সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে প্রাইম মিনিস্টার আনোয়ার ইব্রাহিমের ভারতে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরকে ঐতিহাসিক বলা চলে। গত ছ’বছরে এই প্রথম মালয়েশিয়ার কোনও প্রাইম মিনিস্টার ভারত সফর করেছেন এবং প্রাইম মিনিস্টার আনোয়ারের সফরকে ২০১৯ সালে সংক্ষিপ্ত কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের পর থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চূড়ান্ত পরিণতি বলে মনে করা যেতে পারে। গত কয়েক বছরে, ভারত ও মালয়েশিয়া দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রীদের একগুচ্ছ কূটনৈতিক সফর সম্পর্কের উর্ধ্বমুখী সঞ্চারপথকেই দর্শায়। মালয়েশিয়ার প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী গত বছরের শেষের দিকে জয়েন্ট কমিশনের বৈঠকের জন্য ভারতে এসেছিলেন এবং ভারতের বিদেশমন্ত্রী ডাঃ এস জয়শঙ্কর ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে মালয়েশিয়া সফরে যান।
সিএসপি-র মূল উদ্দেশ্য ও নীতিগুলি এখনও নির্ধারণ করা ও চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে মালয়েশিয়া এবং ভারতের মধ্যে এখন এই ধরনের উচ্চ-স্তরের অংশীদারিত্ব বিদ্যমান, যা অঞ্চলটিতে এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্ব নির্ধারণে উল্লেখযোগ্য।
আনোয়ার-মোদী শীর্ষ সম্মেলন এনহ্যান্সড স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ (ইএসপি) থেকে কমপ্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপে (সিএসপি) উত্তরণের মাধ্যমে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। আগামী বছর ইএসপি-র ১০তম বর্ষ পূর্ণ হওয়ার আগে এমনটা ঘটেছে। সিএসপি-র সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি এই সমস্যার সমাধান করে যে, দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ভিত্তিগুলি বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাগুলিকে প্রতিফলিত করে না বা স্বীকৃতি দেয় না। এ কথা ঠিক যে, সিএসপি-র মূল উদ্দেশ্য ও নীতিগুলি এখনও নির্ধারণ করা ও চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে মালয়েশিয়া এবং ভারতের মধ্যে এখন এই ধরনের উচ্চ-স্তরের অংশীদারিত্ব বিদ্যমান, যা অঞ্চলটিতে এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্ব নির্ধারণে উল্লেখযোগ্য। চিন, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের পরে ভারত এখন মালয়েশিয়ার সঙ্গে সিএসপি বহনকারী অন্যতম দেশ।
বর্তমান ভূ-রাজনীতির জটিল অবস্থার কারণে মালয়েশিয়া-ভারত সম্পর্কের এই ইতিবাচক উন্নয়নগুলিকে আর কেবল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা বলে মনে করা হয় না। মার্কিন-চিন বৈরিতার সময়ে এই অঞ্চলে চিনের আগ্রাসী প্রভাবের পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে মালয়েশিয়ার বর্ধিত সম্পর্ককে - বেজিংয়ের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী এবং গত কয়েক বছরে ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ অংশীদার - শুধুমাত্র ‘চিনা দৃষ্টিভঙ্গি’র মাধ্যমেই বিচার করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি চরম দুরবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। সমস্ত কৌশলগত সম্পর্ককে চিনের জন্য, চিন দ্বারা অথবা তরফে একটি পণ্য বলে বিবেচনা করা হয় এবং এই ধারণা ভীষণ রকমের সঙ্কোচনবাদী এবং তা এই দেশগুলি যে ক্ষমতা দর্শাতে চায়, সেই প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে তোলে।
নিশ্চিত করে এ কথা বলা যায় যে, শক্তিশালী মালয়েশিয়া-ভারত সম্পর্ক চিনের সঙ্গে সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল নয়। এমনটা মনে করলে তা পুত্রজায়া-নয়াদিল্লি সম্পর্কের গতিপথ সম্পর্কে অবজ্ঞা ও অজ্ঞতার নামান্তর। এবং তাতে পুত্রজায়ার সঙ্গে বেজিংয়ের সম্পর্ককেও খাটো করে দেখা হবে। মালয়েশিয়া সবসময় চিনের সঙ্গে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক রেখেছে, যা সম্প্রতি চিনের প্রিমিয়ার লি কিয়াংয়ের দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে মালয়েশিয়া সফরের মাধ্যমেই স্পষ্ট। প্রকৃতপক্ষে, দক্ষিণ চিন সাগরের বিরোধ সত্ত্বেও চিন ও মালয়েশিয়ার সম্পর্ক সবসময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ ভাবে কার্যকর ছিল। এই প্রসঙ্গে বেজিংয়ের সঙ্গে মোকাবিলা করার সময় পুত্রজায়ার ‘শান্ত কূটনীতি’ অবিচলিত ভাবে কাজ করেছে এবং তা চিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিভিন্ন দিকের মধ্যে সমতা বজায় রাখার মালয়েশিয়ার অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে দর্শায়।
মালয়েশিয়া সবসময় চিনের সঙ্গে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক রেখেছে, যা সম্প্রতি চিনের প্রিমিয়ার লি কিয়াংয়ের দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে মালয়েশিয়া সফরের মাধ্যমেই স্পষ্ট।
মালয়েশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই ভিয়েতনাম এবং ফিলিপিন্সের চেয়ে অনেকটাই আলাদা, যেখানে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত অনেক উজ্জ্বল ভাবে জায়গা করে নিয়েছে। ভারত উভয় দেশের সঙ্গে তার সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে এবং সম্ভবত ভারত চিনের তরফে গাত্রদাহের উদ্রেক করে দক্ষিণ চিন সাগরে নিজের উপস্থিতি আরও প্রসারিত করবে। এটি অবশ্য সময়ই বলবে যে, তার নিজস্ব কৌশলগত প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ভারত কী ভাবে দক্ষিণ চিন সাগরে তার দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকাকে কল্পনা করে। মালয়েশিয়া তার দাবি পূরণের জন্য তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে সমর্থনের মুখাপেক্ষী নয়, এমনকি যদি সেই তৃতীয় পক্ষ তার ‘সর্বাত্মক কৌশলগত অংশীদার’ হলেও এমনটা চায় না। মালয়েশিয়া-ভারত সম্পর্ক সেই অর্থে স্বাধীন হবে এবং দক্ষিণ চিন সাগরের যে কোনও ঘটনাপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন।
শুধুমাত্র ‘চিনের দৃষ্টিভঙ্গি’ থেকে শক্তিশালী মালয়েশিয়া-ভারত সম্পর্ককে দেখলে পাঁচ বছর আগে ঘটা অচলাবস্থার পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সচেতন পরিপক্বতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হবে না। তারপর থেকে, উভয় দেশই ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা বাড়াতে ও পরস্পরনির্ভরতা গড়ে তোলার জন্য কাজ করেছে। সম্পর্কের মধ্যেকার বিরক্তিকর কারণগুলি দূরে সরিয়ে রেখে পরবর্তী সময়ে সেগুলি খতিয়ে দেখার কথা ভেবেছে। তাই এখন একটি সিএসপি-র প্রবর্তন দুই দেশের সম্পর্কের জন্য এক বিশাল জয়, মালয়েশিয়ার বিদেশনীতির জন্য একটি শক্তিশালী সাফল্য এবং এই বছরের ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতির জন্য দশম বার্ষিকীতে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলকও বটে।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সের সাপ্রু হাউসে দেওয়া বিশেষ বক্তৃতার সময় প্রাইম মিনিস্টার আনোয়ার যখন ব্রিকস+ গোষ্ঠীতে যোগদানের জন্য মালয়েশিয়ার অভিপ্রায়ের কথা বলেছিলেন, তখন তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, ‘ব্রিকস-এর মধ্যে ভারতের স্বতন্ত্র ও প্রভাবশালী ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা স্বীকার করি যে আমাদের শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গোষ্ঠীটির গতিশীলতায় উল্লেখযোগ্য মূল্য যোগ করবে।’ এই বক্তব্যটি ভারতের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সম্পর্কের গুরুত্বের এক অকাট্য প্রমাণ। তাই সহযোগিতামূলক কাঠামোর মধ্যে এবং একটি ‘চিনা নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক ব্লক’-এর মধ্যে এই বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মালয়েশিয়ার কাছে, ব্রিকস+-এ ভারতের উপস্থিতি গোষ্ঠীটিতে ভারসাম্য নিয়ে আসে। ফলে গোষ্ঠীটি যে শুধু ‘পশ্চিম-বিরোধী’ বা শুধুমাত্র চিন ও রাশিয়া-চালিত এই ধারণাটি খর্ব করতে সাহায্য করে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর মালয়েশিয়ার এই গোষ্ঠীতে যোগদানের সদিচ্ছাকে সমর্থন করার পাশাপাশি এ কথা স্পষ্ট যে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের শক্তি আঞ্চলিক গতিশীলতায়ও আরও বৈশিষ্ট্য যোগ করবে এবং তা শুধুমাত্র সরলীকরণ মার্কিন-চিন বা এমনকি ভারত-চিন ‘দ্বিমুখী ফাঁদ’-এর ঊর্ধ্বে উঠতে সক্ষম হবে।
মালয়েশিয়ার কাছে, ব্রিকস+-এ ভারতের উপস্থিতি গোষ্ঠীটিতে ভারসাম্য নিয়ে আসে। ফলে গোষ্ঠীটি যে শুধু ‘পশ্চিম-বিরোধী’ বা শুধুমাত্র চিন ও রাশিয়া-চালিত এই ধারণাটি খর্ব করতে সাহায্য করে।
এবং এটিই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রায়শই মার্কিন-চিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সমস্যায় পড়লেও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদেরকে জটিল ভারত-চিন সমীকরণের মধ্যে জড়িয়ে ফেলতে চায় না। আসলে এমন এক বিলাসিতা, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি বয়ে চলতে পারে না। পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকদের দ্বারা ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব সময়ই ‘চিন ফ্যাক্টর’কে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা এই সম্পর্কগুলির প্রকৃতির বিশিষ্টতা ও সূক্ষ্মতার নিরিখে অবজ্ঞামূলক বটেই। প্রকৃতপক্ষে, এই বিশ্লেষণগুলি চিনের সঙ্গে তার সমীকরণ থেকে স্বাধীন দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ক লালন করার জন্য ভারতের ক্ষমতাকেও দুর্বল করে তোলে।
মালয়েশিয়ার জন্য, ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তাই শুধুমাত্র কোনও পার্শ্বিক ঘটনা নয়। দুই দেশ সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায়ে দীর্ঘস্থায়ী, বহুমুখী এবং অনন্য সম্পর্ককেই উপস্থাপন করে। চিন বা মার্কিন-চিন প্রতিযোগিতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কগুলির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এই বাস্তবিকতাকেই প্রত্যাখ্যান করে যে, মালয়েশিয়া ও ভারত তাদের সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত মূল্যবোধের ভিত্তিতে পদক্ষেপ করে এবং এটি প্রচলিত আখ্যানের জন্য সমস্যাজনক। আগামিদিনে উভয় দেশের নীতিনির্ধারকদের এ কথা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, সিএসপি একটি সত্যিকারের সামগ্রিক ও স্থায়ী পদক্ষেপ, যা ইতিমধ্যেই বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মাঝেই এই সম্পর্ককে আকার দেয় এবং গড়ে তোলে। আগামী সময়ে গতিশীলতার যে কোনও রকমের অভাব তাই শুধুমাত্র নেতিবাচক হবে, তা নয়; একই সঙ্গে সঙ্কোচনবাদী আখ্যানকে আরও জোরদার করবে।
ইয়ানিথা মীনা মালয়েশিয়ার ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বিশ্লেষক।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.