ভারতের উত্তর-পূর্বে প্রথম ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রেল সংযোগ স্থাপনের জন্য দুই দেশের মধ্যে এক দশক পুরনো সমঝোতাপত্র (এমওইউ) সম্প্রতি চালু হওয়া আখাউড়া-আগরতলা আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বারা ডিজিটাল মাধ্যমে উদ্বোধন হওয়া এই রেলপথটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী শহর আগরতলাকে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সংযোগপথটি দীর্ঘ, সরু এবং ঘনবসতিপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরের বিকল্প প্রদান করে। শিলিগুড়ি করিডোর ‘চিকেনস নেক' নামেও পরিচিত এবং তা উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করে। কার্যত, নতুন পথটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য, যেমন মিজোরাম এবং অসমের দক্ষিণ অংশ থেকে কলকাতা পর্যন্ত ভ্রমণের দূরত্ব কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে ত্রিপুরার ক্ষেত্রে তা উল্লেখ্য। ত্রিপুরা থেকে রেলপথে কলকাতার দূরত্ব ১৬০০ কিমি থেকে কমিয়ে ৫০০ কিমি এবং যাত্রাপথের সময় ৩১ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ১০ ঘণ্টায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।
সূত্র- ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ কানেক্টিভিটি- পসিবিলিটি অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস
সংযোগ জোরদার করার পাশাপাশি রেলপথটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত একটি সংক্ষিপ্ত পথ তৈরি করার মাধ্যমে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যকে সহজতর করবে, যেটি ব্যবহারের অনুমতি প্রধানমন্ত্রী হাসিনা গত বছর দিয়েছেন।
আখাউড়ার কাছে অবস্থিত আশুগঞ্জ বন্দরটির কাজ হবে চট্টগ্রামের স্টেশন ও বন্দরে পণ্য পরিবহণ করা। এটি ছাড়াও বেশ কয়েকটি রেল, সড়ক এবং নদীপথের সংযোগ শৃঙ্খল আখাউড়াকে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটের মতো বাংলাদেশের একাধিক শিল্পক্ষেত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করে। সেই অনুসারে, বাংলাদেশের জন্য এই রেল সংযোগ তার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি বহন করে। সংযোগপথটি চা, চিনির মতো কৃষিসামগ্রী, নির্মাণ সামগ্রী, লোহা ও ইস্পাত এবং ভোগ্যপণ্য সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করবে।
ঐতিহাসিক যোগসূত্রের পুনঃসন্ধান
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের আগে আখাউড়া জংশনটি ভারতের উত্তর-পূর্ব থেকে কলকাতায় যাতায়াতকারী বা পূর্ব পাকিস্তানের বাজারে প্রবেশের সন্ধানকারী মানুষ দ্বারা ব্যবহৃত হত। মুক্তিযুদ্ধ এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত জটিলতাগুলি অবশ্য সেই যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয় এবং সংযোগের জন্য একমাত্র বিকল্প হিসেবে মানুষ বেছে নেয় শিলিগুড়ি করিডোর, যেটি সুতীব্র বাঁকযুক্ত খাড়াই রাস্তার কারণে পণ্য ও ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহণের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি কঠিন পথ। এর ফলস্বরূপ, আন্তঃসীমান্ত যানবাহন চলাচলের জন্য একটি প্রোটোকলে স্বাক্ষর করার পর ভারত আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগের জন্য ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশকে অনুরোধ করে আসছে। যাই হোক, এই ভাবনা খানিকটা সুপ্ত অবস্থাতেই ছিল এবং ১৯৯৮ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য পর্যালোচনার সময় সংক্ষিপ্ত আকারে ফের তা প্রকাশ্যে উঠে আসে। আরও এক দশক পরে ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় প্রকাশিত একটি যৌথ বিবৃতিতে এই রেল সংযোগপথ নির্মাণের কথা ঘোষণা করা হয়। সে সময়ে দুই পক্ষই এ বিষয়ে সম্মত হয়েছিল যে, ডাবল লাইনের মাধ্যমে আগরতলা থেকে বাংলাদেশের গঙ্গাসাগর ও গঙ্গাসাগর থেকে আখাউড়াকে সংযুক্ত করা হবে। অন্য দিকে গঙ্গাসাগর ও ইমামবাড়ি স্টেশনে বাংলাদেশ রেলওয়ের দু’টি অতিরিক্ত লুপ লাইন তৈরি করা হবে। প্রকল্পটি নর্থ ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ে বাস্তবায়ন করবে এবং এর অর্থায়নের বেশির ভাগই ভারতের বিদেশমন্ত্রক ও আংশিক ভাবে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ভারতীয় বিভাগ বহন করবে।
প্রতিবন্ধকতার অতিক্রমণ
প্রকল্পটি ২০১৬ সালে শুরু হলেও বেশ কয়েকটি সমস্যা প্রক্রিয়াটিকে বাধা দান করে। প্রথমত, বাংলাদেশের অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন যে, ভারত নিজের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে উন্মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট চেয়েছে। কিন্তু তার বিনিময়ে ঢাকাকে ভারতের বাকি অংশে কোনও প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে না। বাংলাদেশের কিছু অংশ এমনকি ভারতের অনুরোধকে তার সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ণ করার চক্রান্ত হিসেবেও ব্যাখ্যা করে। ঢাকা এই শর্তসাপেক্ষে ভারতকে চট্টগ্রাম ব্যবহার করার অনুমতি দেয় যে, বাংলাদেশও নেপাল ও ভুটানে পরিবহণের জন্য ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করবে। বর্তমানে, হিমালয় অধ্যুষিত দুই দেশই অর্থাৎ নেপাল ও ভুটান ভারতের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরটি ব্যবহার করে এবং ২০২০ সালে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটানের ট্রানজিট বাণিজ্যকে সহজতর করে তোলার জন্য আগরতলায় নতুন বাণিজ্যিক সংযোগপথ উন্মোচন করতে সম্মত হয়।
তবে নানাবিধ মনোভাবকে সরিয়ে রাখলেও যে কথা অস্বীকার করা যায় না, তা হল আর্থিক সমস্যাও রেল সংযোগ প্রকল্পের সমাপ্তির বিলম্ব ঘটিয়েছে। প্রাথমিক ভাবে, এই প্রকল্পের জন্য ৯৭২.৫২ কোটি ভারতীয় টাকা মঞ্জুর করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৫৮০ কোটি টাকা ভারতের অংশের কাজের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল এবং ৩৯২.৫২ কোটি টাকা বাংলাদেশের অংশের কাজের জন্য সংরক্ষিত ছিল। অবশেষে, বর্ধিত খরচ ও নানাবিধ ব্যয়ের কারণে তহবিলটি দু’বার সংশোধিত হয়েছিল এবং চূড়ান্ত খরচ অনুমান করা হয়েছে প্রায় ১২৫৫.১০ কোটি ভারতীয় টাকা, যার মধ্যে ৮৬২.৫৮ কোটি টাকাই খরচ হবে ভারতের অংশের কাজের জন্য।
কোভিড-১৯-এর অপ্রত্যাশিত সূচনা আরও একটি সমস্যার উপস্থাপন করে প্রক্রিয়াটির আরও বিলম্ব ঘটায়। তবে সরবরাহ শৃঙ্খলের গুরুত্ব সম্পর্কে এই পথটির প্রয়োজনীয়তা অতিমারি পরবর্তী প্রকল্পের সমাপ্তি নিশ্চিত করতে উভয় দেশকেই অনুপ্রেরণা প্রদান করেছে। সেই অনুসারে, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের শেষে ভারতের নিশ্চিন্তপুরের একটি মনোনীত ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন থেকে আখাউড়ার কাছে গঙ্গাসাগর স্টেশন পর্যন্ত প্রথম ট্রায়াল রান দেওয়া হয়। ১২.২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইনের বাইরে ত্রিপুরার ৫.৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ব্রডগেজ ট্র্যাক রয়েছে এবং আখাউড়ায় ৬.৭৮ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি মিটারগেজ ট্র্যাক রয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিন্তপুর ডুয়েল গেজ স্টেশনে হবে এবং সেখানেই যাত্রী ও পণ্য বিনিময় সংক্রান্ত সব ব্যবস্থাপনা হবে। ‘উত্তরপূর্বের প্রবেশদ্বার’ হিসাবে চিহ্নিত স্থলবেষ্টিত ত্রিপুরাকে রেল সংযোগটি সংযুক্ত করবে।
ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সংলগ্ন অভিন্ন সাধারণ ভূখণ্ড থাকার দরুন দুই দেশই সংযোগমূলক উদ্যোগের স্বাভাবিক অংশীদার এবং আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগের মতো প্রকল্পগুলি এই ভৌগোলিক ধারাবাহিকতার সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশটিই হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ভারতের একমাত্র স্থলসেতু এবং ভারত সরকার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি অনুসরণ করার ফলে কৌশলগত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। নীতিটি বাংলাদেশ, মায়ানমার, নেপাল ও
ভুটানের মতো ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশী দেশগুলির অন্তঃস্থল এবং এ ভাবে তা ‘প্রতিবেশ প্রথম’ বা ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ নীতিতেও অন্তর্নিহিত।
সুতরাং, আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগটি স্থলভাগে যাত্রী ও পণ্য স্থানান্তরকে উপকৃত করার পাশাপাশি ভারতের বিদেশনীতিরও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের মধ্যে সংযোগপথ বিকাশের জন্য একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে ২০২১ সালে উদ্বোধন হওয়া মৈত্রী সেতু একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এটি চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ত্রিপুরার দক্ষিণতম বিন্দু সাব্রুমকে সংযুক্ত করে এবং পণ্য পরিবহণের পাশাপাশি বাংলাদেশের কক্সবাজার বা পাহাড়ি অঞ্চলের চট্টগ্রাম থেকে ত্রিপুরায় জনগণের চলাচলের সুবিধার্থে পরিকল্পনা করা হয়েছে। সাব্রুমের তৃতীয় চেকপোস্টটি দ্রুতই উদ্বোধন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেটি মৈত্রী সেতুকে কার্যকর করে তুলবে এবং ভারতের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের জন্য একটি পথ উন্মোচন করবে। আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগের সঙ্গে সংযুক্ত হলে মৈত্রী সেতু বাংলাদেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশে বহুস্তরীয় সংযোগ প্রদান করবে।
সহযোগিতায় মাইলফলক
আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা, সংযোগ বৃদ্ধি, বাণিজ্য এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগের একটি প্রধান মাইলফলক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যা ২০২৩ সালের ডিসেম্বর-২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। রেল সংযোগটি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চতুর্থ মেয়াদে তাঁর বিজয়ের সম্ভাবনাকে আরও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদান করবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং তাঁর বিজয়ের জন্য এই সংযোগপথটি হয়ে উঠবে ‘ডেভেলপমেন্ট কার্ড’ বা ‘উন্নয়নমূলক বাজি’। এখানে উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, অন্য দু’টি সহযোগী উদ্যোগের পাশাপাশি আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগের উদ্বোধন করা হয়েছিল। সেই দুই উদ্যোগ অর্থাৎ খুলনা-মংলা বন্দর রেল লাইন এবং বাংলাদেশের মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিট টু-র অর্থায়ন করেছিল ভারত।
ভারতও ২০২৪ সালে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে চলেছে এবং দেশের উত্তর-পূর্ব অংশে সমৃদ্ধির সূচনা করার প্রতিশ্রুতি মোদী সরকারের জন্য ইতিবাচক অর্থ বহন করে, বিশেষত যেহেতু মণিপুরে জাতিগত হিংসার বিষয়ে নীরব থাকার জন্য কেন্দ্র সম্প্রতি সমালোচিত হয়েছে। উপরন্তু, পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক - যার মধ্যে বাংলাদেশ একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ - দেশের অভ্যন্তরে, আঞ্চলিক পর্যায়ে এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মোদী সরকারের জনপ্রিয়তাকে সশক্ত করেছে।
সোহিনী বোস অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো।
অনসূয়া বসু রায় চৌধুরী অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো।
The views expressed above belong to the author(s). ORF research and analyses now available on Telegram! Click here to access our curated content — blogs, longforms and interviews.