Author : Georgi Asatryan

Published on Jan 04, 2022 Updated 0 Hours ago

এক স্থিতিশীল এবং ন্যায্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে রাশিয়া এবং ভারতের মধ্যে মজবুত সম্পর্ক গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ যা পরিবর্তনশীল বিশ্ব ব্যবস্থার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

মহাশক্তিধর দেশগুলির গুরুত্বপূর্ণ সমতা বিধান

আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলি বিগত শতকগুলির মতোই মানবিক উপাদান দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত। বা ঐতিহাসিক উপমা ধার করে বললে ইতিহাসে এক জন মানুষের ভূমিকা দ্বারা। রাশিয়া এবং ভারত দুই দেশই বর্তমানে এমন দুজন নেতা দ্বারা পরিচালিত যাঁরা বিশ্বব্যাপী বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন এবং যাঁদের দক্ষ রাজনীতিক হিসেবে গণ্য করা হয়। পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়ন অবশ্যই দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি, নিও রিয়ালিজমের কাঠামোগত তত্ত্ব আমাদের বলে যে, পৃথিবীতে শক্তিগুলির মানবকৃত শ্রেণিবিন্যাসের তুলনায় বাস্তবের মতো গঠনগত উপাদানই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্ব অনুয়ায়ী সম্পর্কের সংজ্ঞা

ভারত একটি দেশ হিসেবে — যা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মানচিত্রে ১৯৪৭ সাল থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে পরিচিত — বিগত বছরগুলিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে এবং ক্রমশ একটি বিশ্বমানের শক্তি ও পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠেছে। ভারতের বিশিষ্টতা এবং ভূমিকা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর প্রভাব লক্ষ করা যেতে পারে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া জুড়ে এবং দূরপ্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যে। সর্বোপরি, কোনও কোনও সমাজবিজ্ঞানী ভারতকে পৃথিবীর গুটিকয়েক মহাশক্তিধর দেশগুলির মধ্যে একটি বলেও বিবেচনা করেন। অন্য দিকে রাশিয়া বরাবরই একটি সুসংহত সামরিক শক্তি হিসেবে পরিচিত, যে দেশে কৌশলগত সংস্কৃতির পাশাপাশি সামরিক এবং কূটনৈতিক পরম্পরাও বিদ্যমান। সোভিয়েত পরবর্তী সময়েও দূরপ্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যে মস্কোর অবস্থান এবং প্রভাব সর্বজনবিদিত। অর্থনৈতিক এবং জনতাত্ত্বিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

নিও রিয়ালিজমের কাঠামোগত তত্ত্ব আমাদের বলে যে, পৃথিবীতে শক্তিগুলির মানবকৃত শ্রেণিবিন্যাসের তুলনায় বাস্তবের মতো গঠনগত উপাদানই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

যদিও বিশিষ্টতা থাকা সত্ত্বেও দেশ দুটি এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ রূপে মহাশক্তিধর দেশে পরিণত হয়নি — যে খ্যাতি শুধু মাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনেরই আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ কথা মানতে হবে যে, ভারত এবং রাশিয়া উভয়েই এই লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি রয়েছে যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কথায় বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে বর্তমানে আঞ্চলিক মহাশক্তিগুলির অবস্থানের উন্নতি ঘটেছে। একাধিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে, তার প্রভাব পড়বে একাধিক দেশের উপরে, যা ভারত বা রাশিয়া কেউই এড়িয়ে যেতে পারবে না। আগামী দশকগুলিতে বেজিং এবং ওয়াশিংটনের সংঘাত আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে এবং এর ফলে ভালই মূল্য দিতে হবে। অন্য কয়েকটি প্রধান দেশ কিছুটা সাময়িক উপশম পেতে পারে যা তারা দেশের সার্বিক বৃদ্ধি এবং আধুনিকীকরণের কাজে লাগাতে পারবে।

রাশিয়া এবং ভারতের বিদেশনীতির ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক স্বাধীনতা — যা বর্তমান ভেঙে পড়া আন্তর্জাতিক অবস্থা এবং সম্পর্কের তুলনায় অস্বাভাবিক — দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ককে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে। কোনও দেশের বিদেশনীতি নির্ধারণের স্বাধীনতা খর্ব হলে তা দেশটির আত্মবিশ্বাস কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রভাব ফেলে। তবে দুই দেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নের পথ বিবেচনা করলে বোঝা যায়, অদূর ভবিষ্যতে এমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিশালী দেশগুলিকে নিয়ে আলোচনা করছি এবং তাদের পক্ষে কোনও মতেই বর্তমান সময়ের মহাশক্তিধর দেশগুলির উপরে নির্ভরশীল হওয়া সম্ভব নয়। সর্বোপরি আমেরিকা-চিন দ্বৈরথের বাস্তব চিত্র এবং তীব্রতা সত্ত্বেও রুশ-ভারত সম্পর্ক এমন এক শক্তি হয়ে উঠতে পারে যা ইউরেশিয়া এবং সম্ভবত সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করে তুলতে সক্ষম।

ভারতরুশ ম্পর্কপটভূমিকা

রুশ-ভারত সম্পর্কের শুরু সেই সপ্তদশ শতাব্দীতে এবং বিগত শতকগুলিতে আমরা এই পারস্পরিক সম্পর্কের আরও অগ্রগতি দেখেছি। ইউ এস এস আর এবং ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক চুক্তি স্থাপিত হয় ১৯৪৭ সালে। ইউ এস এস আরের পতন এবং তা ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে ২৫০টিরও বেশি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেগুলির মধ্যে ১৯৯৩ সালের ২৮ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত দ্য ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড কো-অপারেশন ট্রিটি (বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি) এবং ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফরের সময়ে স্বাক্ষরিত ডিক্লারেশন অন দি ইন্ডিয়া-রাশিয়া স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ (ভারত-রাশিয়া কৌশলগত অংশীদারিত্বের ঘোষণা) দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটির ভিত্তিপ্রস্তর স্বরূপ। দ্বিপাক্ষিক আলোচনাগুলিকে কৌশলগত অংশীদারিত্ব রূপে দেখা যেতে পারে এবং পরবর্তী কালে পর্যবেক্ষকরা এই অবস্থানের প্রেক্ষিতে বিশেষ সুবিধে বা অধিকারের কথাটি ব্যবহার করতে শুরু করেন।

আমেরিকা-চিন দ্বৈরথের বাস্তব চিত্র এবং তীব্রতা সত্ত্বেও রুশ-ভারত সম্পর্ক এমন এক শক্তি হয়ে উঠতে পারে যা ইউরেশিয়া এবং সম্ভবত সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করে তুলতে সক্ষম।

ফলে এই দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত এবং এই সম্পর্কের ভিত্তি হল পরস্পরের সাধারণ স্বার্থ রক্ষা এবং সহযোগিতা। এই অংশীদারিত্ব এক দৃঢ়, ন্যায়সঙ্গত ভিত্তির উপরে স্থাপিত। এ হেন পরিস্থিতিতে কোনও পক্ষই নিজেকে বঞ্চিত মনে করে না এবং পারস্পরিক সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়ার দিকটি বোঝা হয়ে ওঠে না। সাধারণত পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত নয়, হিসেবি মানসিকতা কাজ করে। আই আর থিওরি এবং স্ট্রাকচারাল রিয়্যালিজমের সমর্থকেরা এই সব ধারণা এবং বিষয়ের উপরে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আধুনিক পৃথিবীর পরিকাঠামোর প্রেক্ষিতে এই অংশীদারিত্ব আত্মনির্ভর। আমরা যদি দুটি পৃথক দেশ, তাদের ভিন্ন অধিবাসী, ভিন্ন সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং তাদের ইতিহাসের কথা ভাবি, তা হলেও সাধারণ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিকাঠামোর প্রেক্ষিতে তারা পারস্পরিক সমন্বয় সাধনে আগ্রহী হবে। স্ট্রাকচারাল ডিজাইন বা গঠনগত নকশার এটিই মূল সূর। বহু আন্তর্জাতিক শক্তিকে প্রায়শই ভুয়ো সামাজিক সমন্বয় গড়ে তুলতে হয় যেগুলি তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রসার, কৌশলগত সমন্বয় সাধন এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজে লাগে। যদিও মস্কো এবং নয়াদিল্লির এ রকমটা করার প্রয়োজন হবে না কারণ তাদের সম্পর্ক ইতিমধ্যেই দেশ দুটির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা এবং ভাল রসায়নের সুবাদে যথেষ্ট শক্তিশালী।

বিবিধ ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইতিপূর্বে মাত্র কয়েক বারই আন্তর্জাতিক সফরে গিয়েছেন। এর পাশাপাশি দুই দেশই ২ + ২ গঠনপ্রণালীর কথা ঘোষণা করেছে যা দুই দেশের প্রতিরক্ষা এবং বিদেশ মন্ত্রকের মধ্যে আঁটোসাঁটো সমন্বয় ব্যবস্থা তুলতে সাহায্য করেছে। বিশ্বব্যাপী অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াই থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং সামরিক প্রযুক্তি সমন্বয় সর্ব ক্ষেত্রেই রুশ-ভারতীয় জোট উচ্চ স্তরের সাফল্য পেয়েছে, তবুও এই সম্পর্কে এখনও উন্নতি সম্ভব। এই কারণে উভয় পক্ষই ভারতের মাটিতে স্পুটনিক ৫ টিকা প্রস্তুত করতে সহমত হয়েছে যেটি অন্য স্বীকৃত উদ্যোগগুলির একটি। পাশাপাশি ভারত সেই বিরল দেশগুলিরও অন্যতম যেখানে একই সঙ্গে দুটি জাতীয় টিকাকরণের কাজ সম্ভব হয়েছে- কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাক্সিন।

বহু আন্তর্জাতিক শক্তিকে প্রায়শই ভুয়ো সামাজিক সমন্বয় গড়ে তুলতে হয় যেগুলি তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রসার, কৌশলগত সমন্বয় সাধন এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজে লাগে।

বিগত বছরগুলিতে অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতা দুইই বৃদ্ধি পেয়েছে, তবুও এগুলি তাদের প্রকৃত সম্ভাবনা অর্জন করা থেকে অনেকটাই দূরে আছে। দুই দেশের বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ প্রতি বছর প্রায় ১০০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ওঠা-নামা করে। দূর প্রাচ্যের রুশ অর্থনীতিতে এক মুখ্য বিনিয়োগকারী হয়ে ওঠার ইচ্ছা এবং ক্ষমতা দুইই ভারতের আছে। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাশিয়ার ভ্লাদিভস্তক সফর এক নতুন ভারতীয় কৌশলের নিবন্ধীকরণের সূচনা করে। ‘অ্যাক্ট ইন দ্য ফার ইস্ট’ বা দূর প্রাচ্যে বিনিয়োগ করা জরুরি যেখানে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যিক সহযোগিতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সম্প্রতি গুজরাট রাজ্য সরকার রাশিয়ার সুদূর পূর্বের গভর্নরদের ২০২২ সালের ভাইব্র্যান্ট গুজরাত ইনভেস্টর সামিট-এ অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ভারতের পশ্চিমের এই অঞ্চল প্রধানমন্ত্রী মোদীর জন্মস্থান এবং এটি ভারতীয় অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুই পক্ষই বর্তমানে উত্তর-দক্ষিণ পরিকাঠামো নির্মাণ কর্মসূচি এবং উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ভ্লাদিভস্তক-চেন্নাই সামুদ্রিক সংযোগ পথকে প্রশস্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সহযোগিতার পরিমাণ ৩,০০০ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত করাই বর্তমানে অন্যতম লক্ষ্য। আঞ্চলিক মহাশক্তিগুলিও উল্লেখযোগ্য শক্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। রাশিয়া ভারতকে তেলের জোগান দেবে যা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে গভীর এবং মজবুত করবে।

রুশ সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত নিকোলে কুদাশেভ জানিয়েছেন যে, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও রাশিয়ার সুদূর পূর্বের ফেডারেল জেলাগুলির সঙ্গে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৫%-এরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ৭৬ কোটি ৪০ লক্ষ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে এবং রাশিয়ার আর্কটিক অঞ্চলের রাজ্যগুলির সঙ্গে ভারতীয় অংশীদারদের বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ ১২.৬% বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও রসনেফট, গাজপ্রমনেফট এবং সাইবুরের মতো সংস্থাগুলিও ভারতীয় অংশীদারদের সঙ্গে একাধিক প্রকল্পে ব্রতী হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়া সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতকে ৬৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল্য সামরিক অস্ত্রের জোগান দিয়েছে।

সামরিক প্রযুক্তি সমন্বয় দ্বিপাক্ষিক আলোচনার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে চলেছে। ভারতে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের কথায়, ‘এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ভারতীয় সেনার ব্যবহৃত ৬০%-৭০% অস্ত্র সোভিয়েত এবং রাশিয়ায় উৎপাদিত।’ স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় নৌবহরের দ্বারা ব্যবহৃত ৮০% অস্ত্রশস্ত্র এবং ভারতীয় বায়ুসেনার ৭০% অস্ত্র রাশিয়ায় নির্মিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়া সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতকে ৬৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমতুল্য সামরিক অস্ত্রের জোগান দিয়েছে। দ্য ডিপ্লোম্যাটের তথ্য অনুযায়ী, উভয় দেশই এ কে ২০৩ অ্যাসল্ট রাইফেলের আইনি নির্মাণের বিষয়ে সমন্বয় সাধনে তৎপর হয়েছে। রাশিয়ার সরকারি সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে যে, রাশিয়া এবং ভারত একাধিক দ্বিপাক্ষিক কর্মসূচিতে যৌথ ভাবে কাজ করছে যেগুলির মধ্যে ব্রাহমোজ কমপ্লেক্স, পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান বানানোর কাজে সমন্বয় সাধন, অনুমতিপ্রাপ্ত উড়োজাহাজ এবং ট্যাঙ্ক নির্মাণ উল্লেখযোগ্য। ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ টুইটারে জানান যে, ভারত ছোট অস্ত্র নির্মাণ এবং সামরিক সমন্বয় সংক্রান্ত একাধিক চুক্তিপত্র, প্রোটোকল এবং সমন্বয় সংক্রান্ত নথি স্বাক্ষর করেছে। পাশাপাশি এ কথাও জানা গিয়েছে যে, বছর শেষ হওয়ার আগেই ভারত এস-৪০০ সিস্টেমের প্রথম ডিভিশন পেতে চলেছে।

আফগানিস্তান এবং সন্ত্রাসবাদের দমন

প্রতিরক্ষা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা এবং আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক অবস্থা… এ সবই এই মুহূর্তে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয়। দুই দেশের প্রেসিডেন্টই ২০২১ সালের গ্রীষ্মে ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি স্থায়ী আলোচনার পদ্ধতি গঠনের পক্ষে মত দেন, যেটি দুই দেশের জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা নিকোলাই পাত্রুশেভ এবং অজিত ডোভাল দ্বারা পরিচালিত হবে। রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের মতে, ভারত আনুষ্ঠানিক ভাবে আফগানিস্তান সংক্রান্ত মস্কো ফরম্যাট অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা পরিষদের সচিব নিকোলাই পাত্রুশেভও দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সুরক্ষা বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছেন। আফগান সংকটের প্রেক্ষিতে উভয় দেশই জানিয়েছে যে তারা আপাত সমমনস্কতার দ্বারা এই বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ।

আফগানিস্তানের সমস্যাগুলি গভীর ভাবে খতিয়ে দেখা আবশ্যক। একাধিক সঙ্গত কারণেই ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্বের জায়গা দখল করতে পারে। ভারতের অর্থনৈতিক, জনতাত্ত্বিক এবং সামরিক ক্ষমতা তার প্রতিবেশী দেশগুলির তুলনায় অনেকটাই বেশি। ফলে নয়া দিল্লির কৌশলবিদরা আফগানিস্তানের বর্তমান ঘটনাপ্রবাহকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালিবান বিদ্রোহীরা সাফল্য পাওয়ার পরে — যে বিদ্রোহীদের রাশিয়ান ফেডারেশনের তরফে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে — আফগানিস্তান ভারতের জন্য সম্ভাবনার এক ক্ষেত্র থেকে সম্ভাব্য আশঙ্কার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ধুত্বপূর্ণ, অনুমানযোগ্য একনায়কতন্ত্র যা একাধারে অক্ষম, বিদেশি শক্তির উপরে নির্ভরশীল এবং দুর্নীতিগ্রস্ত, সেটিকে উৎখাত করেছে এমন এক সহিংস মৌলবাদী অভ্যুত্থান যা সন্ত্রাসবাদকে এক রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এর ফলে ভারত আফগানিস্তানের বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সংবেদনশীল হয়ে পড়েছে এবং কাবুলের নতুন রাজনৈতিক গতিবিধিও তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। আফগান রাজনীতিতে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা নিয়েও দুশ্চিন্তা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তালিবান অভ্যুত্থানের গঠন, অর্থায়ন এবং সেটিকে সুরক্ষা প্রদানের ব্যাপারটি পাকিস্তান সেনার তত্ত্বাবধানেই সম্ভব হয়েছে — যেটি বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনেই ফুটে উঠেছে এবং কখনও লুক্কায়িত থাকেনি। দুই দেশের পারস্পরিক শত্রুতা এবং কাশ্মীর সমস্যার প্রেক্ষিতে ভারতের উদ্বেগ বৃদ্ধি আরও স্পষ্ট হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিরিখে সেটি যথাযথ।

ভারত আফগানিস্তানের বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সংবেদনশীল হয়ে পড়েছে এবং কাবুলের নতুন রাজনৈতিক গতিবিধিও তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।

যে সব পর্যবেক্ষক মনে করেন যে, তালিবান দক্ষ এবং নিয়মিত সরকার গঠনে ও আফগানিস্তানের সমস্যা সমাধানে সমর্থ নয়, তাঁরা এই দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেন। আপাত দৃষ্টিতে তালিবানরা তাদের লক্ষ্য এবং কার্যপদ্ধতিতে দ্বিধাবিভক্ত। অভ্যুত্থানকারী একাধিক গোষ্ঠী পারস্পরিক মতপার্থক্যে জর্জরিত। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল হয় যদি অপেক্ষাকৃত আধুনিক পন্থীরা এবং মধ্যপন্থীরা হাক্কানি নেটওয়ার্কের কট্টর মৌলবাদী সমর্থকদের — যারা সম্পূর্ণ ভাবে রাওয়ালপিন্ডির উপরে নির্ভরশীল — বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে সক্ষম হন। একই সঙ্গে, সব ক’টি শক্তিশালী দেশই তালিবানের রাজনৈতিক লড়াইয়ে সন্ত্রাসবাদকে ব্যবহার না করা, আল কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কের সমাপ্তি এবং এক অন্তর্ভুক্তিমূলক সর্বাঙ্গীন সরকার গঠনের উপরে বিশেষ জোর দিয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ভূমিকা সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার অনন্য অবস্থানের সমতুল্য। ফলে স্ট্রাকচারাল নিও রিয়্যালিজমের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আঞ্চলিক নেতা হিসেবে ভারত আফগান সংকটের প্রেক্ষিতে তার অনন্য মতামত শোনার জন্য আবেদন জানাতে পারে।

এর ফলে আফগান সংকট বিষয়ে সমন্বয় রুশ-ভারত সম্পর্কের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে উঠে এসেছে। তালিবানের নিয়ন্ত্রণ আধুনিক আফগানিস্তানের এক চরম বাস্তব। এখনকার মতো হলেও কট্টরবাদী অভ্যুত্থান আফগানিস্তানে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই পরিস্থিতি বিপর্যয়কর। তালিবানের জয় বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির জন্য এবং তাদের প্রতি সহমর্মী দেশগুলির জন্য আদর্শ মডেল, উদ্দীপক এবং উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে। তবুও ভারতের উচিত আফগানিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়া। আন্তর্জাতিক স্তরে মুখ্য শক্তিগুলির এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক সমন্বয় প্রয়োজন। রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, ভারত, ইরান, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং মধ্য এশীয় দেশগুলি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত পারস্পরিক মত বিনিময়ের মাধ্যমে আফগান সংকটের প্রেক্ষিতে একে অন্যের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হওয়া। রাষ্ট্রপুঞ্জের কর্মপদ্ধতি এই পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.