বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ সমস্ত অঞ্চলে তার প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু এর ফলাফল প্রকাশ্যে আসতে আরও বেশ কিছুটা সময় লাগবে। শেখ হাসিনা ওয়াজেদ সরকারের পতনের আগেই এই অঞ্চল একাধিক চ্যালেঞ্জের চাপে জর্জরিত ছিল। মনে করা হচ্ছে যে, ভারত ব্যতীত এই অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশের উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
পাকিস্তানের পরিস্থিতি বেশ কিছু দিন ধরেই যথেষ্ট সঙ্গীন। তালিবানের অধীনে থাকা আফগানিস্তান অনেক চেষ্টা করেও তার পারিয়া তকমা ঝেড়ে ফেলতে সফল হয়নি। নেপালে আপাতদৃষ্টিতে কখনওই শেষ না হওয়া রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে ক্লান্তির জন্ম দিয়েছে। মায়ানমার ক্রমশ এক ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। কারণ সামরিক হুন্তা এমন একগুচ্ছ অ-রাষ্ট্রীয় শক্তির কাছে তাদের পরিসর ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে, যারা বাস্তবে তাদের কার্যকলাপে সমন্বয় সাধন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এবং শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রভাব কোনও স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়াই রাজনৈতিক গতিপথকে আকার দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
নিজের পায়ের তলার মাটি হারাতে বসা সত্ত্বেও ওয়াজেদের অধীনস্থ বাংলাদেশ সবাইকে স্থিতিশীলতার মিথ্যা ধারণা প্রদান করছিল। বাংলাদেশ এবং সমগ্র অঞ্চলের জনগণ যখন ওয়াজেদ-পরবর্তী রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে, তখন জনপ্রিয় ও বুদ্ধিজীবীদের আখ্যানে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে। এটি বিশেষ ভাবে এমন এক সময়ে এই অঞ্চলে ভারতের অনুমিত ব্যর্থতার সঙ্গে সমাপতিত হচ্ছে যখন ভারতীয় নীতি নির্ধারকেরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠার পাশাপাশি নেতৃস্থানীয় আন্তর্জাতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
নিজের পায়ের তলার মাটি হারাতে বসা সত্ত্বেও ওয়াজেদের অধীনস্থ বাংলাদেশ সবাইকে স্থিতিশীলতার মিথ্যা ধারণা প্রদান করছিল।
এই বিতর্কের তিনটি দিক তুলে ধরা দরকার। প্রথমত, বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন নিশ্চিত করেছে যে ‘দক্ষিণ এশিয়া’ বলে আর কিছু নেই। কোনও এক সময়ে দক্ষিণ এশিয়া হয়তো ভূ-রাজনৈতিক আখ্যানের জন্য একটি মানসিক মানচিত্র ছিল। কিন্তু আজ এই ধরনের কৌশলগত মানচিত্রের আর কোনও অর্থ হয় না। ভারত এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলি এখন একটি বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিকের অংশ হয়ে উঠেছে। এটি এমন একটি ভৌগোলিক পরিসর, যা চিনের অভূবপূর্ব উত্থানের সাক্ষী থেকেছে এবং একই সঙ্গে অঞ্চলটি ভারতের উত্থান এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাশাপাশি বৃহত্তর প্যাসিফিক অঞ্চলের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ গড়ে তোলার নয়াদিল্লির প্রয়োজন সম্পর্কে অবগত। ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ থেকে চিন-ভারত দ্বৈরথে মনোযোগ স্থানান্তর এমন এক বাস্তবতা, যার সঙ্গে নয়াদিল্লিকে সংশ্লিষ্ট মূল্য ও সুযোগের নিরিখে মানিয়ে নিতে হবে। ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গে চিনের অংশীদারিত্ব এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলে তার ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এই সমীকরণেরই বহিঃপ্রকাশ। পুরনো দক্ষিণ এশিয়ায় আর ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলস্বরূপ, প্রধান শক্তিগুলির মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীক্ষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি ভারতের পরিধিকেও প্রভাবিত করবে। এর কিছু ওয়াজেদের পতনেও স্পষ্ট হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, নিজেরই পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে নয়াদিল্লির কেন্দ্রীয় ভূমিকা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু এই অঞ্চলে ভারতীয় আধিপত্যের স্বর্ণযুগ আগেও কখনও ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের অনুভূত আধিপত্যকে প্রতিবেশীরা চ্যালেঞ্জ করেছিল এবং পাকিস্তান এই বিরোধিতাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। ভারতের সঙ্গে সমতা সুনিশ্চিত করার বিষয়ে ইসলামাবাদের চরম উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার পতনকেই সুনিশ্চিত করেছে। ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশীও এই অঞ্চলে ভারতীয় প্রাধান্যের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। এমন এক সময়ও ছিল, যখন নয়াদিল্লি নিজের ইচ্ছা চরিতার্থ করতে সামরিক বা অর্থনৈতিক বলপ্রয়োগ করেছে এবং এটি প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভারতের অসুবিধায় পরিণত হয়েছিল। ১৫ বছর আগে ওয়াজেদ ক্ষমতায় আসার সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এতটাই খারাপ ছিল যে, তা উল্লেখ্য নয়। এমনকি তাঁর অধীনেও চিন ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা অংশীদার। ভারতীয় প্রতিবেশীদের ক্ষমতাকে কখনওই অবমূল্যায়ন করা উচিত নয় এবং এই অঞ্চল পরিচালনার ক্ষেত্রে নয়াদিল্লির ক্ষমতাকে কখনওই অতিমূল্যায়ন করা উচিত নয়।
চূড়ান্ত প্রেক্ষিতটি ভারতের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাবমূর্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। ভারতের সীমানার চারপাশে যখন অশান্তির আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে, তখন সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে ভারতের অক্ষমতা নয়, বরং সেই বহ্নিশিখা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার মধ্যেই ভারতের বিস্ময়কর সাফল্য লুকিয়ে রয়েছে। নয়াদিল্লি দেখিয়েছে যে, তার প্রতিবেশ থেকে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ভারতীয় বিদেশনীতি এবং এর সংশ্লিষ্ট ভাবমূর্তি কেবল শক্তিশালীই হয়েছে। এটিই ভারতীয় স্থিতিস্থাপকতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভারতের ৭৮তম স্বাধীনতা দিবসে উদযাপনের অন্যতম কারণ।
এই প্রতিবেদনটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় দ্য টেলিগ্রাফ-এ।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.