Author : Soumya Bhowmick

Published on May 14, 2022 Updated 0 Hours ago

শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক হতাশার মধ্যে ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে শুধু দুটি বিকল্প আছে: হয় আইএমএফ–এর কাছ থেকে আরও সহায়তা চাওয়া, বা বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া।

আইএমএফের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার ‘প্রেম-ঘৃণা’র সম্পর্ক

সম্প্রতি ভারতের নিকটবর্তী প্রতিবেশ উথালপাতাল অবস্থায় রয়েছে। প্রায় এক বছর আগে মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে গণবিক্ষোভ, হত্যাকাণ্ড ও অস্ত্রের ব্যবহার থেকে শুরু করে পাকিস্তানে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জটিলতা; সাংহাই এবং শেনজেনের মতো চিনা শহরগুলিতে কোভিড-১৯ নতুন করে ফিরে আসা থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কার এই অঞ্চলের বহুচর্চিত অর্থনৈতিক সঙ্কটের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা—সব মিলিয়ে চারিদিকে নতুন বৈদেশিক নীতির গতিশীলতা ও অর্থনৈতিক কূটনীতির মোকাবিলায় ভারতকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।

১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর শ্রীলঙ্কা এখন তার সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে‌ দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ ছাঁটাই, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও প্রয়োজনীয় পণ্যের অভাবের দৃশ্যপটে। ২০০৯ সালে শেষ হওয়া ২৬ বছরের দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শ্রীলঙ্কার বাজেট ঘাটতির উপর একটি বড় চাপ তৈরি করেছিল, এবং ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সঙ্কট দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় শূন্য করে দিয়েছিল। তার ফলস্বরূপ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলি অর্থনৈতিক মাপকাঠি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরের পর সরকারগুলির অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে চলতি খাতের ঘাটতির সঙ্গে বাজেটের ঘাটতি মিলে এক জোড়া ঘাটতি তৈরি হয়েছে। প্রথমত, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন করতে কোভিড-১৯ অতিমারির কয়েক মাস আগে কর অনেকটা কমানো হয়েছিল। ফলে ২০১৯ ও ২০২০ সালের মধ্যে নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা অনেকটা কমে যায়। দ্বিতীয়ত, সরকার ২০২১ সালে সমস্ত সার আমদানি নিষিদ্ধ করেছিল। যে হেতু সার বেশিরভাগই আমদানি করা হত, তাই দেশটিকে রাতারাতি জৈব কৃষিতে চলে যেতে হয়েছিল, এবং তার ফলে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায় এবং খাদ্য আমদানি বেড়ে যায়।

পরের পর সরকারগুলির অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে চলতি খাতের ঘাটতির সঙ্গে বাজেটের ঘাটতি মিলে এক জোড়া ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

গত দুই দশকে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেওয়ার ধারাবাহিকতা দেখা গেছে। ২০০৯ সালে আইএমএফ এই শর্তে ঋণ দিয়েছিল যে ২০১১ সালের মধ্যে বাজেট ঘাটতি জিডিপি–র ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। বৃদ্ধি বা রফতানিতে কোনও উন্নতি না হওয়ায় দেশটি ২০১৬ সালে আবার আইএমএফ–এর কাছে ঋণের জন্য যায়, কিছু নতুন ধারা সহ যা দাঁড়িয়েছিল ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার। আইএমএফ প্যাকেজ অর্থনীতির স্বাস্থ্যের ক্ষতি করেছে:‌ বৃদ্ধির হার ২০১৫ সালের ৫ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালে নেমে এসেছে ২.৯ শতাংশে। একই সময়ে সরকারের রাজস্ব জিডিপি–র ১৪.১ শতাংশ থেকে কমে ১২.৬ শতাংশ হয়েছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে আইএমএফ ঋণগুলি এমন কিছু শর্ত‌সহ আসে যা প্রায়ই ঋণগ্রস্ত দেশগুলিকে বেশ কিছুটা গণ্ডিবদ্ধ করে। শ্রীলঙ্কার গুরুতর ব্যালান্স অফ পেমেন্ট (বিওপি) সঙ্কট সত্ত্বেও দেশটি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে হোঁচট খেতে থাকার পূর্ববর্তী ট্র্যাক রেকর্ডের কারণে আইএমএফ–এর কাছ থেকে সহায়তা না–চাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। বিকল্প কৌশলটি ছিল প্রতিবেশের বিশ্বব্যাপী প্রতিদ্বন্দ্বী চিন ও ভারতের কাছ থেকে সহায়তা চাওয়া।

চিন: আর ত্রাণকর্তা নয়

কোভিড–১৯ অতিমারি নিঃসন্দেহে বিশ্ব অর্থনীতিকে বিভিন্ন ভাবে আঘাত করেছে, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার মতো ছোট উন্নয়নশীল দেশগুলিকে। এই প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক অর্থনীতিগুলির জন্য তাদের সামগ্রিক বৈদেশিক ঋণ ও চিনের থেকে পাওয়া ঋণের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার মতো বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) দেশগুলির জন্য। কয়েক বছর আগে চিনের কাজকর্ম অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল যখন কলম্বো প্রায় ১১২ কোটি মার্কিন ডলারের মূলধনী ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হওয়ায় চায়না মার্চেন্টস পোর্ট হোল্ডিং (সিএমপোর্ট) ৯৯ বছরের লিজে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর দখল করে নেয়।

বিশ্ব রাজনীতির অনেক পক্ষই শ্রীলঙ্কাকে চিনের ‘ঋণ-ফাঁদ কূটনীতির’ শিকার হিসেবে দেখে, যা বেশ যুক্তিযুক্ত। যদিও শ্রীলঙ্কার বকেয়া মোট বৈদেশিক ঋণের মাত্র ৬ শতাংশ  চিনের, কিন্তু বেজিংয়ের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের ফলাফল কতটা সমস্যা তৈরি করে তার প্রতিফলক বিভিন্ন প্রকল্পে চিনের লিকুইডেশন টেকনিক এবং প্রচ্ছন্ন ঋণ। শ্রীলঙ্কায় চলতি অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে কলম্বো ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সে দেশে সফররত চিনা বিদেশমন্ত্রীকে ঋণ পরিশোধ স্থগিত করার জন্য অনুরোধ করেছিল, এবং এই ভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক অঙ্গনে আবারও ‘‌সমস্যাযুক্ত চিনা ঋণ’‌ ইস্যুটি আলোড়ন তুলেছিল। দ্বীপরাষ্ট্রটি ২০২২ সালের মার্চ মাসে প্রায় ২৫০ কোটি মার্কিন ডলারের নতুন ঋণ চেয়েছিল।

কয়েক বছর আগে চিনের কাজকর্ম অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল যখন কলম্বো প্রায় ১১২ কোটি মার্কিন ডলারের মূলধনী ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হওয়ায় চায়না মার্চেন্টস পোর্ট হোল্ডিং (সিএমপোর্ট) ৯৯ বছরের লিজে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর দখল করে নেয়।

ভারত: নতুন বন্ধু

গত কয়েক বছরে শ্রীলঙ্কা এবং ভারত যথেষ্ট পরিমাণে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে সক্ষম হয়েছে, এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (‌সার্ক)‌-র আওতার মধ্যে একে অপরের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে রয়েছে। শ্রীলঙ্কার জন্য ভারতের বড় আর্থিক প্যাকেজগুলির মধ্যে আছে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের সার্ক কারেন্সি সোয়াপ; ৫১.‌৫২ কোটি মার্কিন ডলারের এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন সেটেলমেন্ট দু’‌মাস স্থগিত করা, এবং শ্রীলঙ্কার জ্বালানি সংগ্রহের জন্য ৫০ কোটি মার্কিন ডলার দেওয়া। একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ করে নয়াদিল্লি খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহে সহায়তা করার জন্য কলম্বোকে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্রেডিট লাইনও দিয়েছে।

দুর্ভাগ্যবশত, কিন্তু বেশ প্রত্যাশিত ভাবে, শ্রীলঙ্কার সঙ্কটের মূল্যে সহায়তা প্রদান করা নিয়ে ভারত বনাম চিনের প্রতিযোগিতার সুর বেশ স্পষ্ট। প্রকৃতপক্ষে, এই ধরনের কঠিন সময়ে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) জন্য কলম্বোর উপর বেজিংয়ের চাপ নিয়ে প্রকৃত উদ্বেগ রয়েছে। শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহে বলেছেন ভারত শ্রীলঙ্কাকে ‘সবচেয়ে বেশি’‌ সহায়তা দিয়েছে, এবং যোগ করেছেন, ‘‌‘যখন নয়াদিল্লি এখনও অ-আর্থিক উপায়ে সাহায্য করছে, তখন ‌আমাদের ভারতের সমর্থনের ফলাফল দেখতে হবে।’‌’‌

অর্থ মন্ত্রকের মতে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ ঠিকঠাক করতে এবং অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের পথ চাঙ্গা করতে আগামী ছয় মাসে প্রায় ৩০ লক্ষ মার্কিন ডলার মূল্যের বৈদেশিক সহায়তার প্রয়োজন হবে।

আইএমএফ-এ ফিরে যাওয়া?‌

হাজার হাজার শ্রীলঙ্কাবাসী যখন এই বিপর্যয় নিয়ে আসার জন্য বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, সেই সময় বড় প্রশ্নটি হল যে কলম্বো আবারও ধীরে ধীরে আইএমএফ–এর কাছাকাছি আসছে কিনা? বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন যে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট তাঁর ভাই ও অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপক্ষেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আইএমএফ–এর সঙ্গে আলোচনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন বিচারমন্ত্রী আলি সাবরি৷ ১২ এপ্রিল দেশটি ঘোষণা করেছে যে তারা ৫,১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বিদেশি ঋণের কিস্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং আইএমএফ থেকে বেলআউটের (‌অর্থাৎ তাদের উদ্ধার করতে ঋণের)‌  অপেক্ষায় আছে। অর্থ মন্ত্রকের মতে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ ঠিকঠাক করতে এবং অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের পথ চাঙ্গা করতে আগামী ছয় মাসে প্রায় ৩০ লক্ষ মার্কিন ডলার মূল্যের বৈদেশিক সহায়তার প্রয়োজন হবে। মন্ত্রী এই সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য সহায়তা খুঁজছেন, এবং আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। তার আগে আইএমএফ–ও শ্রীলঙ্কার অর্থ মন্ত্রকের সঙ্গে ‘‌প্রযুক্তিগত-স্তরের কথাবার্তা’‌ শুরু করে।

শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, আইএমএফ–এর কাছ থেকে যথেষ্ট সমর্থন চাওয়া ছাড়া এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার কোনও উপায় নেই। আইএমএফ বাজেটে কাটছাঁট ও বাণিজ্য উন্মুক্ততা সহ বেশ কিছু শর্ত দিতে পারে। অন্য দেশগুলির থেকে বিশাল ঋণ চাওয়ার বিকল্প ব্যবহার করতে গেলে তার মধ্যে সব সময়েই ঋণদাতা দেশগুলির পছন্দের একটি কর্মসূচি থাকবে। তবে আইএমএফ–এর এই ধরনের নির্দেশগুলি অর্থনীতির এই পর্যায়ে বৈধ বলে মনে হলেও সময়ই বলে দেবে আইএমএফ-এর সঙ্গে শ্রীলঙ্কার গাঁটছড়া শুধু স্বল্পমেয়াদে একটি প্রতিষেধক হবে, নাকি তা শ্রীলঙ্কার একটি স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পুনরুদ্ধারের পথ দেখাবে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.