবন্ধটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান টাইমস-এ।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.

Authors

Harsh V. Pant

Harsh V. Pant

Professor Harsh V. Pant is Vice President – Studies and Foreign Policy at Observer Research Foundation, New Delhi. He is a Professor of International Relations ...

Read More +
Kalpit A Mankikar

Kalpit A Mankikar

Kalpit A Mankikar is a Fellow with Strategic Studies programme and is based out of ORFs Delhi centre. His research focusses on China specifically looking ...

Read More +