Published on Aug 15, 2021 Updated 0 Hours ago

ভারত ও বাংলাদেশ — এই দুই দেশেরই সুন্দরবনের পুর্ব-নির্ধারিত ও পূর্ব-সম্মত ভৌগোলিক অঞ্চল/সীমা সংক্রান্ত আলোচনার জন্য সুন্দরবন কমিশনারের অফিসকে পুনর্বহালের কথা ভাবা উচিত।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নিরিখে সুন্দরবনের তাৎপর্য

এই প্রবন্ধটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী স্মারক সিরিজের অন্তর্গত


 সুন্দরবন বাস্তু অঞ্চল — যা গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার বন্যা কবলিত নিম্ন ব-দ্বীপ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত — যেখানে পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য যা উভয় দেশেরই সীমানার সাধারণ অংশ এবং পৃথিবীর একমাত্র ব্যাঘ্র বসবাসকারী ম্যানগ্রোভ অঞ্চল। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিস্তৃত বনভূমির সংরক্ষিত অঞ্চলগুলিকে ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন (ইউনেসকো) দেশেই বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট) বলে ঘোষণা করেছে। উভয় দেশেই ছড়িয়ে থাকা প্রায় ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী প্রাকৃতিক অঞ্চলটিকে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রামসর অঞ্চল বা জলাভূমি হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৭৭০ সাল নাগাদ রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রথমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরবর্তী সময়ে তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার যখন এই বাস্তু অঞ্চলে চাষ-আবাদ ও বসতি স্থাপনে উৎসাহ দেখায়, তখন অঞ্চলটির আয়তন বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। বাসযোগ্য করে তোলা বনাঞ্চলের এক সুবিশাল অংশ, যা দুই দেশেই ব্যাপ্ত, বর্তমানে সম্মিলিতভাবে প্রায় ৭৫ লক্ষ মানুষের বাসস্থান।

সুন্দরবন নিয়ে এক সাধারণ ধারণার নির্মাণ দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।

যদিও ১৯৪৭ সালের পরবর্তী সময়ে এই বনাঞ্চলের সীমানার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেনি, কিন্তু সংরক্ষিত অঞ্চলের বাইরের প্রাকৃতিক ভূমি মানুষের প্রত্যক্ষ ব্যবহারের ফলে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় (যেমন সমুদ্রের জলস্তরের বৃদ্ধি, ঘনীভূত ঝড়ঝঞ্ঝা, ক্রমপরিবর্তনশীল লবণক্ততা ইত্যাদি) এবং জনসংখ্যার ক্রমশ বেড়ে চলা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মতো নৃতাত্ত্বিক কারণে অঞ্চলটির বাস্তুতন্ত্র আজ গভীর সংকটের সম্মুখীন। এই সংকটগুলি চিহ্নিত করার পরে ভারত ও বাংলাদেশ দুই পক্ষই ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সুন্দরবন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং (মউ) স্বাক্ষর করে। সেই সময় থেকেই ব্যাঘ্র সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক মূল্যায়নের নিরিখে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে। যদিও স্বাক্ষরিত মউ কার্যকর করার জন্য চুক্তিভিত্তিক নিজ নিজ অঞ্চল সুচিহ্নিতকরণ, ক্রমপরিবর্তনশীল জলবায়ুর প্রভাব নির্ধারণ এবং জীবনধারণের জন্য এই বাস্তু অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল মানুষজনের সমস্যা দূরীকরণ ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। যে দ্রুততার সঙ্গে একাধিক অনভিপ্রেত পরিবর্তন হয়ে চলেছে এবং এই বনাঞ্চলটি প্রতিনিয়ত যে তীব্র প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে — সে কথা মাথায় রাখলে এই নিষ্ক্রিয়তা ক্ষমার অযোগ্য। ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বর্ষপূর্তি আদতে এই মউটিকে পুনর্পর্যালোচনা করার এবং এই সংক্রান্ত কাজে যৌথ পদক্ষেপের প্রকৃত সময়।

দুই পক্ষের স্বাক্ষরিত মউকে বাস্তবায়িত করা এবং চুক্তি অনুসারে যৌথ পদক্ষেপের ক্ষেত্রে সুন্দরবনকে নিয়ে সাধারণ ভাবে একরকম পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকা অত্যন্ত জরুরি।

সুন্দরবন সংক্রান্ত যৌথ পদক্ষেপ ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের ক্ষেত্রেই নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে; ‘সুন্দরবন’ নিয়ে এক সাধারণ ধারণার নির্মাণ দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। ভারতে ‘সুন্দরবন’ বলতে সুদীর্ঘ বনাঞ্চল এবং ঐতিহাসিক ভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে বোঝায়, যেখানে ঔপনিবেশিক সময়কাল থেকেই বহু মানুষ বসতি স্থাপন করেছেন এবং যাকে পরবর্তী কালে ১৯৮৯ সালে সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশে ‘সুন্দরবন’ বলতে এখনও টিকে থাকা বনাঞ্চলকেই শুধুমাত্র বোঝানো হয়। দুই পক্ষের স্বাক্ষরিত মউকে বাস্তবায়িত করা এবং চুক্তি অনুসারে যৌথ পদক্ষেপের ক্ষেত্রে সুন্দরবনকে নিয়ে সাধারণ ভাবে একরকম পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক সংজ্ঞার নিরূপণ ঘটলে এবং দুই পক্ষই তাতে সহমত পোষণ করলে, সুন্দরবনের সংরক্ষণ এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সংক্রান্ত ঐতিহাসিক মউ ভারত ও বাংলাদেশ, এই দুই দেশের পক্ষেই বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে।

ঔপনিবেশিক শাসনকালে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসকের পাশাপাশি তৎকালীন ২৪ পরগণা, যশোর এবং বকরগঞ্জ জেলার খাজনা আদায়কারীদেরও সমান্তরাল ভূমিকা ছিল। কার্যত, সুন্দরবনের তৎকালীন কমিশনার এই জেলাগুলির রাজস্ব সংগ্রহের কাজে আংশিকভাবে নিযুক্ত ছিলেন এবং সমগ্র সুন্দরবন এস্টেটের রাজস্ব দফতরে জমা পড়ত। সুন্দরবনের কমিশনারের অফিস ১৮১৬ সালের রেগুলেশন ৯ অনুসারে স্থাপিত হয় যার প্রধান লক্ষ্য ছিল স্থানীয় জমিদারদের বৈধভাবে বসবাসকারী জমির সীমা অতিক্রম করে অবৈধ জমিগ্রহণের হার নির্ধারণ করা, যাতে বেআইনিভাবে দখলীকৃত জমিকে রাজস্বের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ১৮১৯ সালে সুন্দরবনের কমিশনারের আইনগত ক্ষমতার পরিসর বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সরকারের হয়ে বিভিন্ন বনাঞ্চল ইজারায় দেওয়ার ক্ষমতা মঞ্জুর করা হয়। কিন্তু জমির কর আগের মতোই উত্তরের বিভিন্ন জেলার স্ব স্ব কোষাগারে জমা হতে থাকে। ১৯০৫ সালে সুন্দরবনের কমিশনারের অফিসটি ভেঙে দেওয়া হয়, যদিও ততদিনে জমির মানচিত্রকরণ (ম্যাপিং) এবং রাজস্বের বর্ণনামূলক তালিকা তৈরির কাজ কম-বেশি প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশেরই উচিত পূর্ব-নির্দিষ্ট ও পূর্ব-সম্মত ভৌগোলিক অঞ্চল সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সুন্দরবন কমিশনারের অফিসের উপর দিয়ে সেই আফিসকে পুনর্বহাল করা।

বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশেরই উচিত পূর্ব-নির্দিষ্ট ও পূর্ব-সম্মত ভৌগোলিক অঞ্চল সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সুন্দরবন কমিশনারের অফিসের উপর দিয়ে সেই আফিসকে পুনর্বহাল করা। এই অঞ্চলটিকে আন্তঃসীমান্ত সুন্দরবন জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে অথবা বর্তমানে এটি যেমন একাধিক জেলার অংশ, তেমনই বহাল থাকতে পারে। সুন্দরবনের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য সুন্দরবন কমিশনার যা যা করতে পারেন, তা হলঃ (ক)ক্ষমতাসম্পন্ন একটি যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির কাছে রিপোর্ট পেশ করা, (খ) রাজস্ব, আইন এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কাজকর্মে হস্তক্ষেপ না করা এবং (গ) সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে এলাকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নসাধন। এটি শুধুমাত্র সুন্দরবনের নিরিখে সমাজ-উপযোগী ও সময়োচিত সিদ্ধান্তই হবে না, বরং তা আন্তঃসীমান্ত অঞ্চলে শাসনব্যবস্থার এক উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে থাকবে। দুই দেশের এহেন পারস্পরিক সহযোগিতা সুন্দরবনের ক্ষেত্রে এক সুবিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।

The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.