Published on Dec 03, 2021 Updated 0 Hours ago

অঞ্চলটিতে ভারতের সদর্থক ভূমিকা ইন্দো-আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনেও আলোচিত হয়েছে।

প্রাচ্যের শীর্ষ সম্মেলন এবং ভারতের আসিয়ান উচ্চাকাঙ্ক্ষা

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অক্টোবর মাসটি ছিল ঘটনাবহুল। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী শীর্ষ নেতারা সমবেত হয়েছিলেন আসিয়ান এবং পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের বার্ষিক সভায়, যেটির সভাপতিত্ব করেছিল ব্রুনেই। এই শীর্ষ সম্মেলনগুলি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উল্লেখযোগ্য দেশগুলির বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের সুস্পষ্ট অবয়ব তুলে ধরতে অসীম গুরুত্বপূর্ণ। এক দিকে কোভিড অতিমারির প্রবাহের তীব্রতা এবং অন্য দিকে অউকাস পরমাণু সাবমেরিন চুক্তি সংক্রান্ত টানাপড়েনের পাশাপাশি আমেরিকা এবং চিনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান শত্রুতার প্রেক্ষাপটে এ বারের শীর্ষ সম্মেলনগুলি সংঘটিত হয়। মায়ানমারের সামরিক জুনটাকে শীর্ষ সম্মেলনের আওতার বাইরে রাখা নিয়েও চাপানউতোর ছিল চরমে।

প্রথমত, বিশ্বব্যাপী আমেরিকা এবং চিনের ক্রমবর্ধমান অশান্তির ছাপ পড়েছে এই শীর্ষ সম্মেলনটিতেও। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মন্তব্যে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ওয়াশিংটন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে চিনের সঙ্গে তার দ্বৈরথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে এক গুরুত্বপূর্ণ রঙ্গমঞ্চ রূপে দেখে। চার বছর যাবৎ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিষ্ক্রিয়তার পরে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আসিয়ান দেশগুলিকে প্রতিশ্রুতি দেন, অঞ্চলটিতে ‘মার্কিন উপস্থিতি আরও প্রত্যক্ষ ভাবে অনুভব করা যাবে এবং অঞ্চলের দেশগুলির সঙ্গে আমেরিকা ব্যক্তিগত স্তরে যোগাযোগ রাখবে।’ এর পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট বাইডেন অঞ্চলটিতে চিনের একচেটিয়া প্রভাব রুখতে এবং মার্কিন উপস্থিতি স্পষ্ট করতে স্বাস্থ্য পরিষেবা, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ১০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাইওয়ানে চিনের কার্যকলাপের সমালোচনা করেন। তিনি চিনের এই মানসিকতাকে ‘আগ্রাসী’ বলে অভিহিত করেন এবং চিনকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রেক্ষিতে বিপজ্জনক বলে ঘোষণা করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় দমে না গিয়ে চিনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং আসিয়ান দেশগুলির স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত ত্রাণের জন্য ৩১ লক্ষ মার্কিন ডলারের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ ছাড়াও তিনি দক্ষিণ চিন সমুদ্রে চিনের আগ্রাসন নিয়ে করা প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মন্তব্যের বিরোধিতা করেন এবং আমেরিকার কাছে অনুরোধ জানান যেন তারা তাইওয়ানের স্বাধীনতা সংগ্রামী শক্তিগুলিকে মদত না জোগায়। চিন আরও জানিয়েছে যে, নভেম্বর মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে চিন একটি বিশেষ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করতে ইচ্ছুক যা চিন এবং আসিয়ান সম্মেলনের সম্পর্ককে এক সর্বাঙ্গীন কৌশলগত অংশীদারিত্বে রূপান্তরিত করবে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মন্তব্যে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ওয়াশিংটন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে চিনের সঙ্গে তার দ্বৈরথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে এক গুরুত্বপূর্ণ রঙ্গমঞ্চ রূপে দেখে।

অস্ট্রেলিয়াও এই পরিস্থিতিতে নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করেছে এবং অঞ্চলটিতে জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯ ত্রাণ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদ প্রশমনে ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন অঞ্চলটিতে কার্যকর শক্তিগুলিকে আশ্বস্ত করে জানান যে, সদ্য স্বাক্ষরিত অউকাস পারমাণবিক ডুবোজাহাজ চুক্তি অঞ্চলটির সুস্থিতির জন্য মোটেও বিপজ্জনক নয়। তবুও আসিয়ান দেশগুলির মধ্যে মতের বিভাজন সুস্পষ্ট। এক দিকে যখন মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলটিতে দেশগুলির সামরিক ক্ষমতা প্রকাশের সম্ভাব্য কোন্দল নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছে, তখন অন্য দিকে সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনস-এর মতো দেশগুলি এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মরিসনের আশ্বাস সত্ত্বেও শীর্ষ সম্মেলনের অব্যবহিত পরেই জারি করা যৌথ বিবৃতিতে অউকাস চুক্তির উল্লেখ না থাকায় অঞ্চলটিতে বিভাজনের রেখা স্পষ্ট।

আসিয়ানের তরফে দক্ষিণ চিন সমুদ্রে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে চিনকে শান্তিপূর্ণ আলাপ আলোচনার পথ অবলম্বন করতে অনুরোধ জানানো হলেও শীর্ষ সম্মেলন পরবর্তী যৌথ বিবৃতিতে চিনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং তাইওয়ানে তার অত্যাচারের ব্যাপারগুলি স্পষ্টতই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আসিয়ান সদস্য দেশগুলি নিজেদের ব্যক্তিগত পরিসর নির্ধারণে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে এবং এমন এক কর্মসূচির ঘোষণা করেছে যা সামুদ্রিক সহযোগিতা, পরিকাঠামো উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উপরে জোর দেবে।

অঞ্চলটিতে ভারতের সদর্থক ভূমিকার কথা ভারত-আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনেও উল্লিখিত হয়েছে। অন্যান্য প্রচেষ্টার মধ্যে এ ক্ষেত্রে অঞ্চলটিতে কোভিড-১৯ অতিমারির প্রবাহ রুখতে কোভিড-১৯ টিকা রফতানির কাজে এবং আন্তঃ-আঞ্চলিক সংযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ভারতের ভূমিকা বিশেষ ভাবে সমাদৃত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযোগ ব্যবস্থা এবং নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে গড়ে তোলার আসিয়ান পরিকল্পনার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভারত অঞ্চলটিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ডিজিটাল সংযোগ স্থাপনের উন্নয়ন খাতে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ মঞ্জুর করেছে। দেশের আই আই টি-গুলিতে আসিয়ান ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পিএইচ ডি ফেলোশিপ বন্দোবস্ত করার মাধ্যমে ভারত শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এই শীর্ষ সম্মেলনটিতে সেই সম্ভাব্য বিষয়গুলির কথাও উঠে এসেছে যেগুলি ভবিষ্যতের পারস্পরিক সহযোগিতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অঞ্চলটিতে কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান, সন্ত্রাসবাদ প্রশমনে অংশীদারিত্ব এবং স্থিতিশীল উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলিতে বিনিয়োগ… এ সব কর্মসূচি ভারতের ক্ষমতা এবং অগ্রাধিকার দুইয়ের সঙ্গেই সমতা বিধান করে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সংযোগ ব্যবস্থা এবং নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে গড়ে তোলার আসিয়ান পরিকল্পনার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভারত অঞ্চলটিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ডিজিটাল সংযোগ স্থাপনের উন্নয়ন খাতে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ মঞ্জুর করেছে।

তবুও কোয়াড বা চতুর্দেশীয় জোটের অংশীদার দেশগুলির সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার সমন্বয়ের মাধ্যমেই ভারত তার প্রভাব খাটাতে এবং স্বার্থ চরিতার্থ করতে সক্ষম হবে। উদাহরণ স্বরূপ আসিয়ানের এক স্থিতিশীল ব্লু ওয়াটার ইকোনমি বা সমুদ্রজাত সম্পদের ব্যবহারের উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অর্থনীতির নির্মাণের উচ্চাশার কথা বলা যেতে পারে। এক দিকে ভারতের অভিজ্ঞতা যেমন আসিয়ান দেশগুলির বাস্তুতন্ত্রের সংরক্ষণ এবং বেআইনি মৎস্যশিকারের মতো প্রধান সমস্যাগুলির নিবারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, তেমনই অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বোল্লিখিত ১০ কোটি ডলারের প্যাকেজ এই কারিগরি শিক্ষার কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণে বিনিয়োগের মাধ্যমে অঞ্চলটিতে ভারতের প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করবে। সহযোগিতা সমন্বয়ের ক্ষেত্রে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে চলেছে আসিয়ান দেশগুলির ডিজিটাল সংযুক্তিকরণের লক্ষ্যমাত্রা। আঞ্চলিক দেশগুলি যখন এক দিকে সব মানুষকে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে অনলাইনে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে, তখন অন্য দিকে কোয়াড সমর্থিত ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে সরকার চালানোর ওপেন মডেলের সঙ্গে চিন সমর্থিত কর্তৃত্বপূর্ণ সরকার পরিচালনার মডেলের সংঘাতে চাপানউতোর বাড়ছে। নবনির্মিত কোয়াড ক্রিটিক্যাল এমার্জিং টেকনোলজি গ্রুপকে যৌথ ভাবে বাঁচিয়ে রাখার মাধ্যমে ভারত এবং আসিয়ানের অংশীদার দেশগুলি নিজেদের স্বার্থে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রযুক্তিগত মাপকাঠি এবং ডিজিটাল পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারে। বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত আবিষ্কার, স্থিতিশীল অর্থায়নের সম্ভাবনাযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন করার মতো আসিয়ান উচ্চাশাগুলি কোয়াডের নিজস্ব কর্মসূচির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, যে লক্ষ্যমাত্রা কোয়াডের সেপ্টেম্বর মাসের শীর্ষ সম্মেলনে নির্ধারিত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পারস্পরিক সহযোগিতার সফল প্রচেষ্টা কোয়াডকে অঞ্চলটিতে সুনাম অর্জনে সাহায্য করবে এবং পাশাপাশি তাদের ভিতও মজবুত করবে।

চিনের অর্থনীতির ভরসাযোগ্য বিকল্প পথ বের করতে না পারলে অঞ্চলটিতে কোয়াডের প্রভাব সীমিতই থেকে যাবে। যদিও প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর প্রশাসনের তরফে অঞ্চলটিতে একটি ‘অর্থনৈতিক পরিকাঠামো’ গড়ে তোলার প্রসঙ্গে সম্মতির ইঙ্গিত দিলেও তাঁর দাবির সত্যতা প্রমাণ করা সম্ভব কর্মসূচির বাস্তবায়নের চেষ্টার মাধ্যমেই। তবে আমেরিকা এবং ভারতের অভ্যন্তরে ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারিত্ব এবং রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ নিয়ে তুমুল বিরোধিতার বাস্তব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে কোয়াডের অর্থনৈতিক কৌশল যথাযথ নয়। নিজেদের অর্থাৎ অংশীদার দেশগুলির সামরিক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষমতার পরিপূরক অর্থনৈতিক কৌশল নিরূপণ না করতে পারলে আসিয়ান দেশগুলির সঙ্গে কোয়াডের পারস্পরিক সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা সীমিত থেকে যাবে।


এই প্রতিবেদনটি সর্ব প্রথম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রকাশিত হয়।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.

Authors

Harsh V. Pant

Harsh V. Pant

Professor Harsh V. Pant is Vice President – Studies and Foreign Policy at Observer Research Foundation, New Delhi. He is a Professor of International Relations ...

Read More +
Shashank Mattoo

Shashank Mattoo

Shashank Mattoo was a Junior Fellow with the ORFs Strategic Studies Program. His research focuses on North-East Asian security and foreign policy.

Read More +