২০২৪ সালটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী বছর বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বকারী ৭০টিরও বেশি দেশে ২০২৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম নির্বাচন অর্থাৎ ভারতের বহু দিনব্যাপী চলা সাধারণ নির্বাচন থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ বাজিসম্পন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হোক বা সংযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ফলপ্রসূ নির্বাচন… ২০২৪ সালটি সারা বিশ্ব জুড়ে উচ্চ মাত্রার প্রচারের সাক্ষী থেকেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই যে, তীব্র দ্বন্দ্ব ও ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে এক ডজন গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন হয়েছে। বেজিংয়ের তীব্র চাপ ও প্ররোচনার মুখে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি আবার ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধরত রাশিয়ায় মার্চের মাঝামাঝি সময়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একই ভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা, আলজেরিয়া, ঘানা, নামিবিয়া, মোজাম্বিক, সেনেগাল ও সংঘাতপূর্ণ দক্ষিণ সুদান-সহ বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশে ক্রমবর্ধমান সংঘাত ও উত্তেজনার মধ্যেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ক্ষুব্ধ ভোটার এবং নিরাপত্তাহীন প্রশাসন
জাপান, ফ্রান্স, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ জুড়ে ভোটাররা ক্ষমতাসীনদের প্রতি নিজেদের হতাশা প্রকাশ করেছে এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও তীব্র বৈশ্বিক সংঘাতের জন্য ক্ষমতাসীনদেরই দায়ী করেছে। জাপানে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি – এমন একটি দল যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ক্ষমতায় রয়েছে - পার্লামেন্ট নির্বাচনে একটি চমকপ্রদ পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে। একই ভাবে, দক্ষিণ আফ্রিকার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস ১৯৯৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বারের মতো তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। প্রতিবেশ অঞ্চলে শ্রীলঙ্কায় স্বল্প পরিচিত মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়েকে তাঁর জনতা বিমুক্তি পেরামুনা পার্টির নেতৃত্ব প্রদান করেছেন এবং দলটি প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করেছে। ১৪ বছরের কনজারভেটিভ পার্টির শাসনের অবসান ঘটিয়ে লেবার পার্টি ব্যাপক জয় লাভ করলে সংযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রও এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছে।
জাপানে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি – এমন একটি দল যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ক্ষমতায় রয়েছে -পার্লামেন্ট নির্বাচনে একটি চমকপ্রদ পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে।
২০২৪ সালের নির্বাচনগুলিতে ক্ষমতাসীনরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। অনেক নবাগত ও প্রান্তিক দল – যেমনটা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে - প্রতিষ্ঠিত দলগুলিকে হঠিয়ে নির্বাচনে ব্যাপক জয়লাভ করেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সবচেয়ে বড় ও ফলপ্রসূ নির্বাচনী ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছে। ক্ষুব্ধ ভোটাররা (ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অনেক প্রধান সমর্থক-সহ) বিশ্ব ও উদার গণতন্ত্রের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব-সহ প্রাক্তন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই নির্বাচিত করেছেন।
ক্ষমতাসীনদের পতনের এই মরসুমে ভারত অবশ্য ব্যতিক্রম বলে প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমান ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) টানা তৃতীয় বারের মতো সরকার গঠন করেছে। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হলেও এনডিএ জোট সরকার গঠনের জন্য ২৯৩টি আসন (৫৪৩টি আসনের মধ্যে) অর্জন করেছিল।
দক্ষিণপন্থার জোয়ার
প্রায় ৭০টি দেশের নির্বাচনে ইউরোপের অনেক অঞ্চলে উগ্র দক্ষিণপন্থী দলগুলির অভূতপূর্ব নির্বাচনী সাফল্য দেখা গিয়েছে। বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থী দলগুলি ক্রমশ বাড়তে থাকলেও (২০১০ সালে ভিক্টর অরবানের বিজয়ের পর) ২০২৪ সালে তারা অভূতপূর্ব নির্বাচনী জয়লাভ করেছে। অভিবাসন বিরোধী ক্ষোভ ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে ইইউ-তে ভোটাররা দক্ষিণপন্থী পপুলিস্টদের প্রতি অস্বাভাবিক আস্থা প্রদর্শন করেছেন। সেপ্টেম্বর মাসে হার্বার্ট কিকলের অতি-দক্ষিণপন্থী ফ্রিডম পার্টি ২৯ শতাংশ ভোট পেয়ে পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং অন্য দিকে বেলজিয়াম ও পর্তুগালের রক্ষণশীল দলগুলিও ২০২৪ সালে চিত্তাকর্ষক জয় লাভ করেছিল। চেক প্রজাতন্ত্র, ক্রোয়েশিয়া, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস এবং স্লোভাকিয়ার মতো অন্তত সাতটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশে অতি-দক্ষিণপন্থী দলই শাসক জোটের অংশ হয়ে উঠেছে। তবে দক্ষিণপন্থী দলগুলির উত্থানের ক্ষেত্রে ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দুই বৃহত্তম ইইউ সদস্য রাষ্ট্রেও আসল বাঁকবদল ঘটেছে।
অভিবাসন বিরোধী ক্ষোভ ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে ইইউ-তে ভোটাররা দক্ষিণপন্থী পপুলিস্টদের প্রতি অস্বাভাবিক আস্থা প্রদর্শন করেছে।
অতি-দক্ষিণপন্থী দলগুলির উত্থানের অনুরণিত প্রভাব সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইইউ (পার্লামেন্ট) নির্বাচনেও স্পষ্ট। অভিবাসন বিরোধী কেন্দ্রীয় দক্ষিণপন্থী ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি (ইপিপি) ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ৭২০টি আসনের মধ্যে ১৮৮টি আসন পেয়ে ব্যাপক নির্বাচনী জয়লাভ করেছে। ইইউ-এর অতি-দক্ষিণপন্থীদের আখ্যানটি উল্লেখযোগ্য হলেও তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিচিত দক্ষিণপন্থী জনপ্রিয় রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভূতপূর্ব বিজয়ের আলোকে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত বিজয় উদার গণতন্ত্র প্রকল্পের উপর ছায়া ফেলতে পারে এবং এটি বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণপন্থী দলগুলির জন্য অনুঘটক হয়ে উঠতে পারে।
নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি
২০২৪ সালে আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা ছিল কর্তৃত্ববাদী শক্তিদের দ্বারা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির ঘটনার বৃদ্ধি। এটি এখন সুপরিচিত যে, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র, বিশেষ করে রাশিয়া, চিন এবং ইরানের সাইবার-আক্রমণ ও তথ্যের উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম কার্যকলাপ গণতন্ত্র জুড়ে নির্বাচনী অখণ্ডতার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো সাধনী, বিশেষ করে জেনারেটিভ এআই-এর দরুন ২০২৪ সালে বিভ্রান্তির মাত্রা ও নির্বাচনী কারচুপির সম্ভাবনা তীব্রতর হয়েছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্রধান প্রযুক্তি মঞ্চের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে (ভারত-সহ) ২০টি নির্বাচন-সম্পর্কিত গোপন অভিযান রাশিয়া, ইরান এবং চিন থেকে সংঘটিত হয়েছে। তবে আশার কথা হল এই যে, নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তি মঞ্চগুলি বিদেশি শক্তি ও তাদের কারসাজির সাধনীর তরফে বাধার পরিমাণ কমাতে সমাধান খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছিল। তা সত্ত্বেও রোমানিয়া ও জর্জিয়ার নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ দর্শায় যে, গণতন্ত্র-পর্যবেক্ষকদের সর্বদা সজাগ থাকতে হবে।
এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো সাধনী, বিশেষ করে জেনারেটিভ এআই-এর দরুন ২০২৪ সালে বিভ্রান্তির মাত্রা ও নির্বাচনী কারচুপির সম্ভাবনা তীব্রতর হয়েছে।
উপসংহার
২০২৪ সালে ৭০টিরও বেশি দেশে নির্বাচন এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন বৃহত্তম গণতন্ত্রে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতাস্বরূপ গণতন্ত্রের স্খলন ঘটেছে এবং অভিবাসন, চাকরি ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার মতো বিষয়গুলির জন্য ভোটারদের মধ্যে হতাশা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক গণতন্ত্রে, ভোটারদের, বিশেষ করে তরুণদের তরফে নির্বাচনের প্রতি ক্রমবর্ধমান হতাশা লক্ষ করা গিয়েছে। এই কারণগুলিকেই অনেকাংশে পুঁজি করে ইউরোপ ও আমেরিকার পপুলিস্ট নেতারা (বেশির ভাগই দক্ষিণপন্থী) নির্বাচনে জয়লাভ করা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে (ও মূল্যবোধ!) আঁকড়ে ধরার কাজে লাগিয়েছে। নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্যে গণতান্ত্রিক স্থিতিস্থাপকতার সবচেয়ে বড় আশা দক্ষিণ এশিয়া থেকেই উঠে এসেছে। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে মূলত তরুণদের নেতৃত্বে রাস্তায় বিক্ষোভ আসলে বৃহত্তর গণতন্ত্রের দরজা খুলে দিয়েছে। সংক্ষেপে বললে, যদি ২০২৪ নির্বাচনের বছর হয়, তা হলে ইউরোপ থেকে আমেরিকা পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান দক্ষিণপন্থী চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ২০২৫ সালটি হতে চলেছে গণতন্ত্র সশক্তকরণের বছর।
নিরঞ্জন সাহু অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.